X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেশ উন্নয়নশীল হলে কী হবে?

গোলাম মওলা
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১০:৪০আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৭:১৩

জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরেই বলা হচ্ছে, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। অর্থাৎ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসবে। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আগামী ২০ মার্চ বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হবে। স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল বা মধ্যম আয়ের দেশের এই আলোচনায় অনেকেরই প্রশ্ন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় গেলে কী হবে?

জানা গেছে, একটি দেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে (ডেভেলপিং কান্ট্রি-ডিসি) পরিণত হতে গেলে যে তিন সূচকের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, বাংলাদেশ সেই তিনটি শর্তই পূরণ করেছে। প্রথম শর্তে দেশে মাথাপিছু আয় ১২৪২ মার্কিন ডলার হতে হয়, যা বাংলাদেশ অনেক আগেই অতিক্রম করেছে। এখন দেশে মাথাপিছু আয় ১৬১০ মার্কিন ডলার। দ্বিতীয় শর্তে মানবসম্পদের উন্নয়ন, অর্থাৎ দেশের ৬৬ ভাগ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দশমিক ৯ ভাগ। আর তৃতীয় শর্তে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর না হওয়ার মাত্রা ৩২ ভাগের নিচে থাকতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই মাত্রা ২৫ ভাগ।

এসব শর্তপূরণহওয়ায় বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি কেবল আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছে। জাতিসংঘের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাউন্সিলে পাস হওয়ার পরই আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হয়ে উঠবে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণকে স্বাধীনতা-পরবর্তী জাতীয় জীবনের বড় অর্জন হিসেবে দেখছে সরকার। এ অর্জনের জন্য ২২ মার্চ সংবর্ধনা দেওয়া হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। একই দিন সারাদেশে আয়োজন করা হবে আনন্দ মিছিল। এই আনন্দ উৎসব চলবে ২৬ মার্চ অর্থাৎ স্বাধীনতা দিবস পর্যন্ত।

জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী ও ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সিপ্পো-ও স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশকে আগাম অভিনন্দন জানিয়েছেন।

উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যুক্ত হওয়াটাকে মর্যাদার বিষয় বলে উল্লেখ করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় গেলে আমাদের মর্যাদা বেড়ে যাবে। বিশ্বের কাছে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জল হবে। দেশের মানুষের এক ধরনের মনস্তাত্বিক অর্জন হবে। কেউ আর বাংলাদেশকে গরিব বা দরিদ্র দেশ বলতে পারবে না।’

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এলডিসি তালিকা থেকে বের হওয়া মানে দরিদ্র বা গরিব দেশের তালিকা থেকে বের হওয়া। দরিদ্র দেশ হিসেবে আমাদের আর কেউ দুর্বল ভাববে না। এটা যেকোনও দেশের জন্য গৌরবের বিষয়, গর্বের বিষয়, মর্যাদার বিষয়। এটা হলে দেশের ভেতরেও স্বস্তি তৈরি হবে।’

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম উল্লেখ করেন, উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার কারণে বিশ্বের সব দেশের কাছে ও আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন সংস্থার কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়ে যাবে। উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী বলে বিশ্বের কাছে বিবেচিত হয়। এর ফলে উন্নয়নশীল হওয়ার মধ্যে দিয়ে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের অর্থনৈতি ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে ঝুঁকি বিবেচনা করা হয়, সেটা অনেকাংশেই কমে যাবে। ফলে দেশে বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা বাড়বে। শুধু তাই নয়, আর্ন্তজাতিক সংস্থাগুলোও ঋণ দিতে আগ্রহী হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঘোষণার পরও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না পারলে ফের পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে। তারা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট রাখা চলবে না। যেকোনও সহিংসতা, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা এই অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে পারে।

এ প্রসঙ্গে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আফ্রিকার কিছু ‍দেশের উদাহরণ তুলে ধরেন। এসব দেশ উন্নয়নের গতিপথে থাকার পরও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও আঞ্চলিক সংকটের কারণে পিছিয়ে পড়েছে। গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বাংলাদেশে আরও শিল্পায়ন হতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে হবে, কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। আর এটা করতে হলে শ্রমঘন আরও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়াতে হবে।’ এ জন্য রাজস্ব আহরণের গতি বাড়ানো ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, সুশাসন, সমাজের বৈষম্য দূরীকরণ জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর যেসব ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে, তার উল্লেখ করে সিপিডির এই পরিচালক বলেন, ‘বিভিন্ন দেশ ও আর্ন্তজাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে পাওয়া ঋণে সুদের হার বেড়ে যাবে। গ্রেস পিরিয়ড কমে আসবে অথবা থাকবে না। আবার ঋণের টাকা ফেরত দেওয়ার সময়ও কম ধরা হবে। এতে বৈদেশিক ঋণ সংক্রান্ত ব্যয় বাড়বে। রফতানি বাজার কিছুটা সংকুচিত হয়ে যাবে। বিশেষ করে নতুন পণ্য নিয়ে ঝুঁকিতে পরতে হতে পারে। পুরনো পণ্যও রফতানি বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে খরচ বেড়ে যাবে। সব ধরনের শুল্ক সুবিধা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এছাড়া রফতানি বাজারে নতুন নতুন শর্ত যুক্ত হতে পারে। এনজিওগুলোর জন্য বিদেশি ফান্ড কমে যাবে, ফান্ড আসা বন্ধ হয়ে যাবে।’

এ প্রসঙ্গে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘আগামী মাসে ঘোষণা হলেও ২০২৮ সালের মধ্যে আমাদের বেশকিছু কাজ করতে হবে। এই ৯ বা ১০ বছরে আমাদের মানবসম্পদের উন্নয়ন করতে হবে। বিশ্ববাজারে টিকে থাকার মতো নীতি সংস্কারের দরকার হবে। সেটা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বা আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে হবে। সে জন্য দেশের নীতি নির্ধারকদের পরিপক্কতা অর্জন করতে হবে। বিভিন্ন দেশ বা আর্ন্তজাতিক সংস্থার সঙ্গে দরকষাকষির (নেগোসিয়েশন) ক্ষেত্রে দক্ষতা অজর্ন করতে হবে। বিশেষ করে আগামী বছরগুলোতে যেন দেশে কোনোভাবেই অর্থনৈতিক অস্থিরতা বা অস্থিতিশীলতা তৈরি না হয়, সে বিষয়ে সর্তক থাকতে হবে।’

এদিকে, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এলেও স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে প্রাপ্ত সুবিধাগুলো আরও ১০ বছর পাবে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আংকটাডের এলডিসি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৭ সাল পর্যন্ত এই সুবিধাগুলো পাবে বাংলাদেশ।

প্রসঙ্গত, জাতিসংঘ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত— এ তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে থাকে। বর্তমানে ৪৮টি দেশ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এশিয়াতে বাংলাদেশের পাশাপাশি আফগানিস্তান, ভুটান, কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার, নেপাল ও ইয়েমেন রয়েছে এই তালিকায়।

 

/টিআর/আপ-এফএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
ওপারের গোলার বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে টেকনাফ
ওপারের গোলার বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে টেকনাফ
নিজ বুদ্ধিমত্তায় যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
নিজ বুদ্ধিমত্তায় যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
 ‘রান আপের গতি আর হ্যান্ড সুইংয়ে বদল এনেই সাফল্য পাচ্ছি’
 ‘রান আপের গতি আর হ্যান্ড সুইংয়ে বদল এনেই সাফল্য পাচ্ছি’
সর্বাধিক পঠিত
অভিযোগের শেষ নেই মাদ্রাসায়, চলছে শুদ্ধি অভিযান
অভিযোগের শেষ নেই মাদ্রাসায়, চলছে শুদ্ধি অভিযান
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
আমার কাছে ৪৫টি বাচ্চা আছে, ডিবিকে বলেন নিয়ে যেতে: আদালতে মিল্টন সমাদ্দার
আমার কাছে ৪৫টি বাচ্চা আছে, ডিবিকে বলেন নিয়ে যেতে: আদালতে মিল্টন সমাদ্দার
কোন পথে এগোচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?
কোন পথে এগোচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?