১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রথম যোদ্ধাদের অন্যতম আব্দুল আলী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি পুলিশের তখনকার আইজিপির দেহরক্ষী হিসেবে কর্মরত। হানাদার বাহিনীর আক্রমণের সময় উপস্থিত ছিলেন রাজারবাগে। ওই মুহূর্তের করণীয় জানতে তিনি যোগাযোগের চেষ্টা করেন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তাতে ব্যর্থ হলে রাত সাড়ে ১১টার সময় বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামালের মাধ্যমে পেয়েছিলেন নির্দেশনা। সেই অনুযায়ীই রাজারবাগের পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে তিনি বাঙালি পুলিশ সদস্যদের সতর্ক করেছিলেন। তাতেই সালামি গার্ডে জড়ো হয়েছিলেন হয়েছিলেন বাঙালি পুলিশ সদস্যরা।
আব্দুল আলীর সেই প্রথম প্রতিরোধের বর্ণনা জানতে তার সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। তিনি বলেন, ‘রাত তখন সাড়ে ১১টা (১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ)। হানাদার বাহিনীর আক্রমণের খবর পাচ্ছিলাম। ওই মুহূর্তে কী করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের কারও সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পারিনি।’
শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামালের কাছে ওই মুহূর্তের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা পেয়েছিলেন আব্দুল আলী। তিনি বলেন, ‘শেখ কামালের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়েই পাগলা ঘণ্টা বাজাই। ওই ঘণ্টার আওয়াজ শুনে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা সালামি গার্ডে জড়ো হন। তখন অন্যদের সঙ্গে নিয়ে অস্ত্রাগারের তালা ভাঙা হয়। আমি নিজেই অস্ত্রাগারে ঢুকে অন্যদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছি।’
রাজারবাগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরের সম্মুখ সমরের কথাও বলেন এই যোদ্ধা। তিনি বলেন, ‘রাত সাড়ে ১২টার দিকে রাজারবাগের কাছে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পৌঁছে যায়, তখন আমরা রাজারবাগ থেকে গুলি করতে থাকি। তারাও তখন কামান ও ট্যাংক থেকে পাল্টা গোলা ছুঁড়তে থাকে। এদিকে আমরা পাল্টা জবাব দিতে থাকি ৩০৩ রাইফেল দিয়ে।’
আব্দুল আলী বলেন, ‘২৬ মার্চ ভোরে পাকিস্তানি বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ওই সময় আমরা অনেকে পুলিশ লাইন্সের চার তলা ভবনের ছাদে পানির ট্যাংকের নিচে লুকিয়ে ছিলাম। হানাদার বাহিনীর সদস্যরা খুঁজে খুঁজে আমাদের সেখান থেকে বের করে আনে। এরকম বিভিন্ন জায়গা থেকে খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসে আরও ২০-২৫ জনকে। বাকিরা বাইরে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।’
পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ওই রাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় দেড়শ পুলিশ সদস্য। আব্দুল আলীর ভাষ্যমতে, হানাদার বাহিনীর সদস্যরা রাজারবাগের পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যাদের আটক করে, তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাতে শুরু করে। ২৮ মার্চ পর্যন্ত বন্দি রাখে আমাদের। এর মধ্যে আমাদের কোনও খাবার-পানি কিছুই দেওয়া হয়নি।’
ওই রাতে আটক পুলিশ সদস্যদের পরে হস্তান্তর করা হয় ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার ই এ চৌধুরীর কাছে। সেখান থেকে তাদের বলা হয় একটি নির্দিষ্ট দিনে কাজে যোগ দিতে বলা হয়। কিন্তু সেই নির্দেশ মানেননি আব্দুল আলী এবং তার সহযোদ্ধারা। বরং তারা পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে ওই রাতে প্রায় দেড়শ পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছিলিন। আব্দুল আলী বলেন, ‘আমাদের যখন লুকানো জায়গা থেকে বের করে নিয়ে আসে, তখন এদিক-ওদিক অনেক পুলিশ সদস্যের লাশ পরে থাকতে দেখি। সংখ্যা হিসাব করলে দেড়শর কম হবে।