X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সাংবাদিকদের উদ্বেগ কাটেনি

শফিকুল ইসলাম
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২৩:৫৭আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৭:০২




ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদে পাস হয়েছে বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল। তবে এ বিষয়ে দেয়া সুপারিশগুলোর কোনও প্রতিফলন না ঘটায় সাংবাদিকদের মধ্যে উদ্বেগ, আতঙ্ক ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সাংবাদিক নেতারা বলেছেন, সাংবাদিকদের মতামত ছাড়া গণমাধ্যম সম্পর্কিত করা আইন কেবল প্রশাসন বা সরকারের সঙ্গে সাংবাদিকদের দূরত্ব বাড়াবে। এমন উদ্যোগ গণমাধ্যমকে মর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে চেতনা, সেই চেতনারও পরিপন্থী হবে বলে মন্তব্য করেছেন তারা।

জাতীয় সংসদে সদ্য পাশ হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে সাংবাদিকদের যে উদ্বেগ ছিলো তা কাটেনি। কাটেনি আতঙ্ক। কাজেই এ দুটো জটিল বিষয়ই আইনে রয়ে গেলো বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সদ্য সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল।

টেলিফোনে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি জানান, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তিমন্ত্রী সংসদকে ভুল তথ্য দিয়েছেন। সংসদকে বিভ্রান্ত করেছেন। এই আইনের বিভিন্ন ধারার বিষয়ে আমরা সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে যে ৩২টি সুপারিশ দিয়েছিলাম তা মানা হয়নি। সুপারিশগুলো মানা হলে অনেক জটিলতাই কেটে যেতো। তা না হওয়ায় জটিলতা রয়েই গেলো।

তবে কিছু সুপারিশ তো মেনেছেন, যে সুপারিশগুলো মানা হয়েছে তা খুবই সহজ বিষয়। কারণ ব্যাখ্যা করে মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, “আমরা শাস্তি কমানোর সুপারিশ করেছিলাম তা মানা হয়েছে। কয়েকটি শব্দের পরিবর্তনের সুপারিশ করেছিলাম তা মানা হয়েছে। কিন্তু ‘আমরা সুপারিশ করেছিলাম সংবাদপত্র ও অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যম কখনোই এক নয়। ফেইসবুক ব্যবহারকারী ও সাংবাদিক কখনোই এক নয়। আমরা চেয়েছিলাম সংবাদ মাধ্যম ছাড়া ফেইসবুকসহ অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমে যে ব্যক্তি গুজব ছড়িয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অস্থিরতা সৃষ্টি করে তার শাস্তি হোক।’ কিন্তু এই আইনে গুজবকারী ও সাংবাদিকদের এক কাতারে ফেলা হয়েছে। এতে সাংবাদিকরা কখনোই নিরাপদ বোধ করবেন না। কারণ এ আইনে দাফতরিক নিরাপত্তার নামে যেকোনও সাংবাদিক অভিযুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমরা এর ব্যত্যয় চেয়েছিলাম। কিন্তু পাইনি।”

তিনি আরও বলেন, ‘এ আইনটি প্রণীতব্য সম্প্র্রচার আইনেরও পরিপন্থী হবে। আমরা বলেছিলাম, যেহেতু আপাতত জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে তাই জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা আইনটি প্রণয়ন পর্যন্ত অপেক্ষা করা হোক। কিন্তু আমাদের সেই পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। এ আইনটি প্রণীতব্য জাতীয় সম্প্রচার আইনের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হবে বলে মনে করেন মনজুরুল আহসান বুলবুল।’

তিনি বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম সাংবাদিকদের যেনো প্রেস কাউন্সিল প্রোটেককশন দেওয়ার সক্ষমতা থাকে তা যেনো রাখা হয়। কিন্তু তাও রাখা হয়নি।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, যেহেতু আইন পাশ হয়ে গেছে, এখন আর কিছুই তো করার নাই। তার পরেও আইনের প্রয়োগ, অপপ্রয়োগ, আইনের ব্যবহার, আইনের অপব্যাবহার দেখি। তার পরেই করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি খুবই প্রয়োজন ছিলো। তবে এ আইনে সংবাদপত্র ও ব্লগ ফেইসবুক এক করা হয়েছে, যা ঠিক হয়নি। কারণ সংবাদপত্রে যে সংবাদ প্রচার করা হয় বা ছাপা হয়, তা থাকে এডিটেড, আর ব্লগে বা ফেইসবুকে যা লেখা হয় তা এডিটেড থাকে না। সরাসরি লেখক যা মনে করেন তাই লেখা হয়। কিন্তু নতুন এই আইনে এ দুটি বিষয়কে একত্রিত করা হয়েছে, যা এ আইনের বড় দুর্বলতা।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে সাংবাদিকরা কোনোভাবেই নিরাপদ নন। তারা ঝুঁকিতে রয়েছেন। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা ৩২ দফা মানা হয়নি বলেও অভিযোগ করেন এই সাংবাদিক।’

উল্লেখ্য, চলতি ২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন পায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ করা হচ্ছিল যে এতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হবে। তাই অনেকে এর প্রতিবাদও করেছেন।

অনুমোদন পাওয়া আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনও ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যেকোনও ধরনের ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে সেই ব্যক্তি ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’

নতুন আইন অনুসারে, কেউ বেআইনিভাবে কারও ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে তাকে সাত বছরের জেল ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। বেআইনিভাবে অন্য সাইটে প্রবেশ করার পর যদি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হন, তবে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হতে পারে। আবার কেউ বেআইনিভাবে কারও ডিভাইসে প্রবেশ করলে এক বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ আইনে কারও ডিভাইসে প্রবেশে সহায়তা করার শাস্তি হিসেবে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

গত ৯ এপ্রিল এই বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। পরে এটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। সংসদীয় কমিটি স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে দু'দফায় বৈঠক করে। ওই বৈঠকে এডিটরস কাউন্সিলের পক্ষ থেকে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) এর ২১, ২৫, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৪৩ ধারা সম্পর্কে আপত্তি জানানো হয়।

এর আগে গত ২৯ জানুয়ারি ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এরপর থেকে এই আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন গণমাধ্যম ও মানবাধিকারকর্মীরা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, দেশে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন ও ইউনিয়ন আইনটির কঠোর ও বিতর্কিত কিছু ধারা বাদ দেওয়ার দাবি তোলে। আইনের ২১, ২৫ ও ২৮ ধারা নিয়ে গত ২৫ মার্চ উদ্বেগ জানান ১১টি দেশের কূটনীতিক।

আইনের বিভিন্ন ধারা উল্লেখ করে একাত্তর টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি পারভেজ নাদির রেজা ফেসবুকে ‘#আমিগুপ্তচর' এই হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে লিখেছেন, ‘মন্ত্রিসভায় পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ নম্বর ধারার এই অপরাধ আমি আমার সাংবাদিকতা জীবনে বহুবার করেছি। যেহেতু আমি আমার অনেক সহকর্মীর মতো এই পেশা এখনও ছেড়ে যাইনি, বিদেশে পাড়ি দেইনি, যেহেতু আগামী দিনগুলোতেও সাংবাদিকতা করেই যেতে চাই, সেহেতু আমি নিজেকে আইনের ভাষায় গুপ্তচর হিসেবে ঘোষণা করলাম। আজ থেকে শুরু হোক #আমিগুপ্তচর স্লোগানের আন্দোলন। আসুন স্বঘোষিত এই গুপ্তচরকে গ্রেফতার করুন এবং সাংবাদিকতাকে গলা টিপে হত্যা করার মিশনে সফল হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যান।’ তিনি লেখার সঙ্গে এই হ্যাশট্যাগ লেখা একটি কাগজ ধরে ছবি পোস্ট করেছেন।

একইভঙ্গিতে ছবি তুলে ফেসবুকে তা পোস্ট করেছেন মাছরাঙা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি বদরুদ্দোজা বাবু। তিনি লিখেছেন, ‘আমি বদরুদ্দোজা বাবু। অনুসন্ধান করি, সাংবাদিকতা করি। মানুষের স্বার্থে কাজ করি। অনিয়ম আর দুর্নীতি খুঁজি। ফলে আমাকে সরকারি অনেক নথি জোগাড় করতে হয়! ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভাষায়, এখন আমি গুপ্তচর!''

/টিটি/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
চাইলেই কি বনের আগুন প্রতিরোধ সম্ভব
চাইলেই কি বনের আগুন প্রতিরোধ সম্ভব
একদিন আগে নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাচন স্থগিত
একদিন আগে নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাচন স্থগিত
সরকার বিনিয়োগকারীদের সব সুবিধা নিশ্চিতে বদ্ধপরিকর: পরিবেশমন্ত্রী
সরকার বিনিয়োগকারীদের সব সুবিধা নিশ্চিতে বদ্ধপরিকর: পরিবেশমন্ত্রী
সর্বাধিক পঠিত
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
কারিনাকে নিজ পরিবারে স্বাগত জানালেন প্রিয়াঙ্কা
কারিনাকে নিজ পরিবারে স্বাগত জানালেন প্রিয়াঙ্কা