X
বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫
১৯ আষাঢ় ১৪৩২

ইমাম-মুয়াজ্জিনদের টানাটানির সংসারে করোনার আঘাত

চৌধুরী আকবর হোসেন
২৭ জুন ২০২০, ১৬:৪৩আপডেট : ২৮ জুন ২০২০, ১০:১৫

মসজিদ (ছবি: চৌধুরী আকবর হোসেন) রাজধানীর মিরপুরে একটি মার্কেটের মসজিদে খতিব ছিলেন মাওলানা মেহেদী হাসান মুরাদ। পাশাপাশি একটি স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষার ক্লাস নিতেন তিনি। এপ্রিল মাসে মসজিদের চাকরি হারান, আর স্কুলের বেতন বন্ধ অনেক আগে থেকেই। দুই বছর বয়সী কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে সাদামাটা জীবন আরও  ফ্যাকাশে হয়ে যায় বাসা ভাড়া দিতে না পারায়। একদিকে বাড়িওয়ালার চাপ, অন্যদিকে আয়ের কোনও পদ খোলা ছিল না। বাধ্য হয়ে শহরজীবনের ইতি টেনে পরিবার নিয়ে ফরিদপুরে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন মাওলানা মেহেদী হাসান মুরাদ। গ্রামে ঘর ভাড়া না লাগলেও ধার-দেনা করে অনেক কষ্টে টেনে নিচ্ছেন সংসার। আত্মসম্মান বোধ থেকে সাহায্য চেয়ে হাত বাড়াতেও পারছেন না। করোনার  আঘাতে মাওলানা মেহেদী হাসানের মতো দিশেহারা দেশের অনেক মসজিদের খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা।

মাওলানা মেহেদী হাসান মুরাদ মসজিদ থেকে মাসে বেতন পেতেন ৮ হাজার টাকা। তাতে সংসার চলতো না। বাড়তি আয়ের জন্য স্কুলে চাকরি নিয়েছিলেন। করোনার প্রভাবে এখন তিনি বেকার।  দিশেহারা মাওলানা মুরাদ এখন উপায় খুঁজছেন কীভাবে সংসার চালাবেন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘যখন মসজিদে মুসল্লিদের প্রবেশে বিধি-নিষেধ আরোপ হলো, তখন থেকেই সংকটের শুরু। হুট করে মসজিদ কমিটি বলে দিলো—আর আসা লাগবে না। ৪-৫ মাস ধরে স্কুলেও বেতন নেই। বাসা ভাড়া দিতে না পারায় বাড়িওয়ালা বাসা ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। বুঝতে পারছিলাম না কী করবো। শেষমেশ বাধ্য হয়ে ঢাকা ছেড়েছি। গ্রামে এসে হয়তো এখন বাসা ভাড়া লাগে না। কিন্তু অন্যসব খরচ তো আছে। আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার-দেনা করে কিছুদিন চললাম। এখন কী করবো?’

স্বাভাবিক সময়েই নানা সংকটের মধ্যে দিন কাটে দেশের মসজিদের খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমদের। করোনাভাইরাসের মহামারি নতুন করে আরও সংকট বাড়িয়েছে তাদের। শহরের তুলনায় গ্রামের মসজিদগুলোতে সংকট আরও প্রকট। আত্মসম্মান আর লোকলজ্জার ভয়ে অনেকেই সাহায্যের জন্য হাত বাড়াতে পারছেন না।

জানা গেছে, মূলত সংকটের শুরু হয় দেশে করোনার কারণে মসজিদে মুসল্লিদের প্রবেশের বিধিনিষেধ আরোপের পর। গত ৬ এপ্রিল সরকার মুসল্লিদের ঘরে নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছিল। ফলে সেই সময় থেকে মসজিদগুলো মুসল্লি শূন্য হয়ে পড়ে।  মুসল্লিরা মসজিদে না আসায় দান বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব অনুসরণসহ নানাবিধ কারণে মসজিদের জন্য অনুদান ও সাহায্য সংগ্রহের কার্যক্রমও স্থবির হয়ে পড়ে। ফলে অনেক মসজিদই ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমদের বেতন দিতে পারছে না। প্রায় এক মাস পর গত ৭ মে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সুস্থ মুসল্লিদের জন্য মসজিদে নামাজ আদায়ের নিয়ম করে সরকার। তবে মুসল্লিরাও আর্থিক সংকটে থাকায় আগের মতো দান-অনুদান দিতে পারছেন না।

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়াতে ২৪ ঘণ্টা সাপ্তাহিক ছুটিবিহীন দায়িত্ব পালন করলেও খুব বেশি বেতন পান না ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা। এমনকি এই পেশার মানুষদের জন্য নেই কোনও নির্ধারিত বেতন কাঠামো। বিভিন্ন স্থানের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীতে এলাকা ভেদে ইমামরা বেতন পান ৬ থেকে ১৫ হাজার টাকার পর্যন্ত। তবে অভিজাত এলাকার কিছু মসজিদের ইমামরা ২০-২৫  হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পেয়ে থাকেন। মুয়াজ্জিনদের বেতন সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। গ্রামাঞ্চলে এই বেতনের হার আরও কম।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে আর্থিক অনুদান দিতে মে মাসে দেশের ২ লাখ ৪৪ হাজার ৪৩টি মসজিদের জন্য ১২২ কোটি ২ লাখ ১৪ হাজার টাকা বরাদ্দ করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মসজিদগুলোর আর্থিক অসচ্ছলতা দূর করতে প্রত্যেক মসজিদের অনুকূলে পাঁচ হাজার টাকা হারে অনুদান প্রদানের অনুমোদন দেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এই অনুদান বিতরণ করা হয়।

যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রয়োজনের তুলনায় অনুদানের এই টাকা অপ্রতুল। একটি মসজিদে ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম মিলিয়ে কমপক্ষে তিন জন কাজ করেন। সেখানে এককালীন মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বণ্টন করা কঠিন। আর বরাদ্দপ্রাপ্ত তালিকার বাইরে থাকা মসজিদগুলো একেবারেই বঞ্চিত। এদিকে অনুদানের টাকা প্রাপ্তি নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। জুন মাসে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশ হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া অনুদানের টাকা চাওয়ায় চাকরি হারিয়েছেন মাগুরার সদর উপজেলার শত্রুজিতপুর ইউনিয়নের সিংহডাঙ্গা উত্তরপাড়া মসজিদের ইমাম। ৩১ মে ওই মসজিদ কমিটির সভাপতি মীর খোরশেদ আলমের কাছে টাকা চাইলে মসজিদের ইমাম আবু সাঈদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আলেমদের সহায়তায় পরিচালিত ‘আন-নূর হেল্পিং হ্যান্ড বাংলাদেশ’ ২ হাজার পরিবারকে খাদ্য ও অর্থ সহায়তা দিয়েছেন। এদের মধ্যে পাঁচ শতাধিক ইমাম মুয়াজ্জিন সহায়তা পেয়েছেন বলে দাবি করেছে সংগঠনটি। বাংলাদেশে সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক মাওলানা আনছারুল হক ইমরান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করেছিলাম, যারা সংকটে আছেন, তারা যেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমরা সাহায্য গ্রহণকারীর নাম পরিচয় প্রকাশ না করেই সহায়তা করবো। সাধারণ মানুষ যেমন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, তেমনি মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, আলেমরাও যোগাযোগ করেছেন। আমাদের কাছে কেরানীগঞ্জ, চাঁদপুর, গাজীপুর থেকে অনেকেই যোগাযোগ করেছেন—যারা মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও  খাদেম। দুই-তিন মাস ধরে এদের মধ্যে কেউ পুরো বেতন পাচ্ছেন না, কেউ অর্ধেক পাচ্ছেন। লোকলজ্জায় তারা কারও কাছে হাতও বাড়াতে পারছেন না। আমরা তাদের আর্থিক সাহায্য করেছি। তবে আমাদের একার পক্ষে সবাইকে সহযোগিতা করা সম্ভব নয়, সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আনিস মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী রোজার ঈদের আগে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য এককালীন বরাদ্দ দিয়েছিলেন। সেটির বিতরণ প্রায় শেষ। আর তালিকার বাইরেও কোনও মসজিদ চাইলে আমরা বিতরণ করছি।’

আবারও বরাদ্দ দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে আনিস মাহমুদ বলেন, ‘ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে এমন কোনও পরিকল্পনা নেই। তবে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে কোনও সিদ্ধান্ত আছে কিনা, তা আমাদের জানা নেই।’

আরও  পড়ুন:  ইমাম-মুয়াজ্জিনদের টানাটানির সংসার

/এপিএইচ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভোট ছাড়াই চেয়ার দখল করতে বগুড়া চেম্বারের কার্যালয়ে তালা
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিভোট ছাড়াই চেয়ার দখল করতে বগুড়া চেম্বারের কার্যালয়ে তালা
ফিরে দেখা: ৩ জুলাই ২০২৪
ফিরে দেখা: ৩ জুলাই ২০২৪
টিভিতে আজকের খেলা (৩ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৩ জুলাই, ২০২৫)
কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় এনসিপির তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ
কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় এনসিপির তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ
সর্বাধিক পঠিত
নবম পে-কমিশন গঠনের কার্যক্রম শুরুর আশ্বাস অর্থ উপদেষ্টার
সংযুক্ত কর্মচারী প‌রিষ‌দের জরু‌রি সভানবম পে-কমিশন গঠনের কার্যক্রম শুরুর আশ্বাস অর্থ উপদেষ্টার
বরখাস্ত হলেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট তাবাসসুম ঊর্মি
বরখাস্ত হলেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট তাবাসসুম ঊর্মি
পরীক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তদন্তে কমিটি
পরীক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তদন্তে কমিটি
কার দোষে শ্রমবাজার বন্ধ হয় জানালেন আসিফ নজরুল
কার দোষে শ্রমবাজার বন্ধ হয় জানালেন আসিফ নজরুল
কেমন কেটেছিল ডিবি হেফাজতে ছয় সমন্বয়কের সাত দিন
কেমন কেটেছিল ডিবি হেফাজতে ছয় সমন্বয়কের সাত দিন