X
বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫
১৯ আষাঢ় ১৪৩২

‘জার্নিটা কঠিন, যুদ্ধটা অনেক বেশি’

জাকিয়া আহমেদ
১১ জুলাই ২০২০, ১২:৪৬আপডেট : ১১ জুলাই ২০২০, ১৩:৪২

আনিলা ও তার বাবা-মা আফিয়া কবীর আনিলা আইন নিয়ে লেখাপড়া করছেন রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত তিনি। করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর থেকে আনিলা কঠিন সময় পার করছেন। ঘরের ভেতরে বসে থাকার কারণে মেজাজ ভালো থাকছে না, স্বাভাবিক কথাতেও রেগে যাচ্ছেন, ভীষণভাবে কাঁদছেন। তাকে আতঙ্কিত করে তুলছে করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর খবরগুলো। যেদিনই টেলিভিশনে করোনাতে বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর দেওয়া হয় সেদিনটা তার জন্য আরও বেশি কষ্টকর হচ্ছে। তিনি এই বিষয়গুলো মেনে নিতে পারছেন না। একইসঙ্গে নিজের চিকিৎসা নিয়েও আতঙ্কিত আনিলা।

বাংলা ট্রিবিউনকে এই কথাগুলো জানান আনিলার মা এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে কাজ করা তরী ফাউন্ডেশন ও স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন এর পরিচালক মারুফা হোসেন। তিনি বলেন, ‘আনিলা বলছে, আমার হাত-পায়ে অনেক সমস্যা। রক্ত নেওয়া কঠিন। আমাদের চিকিৎসার জন্য ট্রেনিং পাওয়া নার্সরা কি আছেন? এই অবস্থায় তারা আমার টেক-কেয়ার কী করে করবেন? এসব অজানা আতঙ্কে সবসময় ভুগছেন তিনি।’

তিনি জানান, ‘আনিলা বাইরে যাওয়ার ব্যাপারেও আতঙ্কিত। এটা কী করে কমানো যাবে সেটা আমি এখনও বুঝতে পারছি না, এটা বড় চ্যালেঞ্জ। হয়তো উতরিয়ে যাবো, কিন্তু টাফ হবে। মনে হচ্ছে, এত বছরে গুছিয়ে আনা সবকিছু নিয়ে আবার নতুন করে স্ট্রাগলের মুখোমুখি হতে হবে।’

মায়ের সঙ্গে আনিলা

রাজধানীতে বসবাসকারী আরেকটি পরিবারে বাবা-মা দুই জনই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত। তাদের অটিস্টিক সন্তানের বয়স ২১ বছর। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বাবা বলেন, ‘যে বাসায় দুইজনই কোভিড পজিটিভ, সে বাসায় কে আসবে? আর ২১ বছরের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষটিকেই বা সামলাবে কে? জীবনে এই প্রথম এত বড় প্রশ্নের মুখোমুখি। এরকম সংকটের সম্মুখীন আর হইনি।’

তিনি জানান, বাবা-মায়ের এ পরিস্থিতিতে ছেলে ভীষণভাবে ভায়োলেন্ট হয়ে যাচ্ছিল। পরে তারা যোগাযোগ করেন একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। একইসঙ্গে তাদের বলা হয়, কোভিড নিয়েই পিপিই পরে ছেলেকে সেবা করতে। তিনি বলেন, ‘ভাগ্য ভালো যে আমাদের দুই জনের কাউকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি। যদি দুই জনকেই, অথবা একজনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হতো, তাহলে এই বাচ্চাটার কী হতো?’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক মা বলেন, ‘ভেবেছিলাম কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু অনেক বেশি সময় লাগছে। এই বাচ্চাগুলোকে ঘরে রাখা, সব নিয়ম মেনে চলানো খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে যাদের অটিজম রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘খুব অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ওরা। করোনার এই সময়ে জার্নিটা কঠিন, যুদ্ধটা অনেক বেশি অন্যদের থেকে। তবে এর মধ্যেও যেসব বাচ্চার অবস্থা সিভিয়ার, তাদের নিস্তার নেই। প্রতিটি মুহূর্ত বলে বলে যায়। কিচ্ছু করার নেই আমাদের।’

ড্যানী রহমান ও তার ছেলে সিয়াম

করোনার এ সময়ে যেসব পরিবারে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু রয়েছে তাদের জন্য পরিস্থিতিটা খুব কঠিন, যুদ্ধটা অনেক বেশি বলে জানাচ্ছেন তাদের বাবা-মায়েরা। চিকিৎসকদের মতামতও তাই। তারা বলছেন, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু, তাদের পরিবার, তাদের ইনস্টিটিউটগুলো কীভাবে এই সংকট সামলাবেন, কীভাবে সারভাইভ করবেন, এটা নির্ধারণ করা জরুরি।

মারুফা হোসেন বলেন, ‘এসব শিশুকে নিয়ে পরিচালিত স্কুলের পরিচালক হিসেবে স্কুলের কর্মীদের কথাও ভাবতে হচ্ছে। অনেকেই গ্রামে চলে যাচ্ছেন। অভিভাবকরা স্কুলের বেতন দিতে পারছেন না, ফলে কর্মীদের বেতন দিতে সমস্যা হচ্ছে। এমন এক পরিস্থিতিতে সরকারিভাবে যদি আমাদের সাহায্য করা না হয়, তাহলে চলবো কী করে? স্কুলে যেসব বাচ্চা রয়েছে তাদের কী করে ফেরানো যাবে? তাদের স্বস্তির জায়গা দেবো কীভাবে? অনেক কথা বলা যায়। কিন্তু বাস্তব জীবনটা অনেক কঠিন। খাপ-খাওয়ানো এতো সহজ না।’

বিকল্প সেবার ব্যবস্থা রাখা উচিত মন্তব্য করে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাবা-মায়েরা তিন চার জনে ভাগ হয়ে গ্রুপ করে এটা করতে হবে। একটা এক্সটেন্টেড ফ্যামিলি তৈরি করা এখন খুব জরুরি হয়ে গেছে এসব বাচ্চার জন্য। যে পরিবার একজনের বিপদে আরেকজন এগিয়ে আসবে। নয়তো এ সমস্যার সমাধান হবে না, এর কোনও বিকল্প নাই।’

এটা খুব বড় একটা যুদ্ধ- মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এসব বাচ্চাকে নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তাদের হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, মাস্ক পরার মতো স্বাস্থ্যবিধি শেখানো যাচ্ছে না।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষের যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. রিজওয়ানুল করিম শামীম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, গত মার্চে দুর্যোগকালীন সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য এবং মনোসামাজিক বিবেচ্য বিষয় নিয়ে পাঁচ ভাগে ভাগ করে গাইড লাইন করা হয়েছে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু এবং তাদের যারা দেখাশোনা করেন তাদের এই সময়ে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দেশের সব জেলার সিভিল সার্জনদের দেওয়া হয়েছে।

‘প্যারেন্টস ফোরাম ফর ডিফারেন্টলি অ্যাবল’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট সাজিদা রহমান ড্যানি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এমনিতেই এটা কঠিন সময় সবার জন্য। তার ওপর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এই মানুষগুলোর জন্য আরও কঠিন। তাই ভয়, উদ্বেগ, বিষণ্নতা বা অবসাদ থেকে তাদের দূরে রাখতে হবে, নিরাপদ রাখতে হবে। পরিবারের সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে যেকোনোভাবেই তারা ট্রমাতে না পড়ে যায়।’

সাজিদা রহমান ড্যানি বলেন, ‘মানসিক সুস্থতা এসময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু এবং বড়দেরও বিভিন্ন রকম কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রাখতে হবে, যেন তারা একাকিত্বে না ভোগে। তাদের জন্য একটি রুটিন ঠিক করে দিতে হবে। সে রুটিনে তারা যেন অভ্যস্ত হতে পারেন, সেজন্য তাকে সাহায্য করতে হবে।’

/এফএস/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভোট ছাড়াই চেয়ার দখল করতে বগুড়া চেম্বারের কার্যালয়ে তালা
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিভোট ছাড়াই চেয়ার দখল করতে বগুড়া চেম্বারের কার্যালয়ে তালা
ফিরে দেখা: ৩ জুলাই ২০২৪
ফিরে দেখা: ৩ জুলাই ২০২৪
টিভিতে আজকের খেলা (৩ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৩ জুলাই, ২০২৫)
কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় এনসিপির তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ
কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় এনসিপির তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ
সর্বাধিক পঠিত
নবম পে-কমিশন গঠনের কার্যক্রম শুরুর আশ্বাস অর্থ উপদেষ্টার
সংযুক্ত কর্মচারী প‌রিষ‌দের জরু‌রি সভানবম পে-কমিশন গঠনের কার্যক্রম শুরুর আশ্বাস অর্থ উপদেষ্টার
বরখাস্ত হলেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট তাবাসসুম ঊর্মি
বরখাস্ত হলেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট তাবাসসুম ঊর্মি
পরীক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তদন্তে কমিটি
পরীক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তদন্তে কমিটি
কার দোষে শ্রমবাজার বন্ধ হয় জানালেন আসিফ নজরুল
কার দোষে শ্রমবাজার বন্ধ হয় জানালেন আসিফ নজরুল
কেমন কেটেছিল ডিবি হেফাজতে ছয় সমন্বয়কের সাত দিন
কেমন কেটেছিল ডিবি হেফাজতে ছয় সমন্বয়কের সাত দিন