X
সোমবার, ২৬ মে ২০২৫
১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রতারণার যত ধরন

জামাল উদ্দিন
১৪ আগস্ট ২০১৭, ০৯:৫২আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৪৩

 

প্রতারণা

প্রতারকদের নিত্যনতুন কৌশলে ধরাশায়ী হচ্ছেন শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেকেই। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার চাকরিজীবীরাও এই প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে লাখ-লাখ টাকা খুইয়ে হয়েছেন। তারা সর্বস্বান্ত হওয়ার পর যখন ‍পুলিশের শরণাপন্ন হন, তখনই জানা যায়, প্রতারণার পিলে চমকানো সব কৌশল সম্পর্কে। এই বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে লেখালেখি করে সচেতনতা বাড়ানোরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট সূত্র জানায়, রাজধানীর একটি সরকারি কলেজের লেকচারার রাজিয়া খানমের কাছে হঠাৎ একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে। তিনি যে মোবাইল অপারেটরের সিম ব্যবহার করেন, সেই একই অপারেটরের নম্বর। ফোনের ওপাশ থেকে বলা হয়, ‘আমি কাস্টমার সার্ভিস থেকে বলছি। আপনার জন্য একটি সুখবর আছে। আমরা বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশনকৃত সিমের মধ্য থেকে একটি লটারি আয়োজন করেছি। আপনার নম্বরটি প্রথম পুরস্কার হিসেবে ২১লাখ টাকা জিতেছে।’ প্রথমে রাজিয়া বিশ্বাস না করলেও একপর্যায়ে প্রতারকদের কৌশলের কাছে হেরে যান। পর্যায়ক্রমে রাজিয়া লটারি জেতার আশায় প্রতারকদের হাতে সাড়ে সাত লাখ টাকা তুলে দেন। যখন বুঝতে পারলেন, তখন একরাশ হতাশা নিয়ে শরণাপন্ন  হন পুলিশের।

প্রতারকচত্রের কাছ থেকে উদ্ধার করা বিভিন্ন সরঞ্জাম গত ১৬ জুলাই ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দফতরে অভিযোগ দিতে এসে এক নারী ব্যাংক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি এক কোটি ৪২ লাখ টাকা লটারি জেতার খবর পাই। ওইদিন মোবাইল ফোনে রবি ফোন কোম্পানির ডিজিএম তুষার চৌধুরী পরিচয় দিয়ে আমাকে ফোন করে এক প্রতারক। আমি প্রথমে লটারি জেতার আশায় উইনার নম্বর রেজিস্ট্রেশনের জন্য তিন হাজার টাকা প্রতারকের দেওয়া বিকাশ নম্বরে পাঠাই। পরে লটারিতে পাওয়া টাকার টাকার ভ্যাট হিসাবে পাঠাই ১৪ হাজার টাকা। এরপর একে-একে এনবিআর, পার্লামেন্টের অনুমোদন, আমেরিকান পার্লামেন্টের পারমিশন, টিঅ্যান্ডটির ছাড়পত্র, বিটিসিএলের অনুমোদন, দুদকের তদন্ত, বিটিআরসির ক্লিয়ারেন্সসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার নামে আমার মোবাইলে এসএমএস আসতে থাকে। ইংরেজিতে লেখা ওইসব এসএমএসে রবি ফোন কোম্পানির কঠোর গোপনীয় রুলস মেনে চলার শর্ত দেওয়া ছিল। তিন মাসে ৪০ দফায় প্রায় ৫০টি ব্যক্তিগত বিকাশ নম্বরে ৪০ লাখ টাকা পাঠাই। এরপরও সেই পুরস্কারের চেকের টাকা তোলার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। এরইমধ্যে আরও টাকা দাবি করে প্রতারক চক্রটি। একপর্যায়ে আমার কাছে টাকা নেই বলার পর ওই প্রতারক বলে, আপনি তো ব্যাংকে চাকরি করেন। আপাতত ব্যাংক থেকেই টান দিয়ে পাঠিয়ে দেন। তখন আমার হুঁশ হয়, আমি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছি।’

গত তিন মাসে পাওয়া এক ডজন অভিযোগের তদন্তে মাঠে নামেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ। গত মাসের ১৭ তারিখে (১৭ জুলাই) প্রযুক্তির সাহায্যে এ ধরনের কয়েকজন প্রতারকের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় প্রতারক চক্রের আট সদস্যকে। তারা হচ্ছে, কামাল হোসেন, জাফর মুন্সী, মিলন শিকদার, আজিজুল হাকিম, তাপস সাহা, মানিক ওরফে বাবুল মুন্সী, বকুল মুন্সী ও ওলি মীর। তারা সবাই বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির কর্মকর্তা কিংবা কাস্টমার সার্ভিসের পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে বিশ্বাস অর্জন করে বিকাশের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। তাদের কাছ থেকে পুলিশ কর্মকর্তারা জানতে পারেন, প্রতারণার নানা কৌশল। কখনও কখনও তারা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ভাঙিয়ে, ভয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।

গত ২ আগস্ট আহসান হাবিব পেয়ার নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে ডিএমপির সিটিটিসির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের সদস্যরা। নামের সংক্ষেপ ‘এইচপিএইচ’ নামে একটি ইন্টারনেট-ভিত্তিক চ্যানেলও খুলে বসে পেয়ার। ওই ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে গরিব ও বিরল রোগের বিভিন্ন ভিডিও-চিত্র আপলোড করে সাহায্যের নামে প্রতারণা করে দীর্ঘদিন থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল পেয়ার। তার ছিল পর্নোসাইটও। তার বিষয়ে বলতে গিয়ে সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড সিকিউরিটি টিমের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. নাজমুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে প্রতারিত করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় সে। এক ডজনেরও বেশি প্রতারিত নারী-পুরুষের কাছ থেকে তার প্রতারণার অভিনব কৌশল সম্পর্কে জানা গেছে।’  

র‌্যাবের হাতে আটক প্রতারক চক্র (ছবি- সংগৃহীত) অনলাইন মাস্টার কার্ড (পাইওনিয়ার) প্রতারক দলের প্রধান রিয়াজুল ইসলাম তার ৫ সহযোগীকে নিয়ে বিভিন্ন ভুয়া নামে ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে ভুয়া পাইওনিয়ার প্রিপেইড মাস্টার কার্ড ইস্যু করে বিক্রি করে আসছিল। গত ৮ আগস্ট রাজধানীর হাজারীবাগের একটি বাড়ি থেকে তাদের গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) আর্থিক ক্রাইম ইউনিটের সদস্যরা।

ডিএমপির জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতারণার কৌশলের কোনও অভাব নেই। প্রতারকরা ইমেইল কিংবা মোবাইলে ম্যাসেজ দেয়। যে আপনি পুরস্কার কিংবা লটারি জিতেছেন। আবার দেখবেন ইমেইল হ্যাক করে আপনার পরিচিত বা নিকটজনকে মেইল পাঠানো হয় যে, আমি খুব বিপদে আছি। বিদেশে আছি। আমার কাছে কোনও টাকা-পয়সা নেই। আমাকে কিছু ডলার পাঠান। এসব মোবাইলের এসএমএস ও ইমেইলে সাড়া দিলেই বিপদে পড়লেন। তারা সর্বস্বান্ত করে দেবে। বিকাশের মাধ্যমে নানাভাবে প্রতারণা করে থাকে তারা। ভুলে টাকা পাঠানো হয়েছে বলে ফেরত চাওয়া হয়। লাখ লাখ টাকা ও গাড়ি পুরস্কারের কথা বলে প্রতারণা করা হয়। আবার শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কথা বলে চাঁদাবাজি করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘এ থেকে বাঁচতে হলে লোভ সংবরণ করতে হবে। সচেতন থাকা ছাড়া কোনও উপায় নেই। আর এমন কিছু হলে নিকটজনকে জানানোসহ পুলিশের সাহায্য নেওয়া উচিত। তাহলেই প্রতারণা থেকে বাঁচা সম্ভব হবে।’

প্রতারণার কয়েকটি ধরন সম্পর্কে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তুলে ধরেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। ‘পুলিশের সঙ্গে কারও বন্ধুত্ব হয় না, মানুষ বোধহয় যথার্থই বলে। ছালাম সাহেবের মনে হয় তিনি পুলিশকে বিপদের কথা জানিয়ে ফেঁসে গেছেন...’ ও ‘হ্যালো, সুব্রত বাইন বলছি’ শিরোনামে প্রতারণার দু’টি গল্প ফেসবুক স্ট্যাটাসে তুলে ধরেন তিনি।

প্রতারকদের হাত থেকে প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘সন্ত্রাসী পরিচয় দিয়ে ফোনে চাঁদা চাইলে ঘাবড়ানোর কোনও কারণ নেই। ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলুন, চাঁদার অঙ্ক কমাতে দর কষাকষি করুন। প্রয়োজনে ধমক দিন। ধমক দিলে গালি দিতে পারে। গালি দেওয়ার অভ্যাস থাকলে আপনিও পাল্টা গালি দিতে পারেন। ওরা যখন বুঝে যাবে আপনি ভয় পাচ্ছেন না, তখন আর আপনাকে ফোন দেবে না। তারা আপনার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। তারা সন্ত্রাসী নয়, পেশাদার প্রতারক।’ তিনি বলেন, ‘সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম শাখা আপনাকে প্রতিকার দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। গোয়েন্দা শাখায়ও জানাতে পারেন। তারাও আপনাকে সাহায্য করবে। বন্ধু না মনে করলেও এটুকু বিশ্বাস রাখতে পারেন, পুলিশ আপনার শত্রু নয়।’

মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই প্রতারককে খুঁজে বের করা খুব কঠিন কাজ। আবার প্রতারক ধরা পড়লেও সাজা নিশ্চিত করা আরও কঠিন। টাকা ফেরত পাওয়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসম্ভব। তাই সতর্ক থাকুন। আপনার সচেতনতায় প্রতারক তার পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হবে।’

/এমএনএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পুতিনকে ‘উন্মাদ’ বললেন ট্রাম্প
ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্ববৃহৎ হামলাপুতিনকে ‘উন্মাদ’ বললেন ট্রাম্প
আজও সচিবালয়ে সমাবেশ করবেন কর্মচারীরা
আজও সচিবালয়ে সমাবেশ করবেন কর্মচারীরা
মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আ.লীগ নেতা, এসিল্যান্ডের দুঃখ প্রকাশ
মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আ.লীগ নেতা, এসিল্যান্ডের দুঃখ প্রকাশ
যুবলীগ নেতা ডাবলু রিমান্ডে
যুবলীগ নেতা ডাবলু রিমান্ডে
সর্বাধিক পঠিত
সোমবার থেকে বন্ধ থাকবে সব ধরনের আমদানি-রফতানি
সোমবার থেকে বন্ধ থাকবে সব ধরনের আমদানি-রফতানি
রাস্তার পাশাপাশি মেট্রোস্টেশনে আন্দোলনকারীদের অবস্থান, ভোগান্তিতে যাত্রীরা
রাস্তার পাশাপাশি মেট্রোস্টেশনে আন্দোলনকারীদের অবস্থান, ভোগান্তিতে যাত্রীরা
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ জারি
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ জারি
বাংলাদেশসহ একাধিক দেশে সামরিক উপস্থিতি বিবেচনা করছে চীন: যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশসহ একাধিক দেশে সামরিক উপস্থিতি বিবেচনা করছে চীন: যুক্তরাষ্ট্র
বিক্ষোভে উত্তাল সচিবালয়
বিক্ষোভে উত্তাল সচিবালয়