যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপজুড়ে ভালো নেই বাংলাদেশি অভিবাসীরা। চলমান জঙ্গিবাদ ইস্যুতে কিছু বাংলাদেশির সম্পৃক্ততার অভিযোগ, ইউরোপের দেশে দেশে ইমিগ্রেশনের কড়াকড়ি, ব্রেক্সিট ইত্যাদি অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে কঠিন করে দিয়েছে এখানকার অভিবাসীদের জীবনধারা।
বিশেষ করে গত এক দশকে যারা ইউরোপে অভিবাসী হয়েছেন, তারা নতুন করে প্রবর্তিত বিভিন্ন আইনের বেড়াজালে আটকা পড়েছেন। স্থায়ী হতে তাদের পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ। অনেকে দশ বছর ইউরোপের দেশে দেশে ঘুরেও স্থায়ী হতে না পেরে নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছেন।
ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত তোজাম্মেল হক রবিবার (১৭ ডিসেম্বর) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইউরোপের দেশে দেশে অভিবাসন নীতিতে কড়াকড়ি আরোপ, মুসলমান ও জঙ্গিবাদ ইস্যু, ইউরোপজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দায় জীবনমানের গতিও এখন পড়তির দিকে। নতুন করে আসা অভিবাসীরা এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন।’
ইটালিতে প্রায় তিন দশক ধরে আছেন এমদাদুল হক এমদাদ। কাজ করছেন একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে। সোমবার সকালে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইটালিয়ান শ্বেতাঙ্গরাই এখন কাজের খোঁজে অন্যদেশে ছুটছে। গত পাঁচ বছরে কয়েক হাজার বাংলাদেশি ইটালিয়ান পাসপোর্টধারী উন্নত জীবনের আশায় ইটালি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাজ্যে। ইটালিতে গত পাঁচ বছরে বাড়ি ঘরের দাম কমেছে অর্ধেকের বেশি। এর মূল কারণ অর্থনৈতিক মন্দা।’ তিনি যোগ করেন,‘ ইটালিকে আগে অভিবাসনের সহজ প্রক্রিয়ার জন্য অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের স্বর্গরাজ্য ভাবা হতো। এখন সেখানেও অনেক কড়াকড়ি শর্তারোপ এসেছে।’
জার্মানির বন শহরে বসবাস করছেন মৌলভীবাজারের একসময়ের সংস্কৃতিকর্মী খন্দকার খালিকুর রহমান। তিনি বলেন,‘জার্মানি গত কয়েক বছরে বিপুল সংখ্যক অভিবাসীকে আশ্রয় দিলেও সেখানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা খুবই কম।’
ফ্রান্সে বসবাসকারী হবিগঞ্জের মহসীন আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘২০০৪ সালে ওয়ার্ক পারমিটে যুক্তরাজ্যে এসেছিলাম। দুই বছর পর ওয়ার্ক পারমিবটের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তারপর কেন্টের ডোভার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ফ্রান্স হয়ে বেলজিয়ামে চলে যাই। সেখানে আন্ডার এজের কেস ( অ্যাসাইলাম) করার পর বৈধভাবে বসবাসের সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু তখন প্রচুর পরিমাণে একই ধরনের আবেদনের কারণে সেদেশের সরকারের সন্দেহ হয়। তারা ব্রিটেন থেকে কয়েক লাখ ‘ব্রিটেনে নিখোঁজ’ অবৈধ ইমিগ্রান্টের ফিঙ্গার প্রিন্টের ডেটাবেজ বেলজিয়ামে নিয়ে আসে। সেখানে আমরা যারা ব্রিটেন থেকে পালিয়ে এসেছিলাম তাদের ফিঙ্গার প্রিন্ট মিলে যায়। আমাদের আগের পাসপোর্ট আর ইমিগ্রেশনের সব তথ্য তখন ধরা পড়ে যায়। ত্রিশ দিনের মধ্যে বেলজিয়াম ছাড়ার শর্তে ব্রাসেলসের আদালত আমাদের জামিনে মুক্তি দেয়। তখন সীমান্তপথে পালিয়ে আসি ফ্রান্সে। সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করি। বছর খানেকের মাথায় শুনতে পাই যে, পতুর্গালে সহজ নিয়মে চার বছরে মিলছে বৈধভাবে বসবাসের সুযোগ। এরপর ২০১৫ সালে পতুর্গালে যাই। তিলে তিলে জমানো সঞ্চয়ের পাঁচ হাজার ইউরো খরচ করে সেদেশের ট্যাক্স সনদ (অতীতে বসবাসের জাল প্রমাণপত্র) দেখিয়ে আবেদন করি। কিন্তু পতুর্গাল সরকার গত বছর (২০১৬) নতুন করে কড়াকড়ি আরোপ করলে ফিরে ফ্রান্সে চলে আসি। এখানে আবারও অ্যাসাইলামের জন্য আবেদন করবো কিনা বুঝতে পারছি না। জীবনের একযুগ কেটে গেছে ইউরোপে। কিন্তুা এখনও পুলিশ বা ইমিগ্রেশনের লোক দেখলে চোরের মতো পালিয়ে বাঁচতে হয়। কী করবো, দেশে ফেরারও উপায় নেই। হাতে কোনও পুঁজি নেই। বিয়ে বা সংসার করারও বয়স নেই।’
যুক্তরাজ্য যুবলীগ নেতা জারমাল আহমদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘এ সরকারের আমলে অনেকে লন্ডনে ভিজিটে এসে ‘জামায়াত নেতা’ সেজে অ্যাসাইলাম পাচ্ছেন। ‘জামায়াত ও সেভ বাংলাদেশ’ তাদের দলের নির্যাতিত কর্মীদের প্রত্যয়নপত্র দিচ্ছে। সব সরকারের আমলে কিছু মানুষ নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণের মিথ্যা অভিযোগ তুলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নির্যাতিত সাংবাদিক,রাজনৈতিক নেতা সেজে অ্যাসাইলামের আবেদন করে। এতে করে বিশ্বপরিসরে আসলে দেশের ভাবমুর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’'
ব্রিটেনে বসবাসকারী লেখক, সমাজকর্মী ড. রেনু লুৎফা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্রেক্সিট ঘোষণার আগে আমরা কেমন ছিলাম, বিশেষ করে আমরা বাংলাদেশিরা। আমাদের শিক্ষাদীক্ষা অন্যান্য জাতির চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম। আমাদের মধ্যে যারা সঠিক কাগজপত্র ছাড়া বৃটেনে আছেন, তাদের বেশিরভাগই আগে বাংলাদেশি
রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। কিন্তু ইমিগ্রেশনের কঠিন আইনে তা আরও কঠোর হয়ে উঠছে। বেআইনি লোককে কাজ দিলে মালিকের জরিমানা করা হচ্ছে। ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট ২০১৬-তে শর্ত আরও কঠিন করা হয়েছে। কাগজপত্র বিহীন লোকজনের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্স বন্ধ রয়েছে। ইলিগ্যাল ইমিগ্র্যান্টদের ফেরত পাঠানো সহজ করা হয়েছে। আইনি সহায়তা পাওয়া অসম্ভব করা হয়েছে।’
ড. রেনু লুৎফা আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ ক্যাটারার অ্যাসোসিয়েশনের স্লোগান ছিল- বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টের ভ্যাট হার কমিয়ে আনা। বিষয়টি হাস্যকর ছিল। তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন রাষ্ট্রীয় আইন সবার জন্য সমান। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা দেশ থেকে কর্মী আনতে চান। সরকার তাদের সেই সুবিধা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা সেই আইনের অবমাননা করতে থাকেন। সত্যিকারের কর্মী না এনে তারা আদম ব্যবসা শুরু করেন। অতীতেও সত্যিকারের কোনও শেফ আনা হয়নি ।’
তিনি বলেন, ‘ব্রেক্সিট ভোটের আগে আমাদের কিছু কিছু সমাজপতি প্রচার শুরু করলেন, ইউরোপ থেকে বের হলে কমনওয়েলথভুক্ত দেশ থেকে তারা মানুষ আনার সুযোগ পাবেন। অনেকেই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করলেন- ইউরোপিয়ানরা চলে গেলে তাদের বেকার ভাতাসহ যাবতীয় সুবিধার হার বেড়ে যাবে। তারা বুঝতে ব্যর্থ হলেন, পার্লামেন্টে যে আইন পাস করা হয়েছে, তার কোনও হের ফের হবে না। যদি প্রশ্ন করা হয় অভিবাসীরা কেমন আছেন? তবে সোজা জবাব, যারা এদেশের সুযোগ-সুবিধার সদব্যবহার করছেন, শিক্ষা ও যোগ্যতা দিয়ে নিজেদের ভাগ্য বদলেছেন, তারা ভালোই আছেন। কিন্তু যারা শুধুমাত্র সরকারি বেনিফিট পাওয়ার আশায় ছিলেন তাদের আশায় বালি পড়েছে। শুধু ব্রিটেন নয়,ইউরোপের দেশে দেশে সরকারের বাজেট কমিয়ে আনা হয়েছে। সে কারণে মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে।’