‘আমার হাত তো ভালো হয়নি কো। ডাক্তাররা ছুটি দিছে তাই বাড়ি যেতেছি। বাড়িত গিয়ে থাকবো। বোনের সঙ্গে খেলবো। আশেপাশের মানুষের সঙ্গে কথা বলবো।’ শুক্রবার (২২ ডিসেম্বর) সকাল সাতটায় হাসপাতাল ছাড়ার আগে বাংলা ট্রিবিউনকে এসব কথা বলে রক্তনালীর টিউমারে আক্রান্ত মুক্তামনি।
হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার সময় মুক্তামনি কিংবা তার মা-বাবা কারও মুখে কোনও হাসি ছিল না। মলিন মুখে সবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পর মুক্তামনিকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন তারা।
যাওয়ার আগে মুক্তামনি বলে, ‘আমার চিকিৎসা করার জন্য ডাক্তারদের ধন্যবাদ জানাই। আমি বাড়িতে গিয়ে ভালো থাকতে চাই। আপনারা সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চিকিৎসার খোঁজ-খবর ও দায়িত্ব নেওয়ায় তাকেও ধন্যবাদ জানায় সে। বলে, ‘আমার চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই।’
সকাল ছয়টার দিকে মুক্তামনির মা আসমা খাতুন বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাগ গোছানো শুরু করেন। মুক্তামনির ছোট ভাইটির রাত থেকে জ্বর। তাই সে ছিল ভীষণ অস্থির। আসমা খাতুন জানালেন, ‘যেদিন আমরা মুক্তামনিকে নিয়ে হাসপাতালে আসি, সেদিনও ছেলের গায়ে জ্বর ছিল। আজ (শুক্রবার) বাড়ি যেতেছি (যাচ্ছি), আজও ছেলের গায়ে জ্বর।’
মুক্তামনি বলে, ‘আমার জন্য ডাক্তারদের যা করার তারা তা করেছে। তাদের যদি আরও কিছু করার থাকতো তাহলে করতো।’
মা আসমা খাতুন বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি ওর জন্য ডাক্তারদের আর কিছু করার নেই, থাকলে তারা করতো। তাদের আন্তরিকতার কোনও ঘাটতি দেখিনি।’
মুক্তামনির বাবা ইব্রাহীম হোসেন বলেন, ‘আপনারা সবাই আমার মেয়ের জন্য দোয়া করবেন।’
সকাল সাতটার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের ৬০৯ নম্বর কেবিন থেকে হাসপাতালের আয়া শান্তির সঙ্গে ট্রলিতে করে বেরিয়ে আসে মুক্তামনি। এর আগে তাকে বিদায় জানান ডিউটিরত চিকিৎসক ডা. সোনিয়া। ট্রলি চলতে শুরু করার পর মুক্তামনির মা আসমা খাতুন একটু থামতে বলেন। ৬০৪ নম্বর কেবিনের এক আপা (রোগী) হাঁটতে পারেন না। তিনি মুক্তামনিকে দেখতে চেয়েছেন। তাই তার কেবিনের সামনে গিয়ে ট্রলি থামে। তিনি (ওই রোগী) নিজের বেডে শুয়েই মুক্তামনিকে একনজর দেখেন। হাত তুলে ইশারা করে বলেন, ‘আল্লাহর কাছে দোয়া করি মা, তুমি ভালো হয়ে যাবে।’
নিচে নেমে এসে পুরো পরিবারটি যখন অ্যাম্বুলেন্সে উঠে বসলো, তখনও সূর্য ওঠেনি। পৌষের সকালের কুয়াশায় আচ্ছন্ন ছিল ঢামেক চত্বর। সেখানে উপস্থিত রোগীদের আত্মীয়-স্বজন অ্যাম্বুলেন্সের কাছে এসে ভিড় করে। সবাই বলতে থাকেন-মুক্তামনি বাড়ি চলে যাচ্ছে। এসময় মুক্তামনির বাবা বলেন, ‘বাড়ি যাচ্ছি, তবে ডাক্তাররা একমাস পরে দেখা করতে বলেছেন। একমাস পরে আবারও আসবো।’
মুক্তামনি তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার সদর উপজেলার দক্ষিণ কামারবাইশা গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। সেখানে গিয়ে সে এবার তার দাদাকে দেখতে পাবে না। গত জুলাই মাসে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান দাদা এজাহার আলী গাজী। বাড়িতে এখন দাদি সালেহা খাতুন আর ছোটবোন হিরামনি আছে।
মুক্তামনি যখন হাসপাতালে ভর্তি হয়, তখন ওর ইচ্ছে ছিল চিকিৎসা শেষ করেই বাড়ি ফিরে গিয়ে আবারও স্কুলে ভর্তি হবে। তারপর টানা ছয় মাসের চিকিৎসা ও অপারেশন শেষে মুক্তামনির হাত স্বাভাবিক হয়নি। তাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার স্বপ্নও আপাতত পূরণ হচ্ছে না। বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসকদের দেওয়া ওষুধগুলো নিয়মিত খেয়ে যেতে হবে তাকে।
মুক্তামনির বাড়ি ফেরা প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়কারী ডা.সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘মুক্তামনি বাড়ি যাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। তাই ওকে বাড়ি যেতে বলেছি। যাক কিছুদিন বাড়িতে ঘুরে আসুক। সে তো পুরোপুরি সুস্থ হবে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি।’
মুক্তামনি এ বছরের ১২ জুলাই ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হয়। তার মা-বাবা মেয়েকে সুস্থ করার জন্য স্থানীয় এবং ঢাকার অনেক চিকিৎসকের কাছে গেছেন। কিন্তু কোনও চিকিৎসকই তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে রাজি হননি। এরপর বেশ কিছুদিন বাড়িতেই ছিল সে। তাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর ঢামেক বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট মুক্তামনির চিকিৎসার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে। পরবর্তীতে সেখানে চিকিৎসা নেবার সুযোগ হয়। এসময় তার উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে যোগাযোগ করেন চিকিৎসকরা। সব রিপোর্ট দেখার সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরা মুক্তামনির চিকিৎসা করতে অস্বীকৃতি জানান। পরে ঢামেকের চিকিৎসকরাই তার অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন। এরইমধ্যে মুক্তামনির চিকিৎসার সব ধরনের খরচের দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মুক্তামনির হাতে ৫ আগস্ট প্রথম অস্ত্রোপচার হয়। এসময় তার হাতের ফোলা ভারি অংশ অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেন চিকিৎসকরা। পরে দুই পায়ের চামড়া নিয়ে দু’দফায় তার হাতে লাগানো হয়। তার হাতের ওজন কমলেও হাত স্বাভাবিক হয়নি। সে এখনও হাতের ভারে হাঁটতে পারে না।
ঢামেকের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালামের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ একদল চিকিৎসক মুক্তামনির স্কিন গ্রাফটিং (চামড়া লাগানো) অপারেশনে অংশ নেন। পরে মুক্তামনির হাত আবারও ফুলে যায়। ফোলা কমানোর জন্য হাতে প্রেসার ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন চিকিৎসকরা।