‘প্রতিটি নারীর ভেতরে একটা অসম্ভব ধরনের শক্তি আছে। সেটা কাউকে না কাউকে উন্মুক্ত করে দিতে হয়। শক্তিটাকে তার চোখের সামনে নিয়ে আসতে হয়। নারী যে নিজেই একটা বড় শক্তি সে জিনিসটা যখন সে বুঝে যায়, তখন তার কাছে কোনও কাজই আর কঠিন মনে হয় না, দুরূহ থাকে না। শিক্ষিত হোক আর নিরক্ষর হোক সে এগিয়ে যেতে পারে।’ দেশের সিটি করপোরেশনগুলোর মধ্যে পরপর দু’বার নির্বাচিত একমাত্র নারী মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলা ট্রিবিউনকে এসব কথা বলেন।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জে সিটি করপোরেশন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনের কথা হয়। রাজনীতি ও নগর কর্তৃপক্ষ পরিচালনায় নিজের সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন তিনি। সব নারীর জন্য নিজের স্বপ্নের কথা বলেন।
বাংলা ট্রিবিউন: বাংলাদেশের ১১টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে একমাত্র নারী মেয়র আপনি। নারী হিসেবে কাজের ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হয়?
মেয়র আইভী: এই ক্ষেত্রে আমার কোনও সমস্যা হচ্ছে না। আমার মনে হয়, যে কোনও কাজেই বাধা আসাটা স্বাভাবিক। ভালো কাজে বাধা আসবেই। এটা নারী মেয়রই হোক আর পুরুষ মেয়রই হোক। আমি মনে করি অনেক পুরুষ মেয়রের চেয়েও বেশি বাধা-বিপত্তির মধ্যে নারায়ণগঞ্জের মতো জায়গায় কাজ করে যেতে পারছি। আমার কাছে এমন কিছু মনে হয়নি যে শুধু নারী হিসেবেই প্রতিহিংসার শিকার হয়েছি। প্রথমদিকে মানুষ ভাবতো একজন নারী হিসেবে আমি দক্ষ কিনা। এ রকম চিন্তা-ভাবনা হতো। তবে এই মুহূর্তে ১৪ বছর পরে বলতে পারবো, নারায়ণগঞ্জের মানুষ একবাক্যে স্বীকার করবেন, আমি কাজে দক্ষ। আমার কাজে কোনও ত্রুটি আছে, আমার অযোগ্যতা আছে, পারবো না- এমনটা মনে হয় কেউ ভাবেন না।’
বাংলা ট্রিবিউন: আপনাকে দেখে দেশের নারীরা এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। পিছিয়ে পড়া বা নিযার্তিত নারীরা কীভাবে এগিয়ে আসতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
মেয়র আইভী: নির্যাতনের শিকার নারীদের সহায়তার জন্য আমার সিটি করপোরেশনে একটা প্রজেক্ট আছে। সেটি দিয়ে শুরু করতে চাই। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বা অবহেলিত নারীরা কীভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে, কীভাবে তারা এখন নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখেছে, কীভাবে সমাজে এগিয়ে যাচ্ছে তা অন্যদের জানাতে হবে। পড়াশোনা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে যারা লেখাপড়ার সুযোগ পাননি তারা কীভাবে এগিয়ে যাবেন সে বিষয়ে ভাবতে হবে। এই কাজটি আমি নারায়ণগঞ্জে করতে পেরেছি বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীদের কীভাবে সামনে নিয়ে আসা যায়, তাদের কীভাবে স্বাবলম্বী করা যায়, নিজেদের সবল মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখানো যায়, এই কাজটি আমি করেছি । আমার এখানে প্রায় ৭০ হাজার নারী এবং শিশু এই সেবাটা পাচ্ছে। উদ্বুদ্ধ করার কাজটি আমি করার চেষ্টা করেছি, করে যাচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও করে যাবো।’
বাংলা ট্রিবিউন: দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনও নিজেকে অসহায় মনে হয়েছে?
মেয়র আইভী: অনেক আগে মাঝে মধ্যেই এরকম অসহায় লাগতো। আমি পরপর দুবার সিটি মেয়র হওয়ার আগে তদানীন্তন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলাম। ২০০৩ সালে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব নেই, ওই সময়গুলোতে নিজেকে অনেক ক্ষেত্রেই অসহায় মনে হয়েছে। তখন প্রচুর বাধা-বিপত্তি ছিল। আমি এই জায়গাটিতে অন্য পেশা থেকে নতুন এসেছিলাম। তবে এতো বেশি বাধা, সমস্যা, সংকট ছিল যে এগুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক বড় বড় জটিলতা মোকাবিলা করেছি। কিন্তু,খুব বেশিদিন এই অবস্থা ছিল না। দুই-তিন বছরের মধ্যেই আমি আমার নিজস্বতা দিয়ে চেষ্টা করেছি সব কাজ করার। এখন আমার কোনও সমস্যাকেই কিছু মনে হয় না। কাজে তো বাধা আসবেই। সমস্যা শুধু নারী বলেই আসে না। আমি যখন এখানে কাজ করি এটা মাথার মধ্যে রাখি না যে আমি একজন নারী। আমি সব সময় মনে করি আমি একজন লিডার, আমাকে মানুষ ভোট দিয়েছে, তাদের সেবা করার জন্য আমি এখানে। সেই ক্ষেত্রে মনে করি আমি একজন মানুষ। মানুষ হিসেবে আমার যতটুকু করণীয়, আমি সেটা করার চেষ্টা করি।’
‘অবশ্যই আমি একজন নারী। আমি একজন মা। আমি যখন বাড়িতে যাই তখন আমি অবশ্যই চিন্তা করি, আমার বাচ্চা কী খাচ্ছে, বাচ্চা কী করবে। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে কখনও আমার মধ্যে নিজেকে নারী হিসেবে আলাদা করে ভাবার কথা মাথায় আসে না। আমি সব সময় চেষ্টা করি যে কোনওভাবে আমার কাজগুলো করে যেতে।’
বাংলা ট্রিবিউন: উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছেন কীভাবে?
মেয়র আইভী: এ বিষয়ে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেন নারায়ণগঞ্জের জনগণ। আপনারা দেখেছেন, গত ১৪ বছরে নারায়ণগঞ্জের এমন কোনও উন্নয়ন কাজ নেই যেখানে আমি বাধা বিঘ্ন পাইনি। সেই বাধাগুলো অতিক্রম করার জন্য সাধারণ মানুষ এগিয়ে এসেছে। তাদের সহযোগিতা নিয়েই কিন্তু সেই বাধাগুলো অতিক্রম করেছি, প্রতিটি উন্নয়ন কাজ আমি সফল হয়েছি।
বাংলা ট্রিবিউন: রাজনীতিতে আসা নারীদের জন্য আপনার কোনও পরামর্শ আছে?
মেয়র আইভী: আসলে পরামর্শ নয়। আমি এভাবে বলি যে নারীরা যদি সঠিক পথটা পায়, তাদের যদি পরিবার থেকে উদ্বুদ্ধ করা হয়, তাহলে তারা কিন্তু অনেক ভালো কাজ করে। আপনারা খেয়াল করে দেখবেন,একজন নারী যখন কোথাও বা যে কোনও প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ পর্যায়ে কাজ করছেন, সেই প্রতিষ্ঠান খুব ভালো করছে। নারীরা প্রচণ্ড পরিশ্রমী। নারী ঘরে-বাইরে সব ক্ষেত্রে প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে পারে। সততা তাদের মধ্যে অনেক বেশি। কারও করুণা নয়, নারী তার যোগ্যতা দিয়েই নিজ নিজ ক্ষেত্রে জায়গা করে নেবে, শুধু সুযোগ দিতে হবে। আমি আশাবাদী,বাংলাদেশে রাজনীতিসহ সবক্ষেত্রে নারীরা আরও এগিয়ে যাবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।’