সমাজ ও পরিবারের নৈতিকতাবোধ ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নৈতিকতা গঠন, শিক্ষা ব্যবস্থা ও জ্ঞান চর্চা বাধার মুখে পড়েছে, যে কারণে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের প্রবণতা বেড়ে গেছে বলে ‘এডুকেশন ওয়াচ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
‘এডুকেশন ওয়াচ-২০১৭’ প্রোগ্রামের আওতায় ‘বিদ্যালয়ে নৈতিকতা মূল্যবোধ: শিক্ষায় প্রাণের উজ্জীবন’ শীষর্ক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন এসব কথা বলা হয়েছে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের নির্দেশাত্মক আদেশ-নিষেধের পরিবর্তে নৈতিক ও মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করতে কর্মসুচি গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে।
বুধবার (৯ মে) বিকালে রাজধানীর এলজিআরডি ভবনে গণসাক্ষরতা অভিযানের উদ্যোগে করা এই গবেষণার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। উক্ত গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন ব্র্যাকের এমিরেটাস অধ্যাপক এবং ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০১৭’ এর প্রধান গবেষক মনজুর আহমেদ।
গবেষণাটি সম্পন্ন করতে দেশের আটটি বিভাগের ৬৪টি সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয় জরিপ করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ও সরকারি ব্যবস্থাধীন প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসাকে নমুনা হিসেবে নেওয়া হয়েছে। ওই সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক ও স্কুল কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে একটি মূল্যবোধ জরিপপত্রের সাহায্যে ১৪শ’ শিক্ষার্থী, ৫৭৬ শিক্ষক ও ১২শ’ ৮০ স্কুল কমিটির সদস্য ও অভিভাবকের মতামত সংগ্রহ করা হয়েছে।
এ প্রতিবেদনের সুপারিশমালায় শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়া, বিদ্যালয় পরিবেশ ও সংস্কৃতি, বিদ্যালয়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মূল্যবোধ পরিলেখের তাৎপর্য; এই চার ধাপকে উল্লেখযোগ্য ধরে ১৬টি ধাপে সুপারিশ করা হয়েছে।
এর মধ্যে শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়া ধাপের সুপারিশে বলা হয়েছে, শিখন বা শেখানো পদ্ধতি অতিমাত্রায় তত্ত্বীয় ও নির্দেশনাত্মক ধরণ। শিক্ষক নির্ভর বিদ্যালয় সংস্কৃতির বহুল আলোচিত সমস্যা। শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার্থী নিজে নিজে পড়ে বোঝার সুযোগ কম। শিক্ষার্থীরা অতিমাত্রায় শিক্ষকদের প্রতি দারস্থ হচ্ছে এবং এর সুযোগ কাজে লাগিয়ে শিক্ষকরা নৈতিকতা হারিয়ে ফেলছে। এসব থেকে বের হয়ে আসার জন্য নৈতিকতা, মূল্যবোধ শিক্ষার বিষয়বস্তুকে শিখনের মধ্যে অন্তভুর্ক্ত করা, শিখনকে সুগভীর ও সুদৃঢ় করা এবং তাদের অর্জিত শিক্ষা বাস্তব জীবনে অনুশীলন করার ব্যবস্থা করতে বিদ্যালয়ে সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ ও সুপারিশ করা হয়েছে।
আরও বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র ধর্মীয় পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে বিদ্যালয়ে যে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক ঐক্য ও সংহতির মনোভাবের পরিবর্তে বিভেদ ও ভিন্নতা উপলব্ধি লালনে সহায়তা করে। শিক্ষক প্রশিক্ষণে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং সামাজিক ও আবেগিক বিকাশের ক্ষেত্রসমূহে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ফলে বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ এ কমিউনিটিতে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ অনুশীলনের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
বিদ্যালয় পরিবেশ ও সংস্কৃতি ধাপের সুপারিশে বলা হয়েছে, অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষকদের যোগাযোগ সুদৃঢ়করণ, শিশুকাল থেকেই একজন শিক্ষার্থীকে ন্যায়-নীতি শিক্ষার সূচনা করতে হবে, বিদ্যালয়কে গর্বের স্থান হিসেবে গড়ে তোলাসহ সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের যথার্থ প্রসার ঘটাতে কাজ করা প্রয়োজন।
বিদ্যালয়ের সামাজিক প্রেক্ষাপট ধাপে বলা হয়েছে, শিক্ষকতা পেশা সম্পর্কে সমাজের কাছে ইতিবাচক মনোভাব তৈরিতে সমাজকই ইতিবাচক ভুমিকা রাখতে হবে। তরুণরা যাতে এই পেশায় আসতে পারে তার জন্য করণীয় ঠিক করতে হবে। মূল্যবোধ অবক্ষয় রোধে কাজ করতে হবে, অপরাধীচক্র, মাদকাসক্তি ও জঙ্গিবাদের প্রতিরোধে সংঘবদ্ধ হতে হবে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নৈতিকতা-মূল্যবোধ জাগ্রত করতে কাজ করা প্রয়োজন।
সর্বশেষ ধাপ মূল্যবোধ পরিলেখের তাৎপর্যে বলা হয়েছে- বিদ্যালয়ে মূল্যবোধের চর্চা, নৈতিকতার দ্বন্দ্ব মোকাবিলা, শিশুদের আদর্শবাদে উৎসাহদান ও আদর্শ শিক্ষক তৈরিতে সহায়তার কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
গবেষণায় বলা হয়েছে, দশ লাখ মানুষ শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। আগামী এক দশকে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষ ও এর বাহিরে অসংখ্যা শিশু-কিশোরের জীবনকে স্পর্শ করে। তাদের দেখেই বর্তমান শিশুরা এ পেশায় আসার অনুপ্রেরণা পাবেন কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো চিত্র উঠে এসেছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘স্কুলে স্কুলে শুধু সুবিধা বাড়ালেই মানুষের মূল্যবোধ বাড়বে না। এ জন্য মানুষের ভেতর থেকে তা জাগ্রত হতে হবে।’ এক উদাহরণ টেনে তিনি আরও বলেন, ‘আগের দিনের শিক্ষকদের দেখলে আমরা এখনও শ্রদ্ধা করি, কারণ তাদের ভিতরে নৈতিকতা বোধের অভাব ছিল না। কিন্তু এখনকার শিক্ষকরা তাদের নৈতিকতা মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলছে, তাই তাদের মানুষ সেভাবে সম্মান করেন না।’
মন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষকরা এখন ক্লাসে না পড়িয়ে শিশুদের কোচিংয়ে পড়তে বাধ্য করে। এতে সে ব্যবসায়ীক ফায়দা লুটে নেয়। এসব কারণে শিক্ষকদের মূল্যবোধের জায়গা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সমাজ তাদের আর মূল্য দেয় না।’
গবেষণা বিশ্লেষণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘শুধু পাঠ্যপুস্তকে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে শিশুদের তা শেখানো যাবে না। এজন্য দরকার সমাজ ও মানুষের চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন। আগে নিজেকে ঠিক হতে হবে, পরে অন্যকে ভালো হওয়ার পরামর্শ দেওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের সমাজে তার উল্টো ঘটনা ঘটছে।’
এই গবেষণা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গবেষণাটিতে যা উঠে এসেছে তা মোটামোটি পুরাতন। আমরা অনেক কিছু আগে থেকেই জানি। নতুন কিছু আসেনি। তবু এটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করবে সরকার। কারণ, এটাতে খুব ভালো কিছু দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী’র সঞ্চালনায় এসময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা আহসানিয়া মিশনের সভাপতি কাজী রফিকুল আলম, ব্রিটিশ হাই কমিশনের বাংলাদেশের ডিএফআইডি প্রধান জানে এডমনসন প্রমুখ।