তাদের জন্ম ছেলে তথা পুরুষ হিসেবে, কিন্তু আচরণ বা বেশভূষা নারীর মতো। পুরুষ হয়েও তাদের শরীরে বাসা বেঁধেছে নারীর মন। তারা নিজেকে নারী ভাবেন, নারীদের পোশাক পরেন, সাজেন, পুরুষকে সঙ্গী হিসেবে পেতে চান। বলছি হিজড়াদের কথা।
সম্প্রতি একাধিক হিজড়ার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল— পুরুষ হলেও তারা হিজড়া মানসিকতার। হিজড়া পরিচয়ে তারা নিজেকে নারী ভাবতে, পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। পুরুষের শরীর হলেও আসলে নারীর মতো মন তাদের।
আঁখি হিজড়া, অনন্যা বণিক, মিতুল, শাম্মী হিজড়া, মণিষা হিজড়া, শোভা সরকার প্রমুখের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল— তারা সবাই পুরুষ। হিজড়া জীবনের আকর্ষণে তারা ঘর-বাড়ি, পরিবার, সমাজ ছাড়া। এদের বেশির ভাগই ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেন, কিন্তু সঙ্গী হিসেবে কোনও নারী নয় পুরুষকে চান তারা। এদের সবাই পড়াশোনো জানা, বর্তমানে ভালো ভালো পেশায় কর্মরত।
ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আঁখি হিজড়া অপারেশন করিয়ে নারী হতে চান। কিন্তু আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে তিনি তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারছেন না। তিনি নারী হয়ে পছন্দের মানুষের সঙ্গে ঘর বাঁধতেও চান।
চাকরিজীবী শাম্মী হিজড়া বলেন, ‘কোনও নারী আমাকে কখনও আকর্ষণ করেন না। ছোটবেলা থেকেই ছেলেরা আমাকে আকর্ষণ করতো। আমি আমার জীবনে নারী সঙ্গীর কথা চিন্তাও করতে পারি না।’
একটি এনজিও’র প্রধান অনন্যা বণিক তার বয়স নিয়ে চিন্তিত। বর্তমানে তার বয়স ৪১ বছর। ৪৫ বছর বয়স হলে তিনি কী করবেন জানেন না। তিনি বলেন, ‘৪৫ হয়ে গেলে আমার সৌন্দর্য, শারীরিক সক্ষমতা থাকবে না। ৪৫ হয়ে গেলে নারীর কোনও গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। কারণ, তার মেনোপজ হয়ে যায়। এই বয়সটাকে আমি ভয় পাই।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি তো নারী! নারী তো তার বয়সটাকে ভয় পাবেই। সমাজে হিজড়াদের যে অবস্থান তাতে বয়সই তার বড় শত্রু।’
ফ্যাশন ডিজাইনার মিতুল বলেন, ‘আমি মেয়েদের সঙ্গে মিশতে, সাজতে পছন্দ করি। তবে ইউনিসেক্স পোশাক পরি। ফলে এটা নিয়ে আমার কোনও সমস্যা হয় না।’ মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করা মিতুল বলেন, ‘যদি কখনও কোনও পুরুষ সঙ্গী পাই যে আমাকে বুঝবে, আমার আবেগকে সম্মান করবে, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না, তাকে নিয়ে ঘর বেঁধে জীবন কাটিয়ে দেবো।’
হিজড়াদের আদি পেশা তোলা আদায় (টাকা চাওয়া, চাল, সবজি আদায়), নাচ গানের সঙ্গে জড়িত রাজধানীর মগবাজারের এমন তিনজন হিজড়ার সঙ্গে কথা হয়— চালচলনে তারাও পুরুষ, কিন্তু নারীর নাম ধারণ করে ‘নারীর মন’ লালন করে চলেছেন। তারাও ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেন। মা হতে চান। সম্ভব না হলে কারও সন্তান লালন-পালনের মাধ্যমে বড় করে মাতৃত্বের সাধ পূরণ করতে চান।
সূচনা হিড়জা বেশ চটপটে ও স্মার্ট। নিজেকে কর্মঠ দাবি করে বলেন, ‘যে কোনও পুরুষের চেয়ে আমার শরীরে শক্তি বেশি, কাজও বেশি করতে পারি। এই বেলায় আমি মেয়ে না। তবে যখন কোনও নারীকে দেখি, কোনও মাকে দেখি— তখন আমার ভেতরের নারী সত্ত্বা জেগে ওঠে।’
সূচনা হিজড়ার সঙ্গী রানী আর পরীও আসলে পুরুষ। সূচনার সঙ্গেই তারা থাকেন, কাজ করেন। ঘুরেফিরে বেড়ান। হিজড়াদের সহজাত আচরণের সঙ্গে তাদের আচরণ ঠিক মেলানো যায় না। আচার-ব্যবহারে তারা অতিশয় কোমল। লাজুক লাজুক গলায় পরী বললেন,‘একটা ছেলেরে আমার খুব পছন্দ। এখন কাজ করে টাকা জমাই। অনেক টাকা জমলে তাকে বিয়ার কথা বলবো। রাজি না হলে সারা জীবন একাই থাকবো।’
আর রানী বললেন, ‘আমার সাজতে, অন্যকে সাজাতে, ঘর গোছাতে, সেলাইয়ের কাজ করতে ভালো লাগে। অন্যের চুলে তেল দেওয়া, চুলে বিলি কেটে দেওয়া, বেণী করা, এমনকি উঁকুন বেছে দিতেও আমার ভালো লাগে।’
মনোচিকিৎসক ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, ‘মানুষের মনের যাবতীয় কিছু হরমোন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এতে ভারসাম্য অবস্থা বজায় থাকতে হয়, ভারসাম্যহীন হলে জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়। যেসব পুরুষের মধ্যে নারীর হরমোনের আধিক্য থাকে, তাদের আচরণ মেয়েলি হয়। আর যেসব নারীর মধ্যে পুরুষ হরমোনের আধিক্য থাকে তাদের আচরণ পুরুষালী হয়। পুরুষ হিজড়ারা সাধারণত এই সমস্যায় ভোগে। শারীরিকভাবে পুরুষ হলেও তারা আসলে নারীর মন ধারণ করে। এ কারণে এক সময় তাদের পরিবার ও সমাজে ঠাঁই হয় না। ফলে তারা যেখানে আশ্রয় পায়, সেখানে চলে যেতে চায় এবং এক সময় তারা হিজড়া সম্প্রদায়ের কাছে চলে যায়। অনেক সময় হিজড়ারা খোঁজ পেলে তারাও নিয়ে যায়।’
এই মনোচিকিৎসক আরও বলেন, ‘জন্মের পর কোনও সমস্যা ছাড়াই সন্তান তার বাবা-মায়ের কাছেই থাকে। সমস্যাটা হয় সন্তানের লিঙ্গ (ছেলে বা মেয়ে) ঠিক না হলে। তখন বাবা-মা দিশেহারা হয়ে পড়েন। পরিবারের অন্য সদস্যদের ভয়ে, সমাজের চাপে অনেক সময় বাবা-মা সন্তানের লিঙ্গ পরিচয় গোপন রাখেন। কিন্তু প্রকাশ হয়ে গেলে সন্তানের দায়-দায়িত্ব কেউ আর নিতে চান না। লোকমুখে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে হিজড়ারা এসে ওই সন্তানকে নিয়ে যায়। অনেক সময় ওই সন্তানটি বড় হলে নিজে থেকে চলে যায় বা চলে যেতে বাধ্য হয়। অনেক সময় ছেলে সন্তান বড় হলেও আচরণে, পোশাকে, হাঁটাচলায় মেয়েদের মতো করায়, একটা বয়সের পরে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়।’
ডা. মোহিত কামাল আরও বলেন, ‘হিজড়া হলেও তাদের আবেগকে আমাদের মূল্য দিতে হবে। মোটিভেট করতে হবে যে, তাদের দ্বারাও ভালো কিছু হতে পারে। তাদের বোঝাতে হবে তারাও সুস্থ, কেবল হরমোনে ভারসাম্যহীনতার কারণে তাদের মনে অন্য মানুষ (নারী বা পুরুষ) বসতি গেড়েছে। এটাকে খারাপ না ভেবে বরং তাদের এই অবস্থা থেকেই ভালোকিছু যে হতে পারে, সেই বিষয়ে উৎসাহ দিলে নারীর মন নিয়েও সেই পুরুষ (হিজড়া) ভালো কিছু করে দেখাতে পারবে।’