X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

মীর কাসেম আলীর ১৪টি ফ্ল্যাট-দোকানের মালিকানা পরিবর্তন

দীপু সারোয়ার
২৩ আগস্ট ২০১৯, ০৮:০০আপডেট : ২৩ আগস্ট ২০১৯, ২০:২০

মীর কাসেম আলী সরকারের নিবন্ধন পরিদফতরের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া মীর কাসেম আলীর সম্পদ হস্তান্তর করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অগোচরে মালিকানা পরিবর্তনের এ ঘটনা ঘটেছে।

বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে মীর কাসেমের মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান কেয়ারী লিমিটেডের ৩টি ফ্ল্যাট ও ১১টি দোকান হস্তান্তরের তথ্য মিলেছে। ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের ‘কেয়ারী ক্রিসেন্ট’ ভবনে [প্লট-১৪৮জি (পুরাতন), ৬০ (নতুন); রোড নং ১৩৮ (পুরাতন), ২এ (নতুন)] এসব ফ্ল্যাট ও দোকানের অবস্থান। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মীর কাসেমের সম্পদ হস্তান্তরে তৎপর ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন অধিশাখা-৭-এর দুই কর্মকর্তা। সম্পদ হস্তান্তর ও নাম জারির বিষয়ে একের পর এক নির্দেশ জারি করেন তারা। গত বছরের ২৯ নভেম্বর থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে নির্দেশ জারি করে মীর কাসেমের ৩টি ফ্ল্যাট ও ১১টি দোকান হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা হয়।

মীর কাসেম আলীর ১৪টি ফ্ল্যাট-দোকানের মালিকানা পরিবর্তন

এ বিষয়ে জানতে উন্নয়ন অধিশাখা-৭-এর উপসচিব এস এম নজরুল ইসলাম ও উপসচিব মো. আব্দুল ওয়াদুদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি। তাদের মুঠোফোনে দফায় দফায় ফোন করে এবং বার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের সম্পদ হস্তান্তর, বিক্রি ও দলিল রেজিস্ট্রিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারপরও কীভাবে  হস্তান্তর হচ্ছে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কেয়ারী ক্রিসেন্ট ভবন (ছবি : সাজ্জাদ হোসেন) তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা ও গণমানুষের দাবি যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা হোক। সরকারের পরিকল্পনাও সেরকম। এই পরিকল্পনায় কারা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ হস্তান্তরে কারা সহযোগিতা করছে, তা খুঁজে বের করা হবে।’

গত বছরের ২৪ এপ্রিল ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার দ্বীপক কুমার সরকার ‘মীর কাসেম আলী ও তার মালিকাধীন প্রতিষ্ঠানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ হস্তান্তর এবং দলিল রেজিস্ট্রেশন না করা প্রসঙ্গে’ নিবন্ধন পরিদফতরের মহাপরিদর্শকের কাছে চিঠি পাঠান। ওই চিঠির অনুলিপি আইনমন্ত্রী ও আইন সচিবের একান্ত সচিবদেরও পাঠানো হয়।

মীর কাসেম আলীর ১৪টি ফ্ল্যাট-দোকানের মালিকানা পরিবর্তন

চিঠিতে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী কেয়ারী লিমিটেডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, জমি ও স্থাপনার মালিক। এসব প্রতিষ্ঠান ও সম্পদ হস্তান্তর, দলিল রেজিস্ট্রেশন না করাসংক্রান্ত সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ করা হলো।

চিঠিতে আরও বলা হয়, ২০১৮ সালের ২২ ও ২৩ এপ্রিল কেয়ারী লিমিটেডের কিছু সম্পত্তি উত্তরা সাব রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রেশনের জন্য উপস্থাপিত হয়। বিষয়টি জানার পর আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে তা জানানো হয়। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের মালিকাধীন প্রতিষ্ঠানের জমি রেজিস্ট্রেশন থেকে বিরত থাকতে সাব রেজিস্ট্রারদের নির্দেশ দিতে বলেন। পরে আইনমন্ত্রীকেও জানানো হয়। মন্ত্রীও যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ হস্তান্তর, দলিল রেজিস্ট্রি না করার নির্দেশ দেন।

২০১৮ সালের ১৯ জুন নিবন্ধন পরিদফতরের মহাপরিদর্শক খান মো. আবদুল মান্নান ‘যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী ও তার মালিকাধীন প্রতিষ্ঠানের জমি বিক্রি বা কোনও প্রকল্প হস্তান্তর না করা প্রসঙ্গে’ আদেশ জারি করেন। আদেশটি সারাদেশের সাব রেজিস্ট্রি অফিস, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি অ্যান্ড ফার্মস (যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদফতর) ও মানি এক্সচেঞ্জে পাঠানো হয়।

মীর কাসেম আলীর ১৪টি ফ্ল্যাট-দোকানের মালিকানা পরিবর্তন

এই আদেশ উপেক্ষা করে কীভাবে মীর কাসেমের সম্পদ হস্তান্তরে একের পর এক নির্দেশ জারি করা হচ্ছে—তা জানতে মহাপরিদর্শক খান মো. আব্দুল মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে বাংলা ট্রিবিউিন। তার কার্যালয়ে এবং মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও কোনও জবাব পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন অধিশাখা-৭-এর উপসচিব এস এম নজরুল ইসলাম ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের (প্লট-১৪৮জি (পুরাতন), ৬০ (নতুন); রোড নং ১৩৮ (পুরাতন), ২এ (নতুন)] ৯ কাঠা ৪ ছটাক জমির ওপর নির্মিত ‘কেয়ারী ক্রিসেন্ট’ নামে ১৩ তলা ভবনের ১২ তলায় ১,০৮৪ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাট (এ-১১ ও এ-১২) হস্তান্তরের আদেশ জারি করেন। ওই আদেশে দাতা হিসেবে কেয়ারী লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামসুল হুদা এবং গ্রহীতা হিসেবে খন্দকার হাবিবার নাম উল্লেখ করা হয়।

কেয়ারী ক্রিসেন্ট ভবন (ছবি : সাজ্জাদ হোসেন)

ধানমন্ডি সাব রেজিস্ট্রি অফিস জানায়, ফ্ল্যাট দুটি হস্তান্তর করা হয় গত ২৯ জানুয়ারি। সাব রেজিস্ট্রার ছিলেন মো. লুৎফর রহমান মোল্লা। হস্তান্তরের আর্থিক মূল্য দেখানো হয় ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। অথচ ফ্ল্যাট দুটির বাজারমূল্য ২ কোটি টাকার বেশি।

জানতে চাইলে সাব রেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লা বলেন, “সম্পদের কোথাও ‘যুদ্ধাপরাধীর সম্পদ’ লেখা নেই। তাই দলিল রেজিস্ট্রিতেও বাধা নেই।”

মীর কাসেম আলীর ১৪টি ফ্ল্যাট-দোকানের মালিকানা পরিবর্তন

১১ দোকান ও ১টি ফ্ল্যাট বিক্রি 

কেয়ারী ক্রিসেন্টের আরও ১১টি দোকান ও ১টি ফ্ল্যাট হস্তান্তরের নির্দেশ দেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন ও অধিশাখা-৭-এর উপসচিব মো. আব্দুল ওয়াদুদ ও উপসচিব এস এম নজরুল ইসলাম।

গত বছরের ২৯ নভেম্বর উপসচিব মো. আব্দুল ওয়াদুদ কেয়ারী লিমিটেডের ভবনের ৪১৭, ৩৬৭, ৩০৮, ৫৩৩ ও ৪১৩ বর্গফুটের ৫টি দোকান হস্তান্তর ও নামজারির নির্দেশ দেন। নির্দেশে দাতা হিসেবে কেয়ারী লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামসুল হুদা ও গ্রহীতা হিসেবে শাহিন কবিরের নাম উল্লেখ করা হয়।

গত ৩ জানুয়ারি ৪৪৭, ১৯০ ও ২৪৭ বর্গফুটের আরও ৩টি দোকান হস্তান্তর ও নামজারির নির্দেশ দেন উপসচিব এস এম নজরুল ইসলাম। এতে দাতা হিসেবে শামসুল হুদা এবং গ্রহীতা হিসেবে আমির হোসাইন, কাজী আহমদ ফারুক ও মোহাম্মদ বোরহান উদ্দীন রব্বানীর নাম উল্লেখ করা হয়।

৯ জানুয়ারি উপসচিব নজরুল ইসলাম ১৮৩ বর্গফুটের একটি দোকান হস্তান্তর ও নামজারির নির্দেশ দেন। এতে দাতা হিসেবে শামসুল হুদা ও গ্রহীতা হিসেবে মাহবুবুল হকের নাম উল্লেখ করা হয়।

২২ জানুয়ারি উপসচিব নজরুল ইসলাম ২৫২ ও ৩৩৯ বর্গফুটের দুটি দোকান হস্তান্তর ও নামজারির নির্দেশ দেন। এতে দাতা হিসেবে শামসুল হুদা ও হস্তান্তরগ্রহীতা হিসেবে রাই হরন দেবনাথের নাম উল্লেখ করা হয়।

মীর কাসেম আলীর ১৪টি ফ্ল্যাট-দোকানের মালিকানা পরিবর্তন

১৪ ফেব্রুয়ারি উপসচিব নজরুল ইসলাম ১,৬৭১ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট হস্তান্তর ও নাম জারির নির্দেশ দেন। এতে দাতা হিসেবে শামসুল হুদা ও গ্রহীতা হিসেবে কাজী মো. রাশেদুল হাসানের নাম উল্লেখ করা হয়।

হস্তান্তর দাতা কেয়ারী লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুল হুদার বক্তব্য জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে বাংলা ট্রিবিউন। তবে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ও আল বদর বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণূ নেতা ছিলেন তিনি। জামায়াতের অর্থের জোগানদাতা মীর কাসেম ছিলেন কেয়ারী গ্রুপের মালিক। ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, দিগন্ত মিডিয়াসহ বেশ কিছু ব্যবসায়িক গ্রুপের উদ্যোক্তা ও অংশীদারও ছিলেন তিনি।

২০১২ সালের ১৭ জুন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার হন মীর কাসেম। ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তার বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ গঠন করে বিচারকাজ শুরু করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের রায়ে দুটি অভিযোগে তার ফাঁসি ও ৮টি অভিযোগে কারাদণ্ড হয়। ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

 

/এইচআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ব্রাজিলে বৃষ্টিপাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭৮, এখনও নিখোঁজ অনেকে
ব্রাজিলে বৃষ্টিপাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭৮, এখনও নিখোঁজ অনেকে
হারিয়ে গেছে প্রাণ, নদীর বুকে বুনছে ধান
হারিয়ে গেছে প্রাণ, নদীর বুকে বুনছে ধান
টিভিতে আজকের খেলা (৬ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৬ মে, ২০২৪)
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
সর্বাধিক পঠিত
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
কোন পথে এগোচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?
কোন পথে এগোচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?