X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

শরীরে লাগা আগুন নেভাতে দৌড়ে বাসায় এসেছিলেন আলম (ভিডিও)

শেখ জাহাঙ্গীর আলম ও মো. আব্দুল গনি
১৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৩:০৪আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৬:১৮

অগ্নিকাণ্ডের পর কারখানার দৃশ্য

‘আলম... বাবা আলম রে... তুই কই গেলি রে... আইজকা কাম না করলে তুই মরতি না। আমার আলম শেষ, আমার রাজ্জাক শেষ। এহন আমি কই পামু আলম-রাজ্জাকরে। আগুনে শেষ কইরা দিলো জোয়ান দুইটা পোলারে। গতরে (শরীরে) এমন আগুন লাগছে, পানি দিয়াও নিভাইতে পারি নাই।’  স্বজন হারানোর শোকে চিৎকার করে এভাবেই বলছিলেন নিহত আলমগীর হোসেন আলমের খালা রেজিয়া বেগম।

সরেজমিনে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কেরানীগঞ্জের প্রাইম প্লাস্টিক কারখানার অফিস ভবনের সামনে বসে নিহত আলমের খালা ও বোনসহ স্বজনরা আহাজারি করছিলেন।       

মো. আলম (২৫) দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার হিজলতলার মৃত আব্দুর রশিদের ছেলে। তাদের বাড়ির পাশেই আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত প্রাইম প্লাস্টিক কারখানাটি। পরিবারের চার ভাই একই বাড়িতে পাশাপাশি ঘরে থাকতেন। প্রাইম প্লাস্টিক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে আলমগীর হোসেন আলম ও তার বড়ভাই রাজ্জাক কাজ করতেন। বুধবার (১১ ডিসেম্বর) দিনও তারা কাজে ছিলেন। যখন কারখানায় আগুন লাগে তখন তারাও দগ্ধ হন। গায়ে আগুন নিয়ে বাঁচতে দৌড়ে বাসায় চলে যান, পরে সেখানে স্বজনেরা আলম ও রাজ্জাকের গায়ে পানি ঢেলে আগুন নিভিয়ে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আলমের মৃত্যু হয়। এদিকে তার বড় ভাই রাজ্জাক হাসপাতালে মৃত্যুরে সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।

নিহত আলমগীর হোসেন আলমের স্ত্রী রুমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার স্বামী ওই কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতের। ওই বাড়িতে তারা চার ভাই পাশাপাশি ঘরে থাকতেন। বুধবার সন্ধ্যায় আগুন লাগার পরপর রাজ্জাক ভাই ও আমার স্বামী আলম দৌড়ে বাসায় চলে আসেন। আমরা পানি দিয়ে শরীরের আগুন নিভিয়ে ফেলি। পরে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যাই। কিন্তু আমার স্বামীকে আর বাঁচাতে পারলাম না। রাজ্জাক ভাইও চিকিৎসাধীন। আমি তো এখন একা হয়ে গেলাম।’

এর আগে, বুধবার (১১ ডিসেম্বর) বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে প্রাইম প্লাস্টিক কারখানায় আগুনের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ভয়াবহ আগুনে ঘটনাস্থলেই মাহবুব নামে একজনের মৃত্যু হয়। এছাড়াও কারখানার দগ্ধ ৩১ জন শ্রমিককে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৩ জনের মৃত্যু হয়। বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) বিকালে ময়নাতদন্ত শেষে শাহবাগ থানা পুলিশের সহায়তায় ঢামেক থেকে নিহত ১০ জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ। 

নিহত আলমের বোন রোজিনা বেগমের অভিযোগ, ‘এই কারখানায় প্রতি বছর তিন-চার বার আগুন লাগে, তারপরও প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেয় নাই? প্রশাসন দেখে, জানে, কিন্তু কিছুই করে না। যদি আগেরবার প্রশাসন কিছু করতো, তবে আজ আগুনে এমনভাবে আমার ভাই মরতো না।’

নিহত আলমের স্বজনেরা

তিনি আরও বলেন, ‘আমি এই কারখানার মালিকের বিচার চাই। আগুন লাগার পর থেকে সে পালাইছে। আগুনে আমার দুই ভাই শেষ, সরকার যাতে এই কারখানা উঠাইয়া দেয়।’

ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের চুনখুটিয়ায় প্রাইম প্লাস্টিকের কারখানা। বিশাল জমির ওপর গড়ে ওঠা এই কারখানায় প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম প্লেট ও কাপ তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিলেন অন্তত দেড় শতাধিক শ্রমিক। কারখানার ভেতরে ও বাইয়ে যাওয়া-আসার জন্য রয়েছে একটি ফটক। কাজ চলাকালীন সেটিও বন্ধ থাকতো। নীল রঙের ওই গেট দিয়ে প্রবেশ করলেও দেখা যায় চারতলা একটি অফিস ভবন। বাম পাশে প্লাস্টিক দানার বিশাল গোডাউন। আর ডান পাশে মূল কারখানা, তাও বিশাল জায়গাজুড়ে। কারখানার ওপরে টিনের শেড আর ভেতরে মেশিন। অফিস ভবন ও কারখানার মধ্যে একটি গলিপথ। সেখানে অরক্ষিতভাবে রয়েছে অসংখ্য গ্যাস সিলিন্ডার। এরপাশে রয়েছে ছোট পরিসরের একটি ব্রয়লার রুম। এর কিছুদূরে রয়েছে মেশিন-মেকানিকদের কক্ষ। আর এর পাশেই শ্রমিকদের ব্যবহারের তিনটি টয়লেট। তবে কারখানার বিশালতার তুলনায় মাত্র কয়েকটি এক্সট্রিংগুইশার ছাড়া ফায়ার ফাইটিংয়ের জন্য কোনও সুব্যবস্থা ছিল না।

সরেজমিনে ক্ষতিগ্রস্ত ওই কারখানার ভেতরে দেখা যায়, পুরো ফ্লোরের টাইলস ভেঙে গেছে। ওপরে ভারী লোহার ওপর থাকা টিনের শেড আগুনের তাপে ফ্লোরে নেমে গেছে। ভেতরের ব্রয়লার কক্ষটি একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। বিশাল এই কারখানার এমন কোনও জায়গা আাগুনের লেলিহান থেকে রক্ষা পায়নি। সব কিছু পুঁড়ে ছাই হয়ে গেছে যেন এক ধ্বংসস্তুপ। এদিকে, আহত ও নিহত শ্রমিকদের স্বজনরা কারখানার সামনে এসে আহাজারি করছিল। এছাড়াও কারখানা ধ্বংসস্তুপ দেখার জন্য উৎসুক জনতা ঘটনাস্থলে ভীড় জমায়। তবে কারখানাটি পুলিশ পাহাড়ায় রাখা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও শ্রমিকদের অভিযোগ, ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে এই কারখানায় একবার আগুন লেগেছিল। এরপর ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে আবার আগুনের ঘটনা ঘটে। এরপর গত বুধবার (১১ ডিসেম্বর) আগুন লাগলো। এছাড়াও প্রায়ই এই কারখানায় ছোটখাটো আগুনের ঘটনা ঘটতো। 

বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাটি পরিদর্শনে গিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আলী আজম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্লাস্টিক কারখানায় লাগা আগুনে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের সবার পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে। অন্তত ১০০টি কারখানার চেকলিস্ট রয়েছে। এর মধ্যে যেগুলোতে সেফটি সিকিউরিটি নেই, সেগুলোকে আমরা ননকমপ্লায়ান্স দিয়ে থাকি। এই কারখানাটির বিষয়ে ননকমপ্লায়ান্স থাকায় ইতোমধ্যে মালিকের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।’ 

প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রাইম প্লাস্টিক কারখানার সিকিউরিটি গার্ডের সুপার ভাইজার মো. শাকিল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কারখানার ভেতরে থাকা গ্যাস সিলিন্ডার থেকে গ্যাস লিক হয়েছিল। এই কারণে কারখানার লোড-আনলোড অফিসের লোকজন আসেন, কারখানার ইলেক্ট্রিশিয়ানরা আসেন, খবর শুনে অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছুটে আসেন, আমরাও ছুটে আসি। সবাই মিলে কাজ শুরু করা হয়। ইঞ্জিনিয়ার জাহাঙ্গীর স্যার সিলিন্ডারের মুখ ঠিক করার চেষ্টা করছিলেন। কেউ মেইন সুইচ বন্ধ করছিলেন। আবার কিছু শ্রমিক গ্যাস সিলিন্ডারগুলো সরানোর কাজ করছিলেন। আর তখন একটা বিষ্ফোরণ ঘটে এবং মুহূর্তের মধ্যে আগুন লেগে যায়। এখানে যারাই কাজ করছিল, তারাই আগুনে পুড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি দূরে থাকায় বেঁচে যাই। তখন ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের উদ্ধার করতে শুরু করি। আর আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য আমরা চেষ্টা করতে থাকি। গ্যাস সিলিন্ডার থেকেই এই আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে।’   

তদন্ত কমিটির প্রধান ও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের  উপপরিচালক (অ্যাম্বুলেন্স শাখা) মো. আবুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই কারখানায় ফায়ার সেফটির কোনও ব্যবস্থা ছিল না। তাছাড়া কারখানাটি আবাসিক এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে। আগুনের কারণ সম্পর্কে জানতে আমরা তদন্ত র্কাযক্রম শুরু করেছি। আশা করছি খুব দ্রুতই একটি প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘কারখানা যেভাবে ও যে পরিবেশে চলার কথা, তার কোনও কিছুই এখানে পাওয়া যায়নি। এধরনের কারখানা আবাসিক এলাকায় না থাকাই উত্তম। ঘটনার পর থেকে আমরা কারখানার মালিককে খুঁজে পাইনি।’

আবাসিক এলাকার মধ্যে কারখানা থাকতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন কেরানীগঞ্জের শুভাড্ডা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী ইকবাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমার মন্ত্রীর নির্দেশ, আজকে থেকে এসব কারখানায় তালা দিতে বলেছেন। কেরানীগঞ্জে এমন ধরনের সব কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আবাসিক এলাকায় ঝুঁকির্পূণ কোনও কারখানা থাকবে না।’

ভিডিও:  

 

/এএইচ/
সম্পর্কিত
বহুতল ভবনের ছাদ থেকে পড়ে প্রাণ গেলো শিশুর
মুগদায় ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনি, তরুণের মৃত্যু
যৌথবাহিনীর অভিযানে সাত দিনে আটক ৩৮০
সর্বশেষ খবর
সমস্যা মানেই অসুখ নয়: মেডিক্যালাইজেশন কি বাংলাদেশের নতুন ব্যাধি?
সমস্যা মানেই অসুখ নয়: মেডিক্যালাইজেশন কি বাংলাদেশের নতুন ব্যাধি?
দুই ভাইয়ের বিরোধে মুরাদনগরের সেই ঘটনার ভিডিও ছড়ানো হয়: র‌্যাব
দুই ভাইয়ের বিরোধে মুরাদনগরের সেই ঘটনার ভিডিও ছড়ানো হয়: র‌্যাব
গাজায় যুদ্ধবিরতির নতুন প্রস্তাবের নিশ্চয়তা চায় হামাস
গাজায় যুদ্ধবিরতির নতুন প্রস্তাবের নিশ্চয়তা চায় হামাস
জুলাই আন্দোলনে নিহত ৬ সাংবাদিক: কেমন আছে তাদের পরিবার
জুলাই আন্দোলনে নিহত ৬ সাংবাদিক: কেমন আছে তাদের পরিবার
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
খেলাপিতে ধসে পড়ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান: বিপদে আমানতকারীরা
খেলাপিতে ধসে পড়ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান: বিপদে আমানতকারীরা
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল