X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নামেই শিশু-আদালত, বাস্তবে যা দেখা গেলো

বাহাউদ্দিন ইমরান
২৯ জুন ২০২২, ০৮:০০আপডেট : ২৯ জুন ২০২২, ১৬:৩০

শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বেড়েছে। পাড়া-মহল্লায় ‘কিশোর গ্যাং’ এখন পরিচিত শব্দ। যে কারণে উচ্চ আদালত থেকে বারবার নির্দেশনা এসেছে কিশোর আইন সময়োপযোগী করার। কিন্তু শিশুর সুরক্ষা ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তর আলোচনা গেজেটেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে নেই প্রতিফলন। দেখা গেছে, আইনে স্পষ্ট বিধান সত্ত্বেও দেশে এখনও শিশুবান্ধব আদালত ব্যবস্থাই গড়ে উঠতে পারেনি।

শিশু-আদালত নিয়ে আইনে যা আছে
শিশু আইন ২০১৩-এর অধীনে অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সবাইকে শিশু গণ্য করা হয়। আইনটির কয়েকটি ধারায় শিশুদের বিচারের জন্য ভিন্ন আদালত ব্যবস্থার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। 

সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ধারায় বলা হয়েছে—  ১৬ (১) আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশু কর্তৃক সংঘটিত যে কোনও অপরাধের বিচার করার জন্য প্রত্যেক জেলা সদরে শিশু-আদালত নামে এক বা একাধিক আদালত থাকবে।

(২) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর অধীন গঠিত প্রত্যেক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল স্বীয় অধিক্ষেত্রে উপ-ধারা (১)-এ উল্লিখিত শিশু আদালত হিসেবে গণ্য হবে: তবে শর্ত থাকে যে, কোনও জেলায় এ ধরনের ট্রাইব্যুনাল না থাকলে উক্ত জেলার জেলা ও দায়রা জজ স্বীয় অধিক্ষেত্রে উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত শিশু-আদালত হিসেবে গণ্য হবে।

(৩) ধারা ১৫ ক-এর অধীন কোনও মামলা প্রেরিত না হলে, শিশু-আদালত শিশু কর্তৃক সংঘটিত কোনও অপরাধ বিচারার্থে গ্রহণ করবে না।

ধারা ১৭ (৪) অনুযায়ী সাধারণত যে সকল কামরায় এবং যে সকল দিন ও সময়ে প্রচলিত আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় তা ছাড়া অন্য কোনও দালানে বা কামরায়, প্রচলিত কাঠগড়া ও লালসালু ঘেরা আদালতকক্ষের পরিবর্তে একটি সাধারণ কক্ষে এবং অন্য কোনও দিবসে শিশু-আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠান করতে হবে।

শিশু-আদালতের আসন বিন্যাস এমনভাবে করতে হবে যেন সকল শিশু বিচার প্রক্রিয়ায় তার মা-বাবা বা বৈধ অভিভাবক এবং প্রবেশন কর্মকর্তা ও আইনজীবীর যতদূর সম্ভব, সন্নিকটে বসতে পারে।

(৩) উপ-বিধি (১) এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে আদালতকক্ষে শিশুর জন্য উপযুক্ত আসনসহ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য প্রয়োজনে, বিশেষ ধরনের আসন প্রদানের বিষয়টি শিশু-আদালত নিশ্চিত করবে।

(৪) শিশুর বিচার চলাকালে আইনজীবী, পুলিশ বা আদালতের কোনও কর্মচারী আদালতকক্ষে তাদের পেশাগত বা দাপ্তরিক ইউনিফরম পরতে পারবেন না।

ধারা ২৫ (১) অনুযায়ী শিশু-আদালত প্রয়োজন মনে করলে, কোনও মামলার শুনানিকালে, শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থে উল্লিখিত যেকোনও ব্যক্তিকে উক্ত আদালত থেকে বহিরাগমণের নির্দেশ দিতে পারবেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আদালত পরিত্যাগে বাধ্য থাকবেন।

(২) শালীনতা বা নৈতিকতা বিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত মামলা শুনানিকালে কোনও শিশুকে সাক্ষী হিসেবে তলব করা হলে, শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থে যাদেরকে প্রত্যাহার করা যুক্তিযুক্ত ও সমীচীন হবে, শিশু-আদালত তাদের প্রত্যাহারের নির্দেশ দিতে পারবেন।

ধারা ২৬ (৩) শিশুকে নিরাপদ হেফাজতে রাখা একান্ত প্রয়োজন হলে শিশু-আদালত, সংশ্লিষ্ট শিশুকে উক্ত আদালত হতে যুক্তিসঙ্গত দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত কোনও প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর আদেশ দেবেন। তবে শর্ত থাকে যে, ওই প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকারী বয়স্ক শিশুদের কাছ থেকে প্রেরিত শিশুকে আলাদা রাখতে হবে।

যা দেখা গেলো
ঢাকার শিশু আদালতগুলো কীভাবে চলছে তা সরেজমিনে দেখতে যায় বাংলা ট্রিবিউন।

শিশুদের অপরাধের বিচারের জন্য আইনত ক্ষমতাপ্রাপ্ত ঢাকায় মোট ৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এর মধ্যে ৮ নম্বর ট্রাইব্যুনালে ১৬ জুন একটি ধর্ষণের মামলায় ভিকটিমের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। আদালতের এজলাসের বাইরে তখন অন্যান্য মামলার আসামি, স্বজন ও হকারদের জটলা।

এজলাসের একমাত্র দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আসামিদের কাঠগড়া ও পাশে সোফা। সেসব সোফায় সাধারণ আইনজীবীরা বসে আছেন। পাবলিক প্রসিকিউটররা বসে আছেন আসামিদের ডকের একেবারেই কাছে।

এজলাসের উঁচু স্থানে আছেন বিচারক। আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ডকে একইসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক আসামি। প্রায় সকলের হাতেই হাতকড়া।

ডকের প্রবেশমুখে নির্ধারিত ইউনিফর্মে দাঁড়িয়ে পুলিশ। অথচ শিশুর বিচার চলাকালে আইনজীবী, পুলিশ বা আদালতের কোনও কর্মচারীর পেশাগত বা দাপ্তরিক ইউনিফরম পরার কথা নয়।

সেদিন (গত ১৬ জুন) তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরা করছিলেন আসামিপক্ষের আইনজীবী।

আইনজীবী বলেন, আমার মক্কেলের বিরুদ্ধে মিথ্যা তদন্ত করেছেন, ওই ঘটনায় ‘ভিকটিমের (নারীর) …..'পেনিট্রেশন' সংগঠিত হয়নি, তাই ধর্ষণও হয়নি।’

এসময় শিশু আসামিদের আলাদা রাখার বিধান থাকলেও তা করা হয়নি। ফলে ওই শিশু আসামিরাও ডকে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন কীভাবে ধর্ষণ হতে পারে বা এ ধরনের ঘটনা থেকে পরিত্রাণ মিলতে পারে।

কয়েকটি মামলার নথি থেকে পাওয়া তথ্যমতে, সেদিন ডকে উপস্থিত কয়েকজন আসামির বয়স ১৮ পার হয়নি।

এরপর ঢাকার দারুসসালাম থানার এক হত্যাচেষ্টা মামলার বিচার শুরু হয়। ভিকটিমের সাক্ষ্য নেন তার আইনজীবী।

ভিকটিম আদালতকে বলেন, তাকে আসামিরা ফুলের টব দিয়ে মাথায় আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে দেয় ও বুকে-পেটে লাথি মেরে গুরুতর আহত করে।

আসামিদের একজনের বয়স ১৮ বছরের কম হওয়ায় এই ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য মামলাটি আসে।

এদিকে ভিকটিমকে জেরাকালে আসামিদের আইনজীবীরা বলেন, মূলত রাস্তার পাশ থেকে হেঁটে যাওয়ার সময় ছাদ থেকে ফুলের টব পড়েই সে আহত হয়ে এখন মক্কেলদের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছেন।

এভাবে মিশ্র পরিবেশের মধ্য দিয়ে প্রতিদিন শেষ হয় শিশু আদালতের কার্যক্রম।

সাবেক বিচারপতি ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন বলেন, শিশু আইনটি মূলত আইনটি করা হয়েছিল, যেন কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে শিশুদের মনের বিকাশ ঘটানো যায়। সাজা দিয়ে সবকিছুর সংশোধন করা সম্ভব হয় না। কিন্তু আইনে থাকা সত্ত্বেও শিশুদের সেসব অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।

মহানগর পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আবু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের কিছু অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। জায়গা কম। এর পরও আইনের ব্যত্যয় না ঘটিয়ে বিচার পরিচালনা করা হয় বলে দাবি করেন তিনি।

বিচার ব্যবস্থায় শুধু আইন করলেই চলবে না, প্রয়োগের জন্য যা দরকার তাও করতে হবে বলে মনে করেন মানবাধিকার সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ল’ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম।

সুপ্রিমকোর্টের এই আইনজীবী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিশু আদালতের জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ রাখতে হবে। যেন বিচারপ্রার্থীর আস্থা আসে। ঢাকার শিশু আদালতগুলোর যে পরিবেশ তার চেয়েও ভয়ানক পরিবেশ মফস্বলের আদালতে। সেখানে কোনও আদালতই শিশুবান্ধব নয়। আমার মনে হয়, শিশুবান্ধব আদালত নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।’

/এফএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী