রাজধানীতে যে কয়েকটি উদ্যান রয়েছে এরমধ্যে ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। তবে ঐতিহাসিক ওই উদ্যানটি ঘিরে রাতদিন চলে নানা অপকর্ম। সন্ধ্যা নামলেই আড়ালে সেখানে চলে মাদকসেবীদের আড্ডা। এছাড়া গভীর রাতে উদ্যানের পাশে রমনা পার্কের দেয়াল ঘেঁষে ভাসমান যৌনকর্মীদের প্রকাশ্যেই চলে দেহ ব্যবসা। বেড়ে যায় হিজড়াদের চলাচল। রয়েছে চুরি ছিনতাইকারীদের উৎপাত। ফলে উদ্যানে আগত দর্শনার্থী ও পথচারীদের সন্ধ্যার পর ভয়ে চলাচল করতে হয়।
যেকোনও ধরনের যানবাহন প্রবেশ নিষেধ হলেও প্রতিদিন শত শত মোটরসাইকেল অবাধে উদ্যানের ভেতরের হাঁটার রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে দেখা যায়। এসবের জন্য উদ্যানে আগত দর্শনার্থীদের যেমন অসুবিধা হচ্ছে, তেমনি নষ্ট হচ্ছে উদ্যানের পরিবেশ। শনিবার ওই উদ্যানে সরেজমিন দেখা যায় প্রকাশ্যে দিন-দুপুরে মাদকসেবীদের মাদক সেবন করতে। বিশেষ করে উদ্যানের পশ্চিম পাশে অনেকটা জায়গা ভাসমান লোকজনের দখলে। অথচ এই পথ ধরে উদ্যানের টিএসসি গেট হয়ে অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করে। ছবির হাটের গেট দিয়ে বের হয়ে শাহবাগের দিকে যায়। এ দৃশ্য পথচারীদের চোখে নতুন নয়।
প্রায়ই সহপাঠীদের নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘুরতে আসেন নাট্যকর্মী পাভেল রহমান। তার মতে, উদ্যানের ভেতরে যথেষ্ট নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। তা না হলে উদ্যানের ভেতরে আনাচেকানাচে লোকজন মাদকসেবন করে কীভাবে? এসব পরিস্থিতি যখন চোখে পড়ে তখন সাধারণ লোকজনের মনে ভয় তো সৃষ্টি হয়ই। রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এখানে ঘুরতে আসে, তাদেরও এসব কারণে খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। বিনোদনের স্থানগুলো হবে বিনোদনের মতোই। যেখানে লোকজন প্রাণ খুলে বসবে, আড্ডা দেবে, গল্প করবে। এখানে উল্টোটা। সন্ধ্যার দিকে ভয়ে ভয়ে চলতে হয় উদ্যানের ভেতরে ঢুকলে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) শাহবাগ থানার অধীনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। থানার পক্ষে থেকে সবসময় পুলিশ টহলে থাকে, তারপরও কমছে না অপকর্ম। এসব এলাকায় রাতে প্রায়ই টহলে যান শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আরিফ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এখানে যারা ঘুরতে আসেন, তাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী। বাইরে থেকেও অনেকে আসেন। উদ্যানের ভেতরে নানা সময় অপরাধমূলক কাজ আমার চোখে পড়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশে রাতের বেলা প্রায়ই টহলে যাই। কোনও বিশৃঙ্খলা দেখলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিই।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিরাপত্তায় নিয়োজিত এক আনসার সদস্য বলেন, আমাদের নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব আছে, সেগুলোই পালন করি। গেটগুলোতে আমরা পাহারা দিই। রাতে গেট খুলতে রাজি না হলে অনেকে দলবেঁধে এসে গেটে লাথি মারে। এ ক্ষেত্রে আমরা অসহায়। আমরা চাইলেও তাদের কিছু বলতে পারি না।
ছবির হাটের পাশে ১৮ বছর ধরে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা করছেন সাব্বির আহম্মেদ। তার মতে, করোনার পরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নতুন করে বেড়েছে মাদকসেবীদের আড্ডা, চুরি, ছিনতাই, প্রতারণা। তার ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ভাঙিয়ে বাইরে থেকে এসেও এসব অপরাধমূলক কাজে জড়াচ্ছে অনেকে।
তিনি বলেন, চোর, ছিনতাইকারী ও প্রতারকরা এই স্থানটিকে নিরাপদ মনে করে। প্রায়ই দেখা যায়, তরুণ যাত্রীরা রিকশা, সিএনজি, অটো এনে চালককে ভাড়া না দিয়ে ভেতরে গিয়ে আর ফিরে আসে না। পরে টাকা না নিয়েই দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে চালকরা চলে যায়। সাধারণত রাত ১১টার পর গেট আর খোলা থাকে না। বন্ধ থাকলে অনেকে গেট টপকে উদ্যানে ঢোকেন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, উদ্যান এলাকায় যারা মাদক সেবন করেছে, এমন অনেককে আমরা গ্রেফতার করছি। অপরাধী তো অপরাধীই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হোক আর যে-ই হোক, অপরাধ করে পার পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। এদের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান চলমান রয়েছে।
এর আগে গত ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় গেলে সেখানে একই চিত্র দেখা যায়। সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। চারদিকে ঝুম বৃষ্টি। শাহবাগ মোড় হয়ে টিএসসি পর্যন্ত পুরো পথ অন্ধকার। বৃষ্টির মধ্যেই শাহবাগ থানা অতিক্রম করে যাওয়া হয় উদ্যানের প্রথম গেটে। গেটের ভেতরে প্রবেশ করলেই ছবির হাট। সেখানে পাঁচ ছয়টি ভ্রাম্যমাণ দোকান রয়েছে। কাকভেজা হয়ে দোকানের ছাউনিতে বসে অনেকে গল্প করছেন, সিগারেট টানছেন। সেখানেই এক কোণে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন তিন পুলিশ সদস্যও। মাঝখান দিয়ে মানুষের চলাচল। এ পথে দাঁড়িয়েই এক তরুণী খদ্দেরের খোঁজে পথচারীদের আপত্তিকর প্রস্তাব ও ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে।
এর কয়েক মিনিট পর ছবির হাট পার হয়েই দেখা মেলে দেয়ালঘেরা একটি মঞ্চ। কাছে গেলেই দেখা যায় শতেক মানুষের ভিড়। সেখানে অনেকে বৃষ্টিতে আটকে পড়েছে। তাদের বেশিরভাগই তরুণ। ওই মঞ্চ থেকে গাঁজার গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের কেউ কেউ মাদক তৈরি করছে, অনেকে তৈরি করা মাদক দলবেঁধে পার্কের অন্য স্থানে গিয়ে সেবন করছে। আবার কেউ কেউ শব্দ করে বলছে, ‘আজকে তামাকটা ভালো পড়েছে।’
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান একটি ঐতিহাসিক স্থান। মানুষ এখানে আসবে, বসবে, ঘুরেফিরে দেখবে, ইতিহাস জানবে। জায়গাটি খোলামেলা থাকার কথা, যেন দূর থেকে একজন আরেকজনকে দেখতে পায়। সাধারণ মানুষ ঢুকবে কীভাবে? উদ্যানজুড়ে বড় বড় গাছ আর অন্ধকার। এ অবস্থায় অনেকে ভয়ে প্রবেশ করবে না। এরপর যদি নানা অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত হয়, তাহলে তো আরও সমস্যা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে আগে নাট্যদলগুলো ছোট ছোট নাটক করতো। সেটাও এখন বন্ধ হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাদকসেবীরা যেমন আছে, সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটছে। যারা এসব অপকর্ম করে তারা তো পুলিশের সামনে করে না। লুকিয়ে, আড়ালে করে। সেখানে আমাদের পুলিশ সবসময় টহলে রয়েছে। এসব ঘটনা আগেও ছিল, এখনও আছে। শিক্ষার্থী ছাড়াও প্রচুর বহিরাগত লোক উদ্যানে আসে। এদের কীভাবে স্থায়ীভাবে বের করা যায়, কীভাবে এসব কাজ বন্ধ করা যায় সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।