X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

তাদের প্রত্যাশা, হয়তো কেউ আসবে শীতবস্ত্র নিয়ে

আতিক হাসান শুভ
১৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৫৯আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:২০

পৌষের বাকি এখনও দুদিন। তার আগেই রাজধানীতে জেঁকে বসেছে তীব্র শীত। এবার অগ্রহায়ণের শেষ মুহূর্তে রাজধানীজুড়ে শীত অনুভূত হচ্ছে বেশ। এই শীতে গরম কাপড়ের অভাবে দুর্ভোগে পড়েছেন ভবঘুরে ও নিম্ন আয়ের লোকজন। একেকজনের জীবনের গল্প একেক রকম হলেও, শীতের তীব্রতা অনুভূত হয় সমান।

মানবেতর অবস্থায় রাত যাপন করছেন বাস্তুভিটা ও পরিবারহীন এসব মানুষ। পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক ও সদরঘাট এলাকায় দেখা মেলে এমন অসংখ্য মানুষের। খোলা জায়গা হওয়ায় শীতের তীব্রতার কারণে রাতে ঘুম হয় না অনেকের।

সরেজমিনে পুরান ঢাকার, সদরঘাট, লক্ষ্মীবাজার, তাঁতীবাজার, বাহদুর শাহ পার্ক, শ্যামবাজার ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকার ফুটপাতগুলোয় শতাধিক ছিন্নমূল ও সহস্রাধিক নিম্ন আয়ের মানুষ রাত যাপন করেন। তারা কোনোমতে গায়ে হালকা কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকেন ফুটপাতে বা টার্মিনালের আঙিনায়। ভবঘুরে ও পথশিশু বেশির ভাগের আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল। তাদের কেউ টুকটাক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও অধিকাংশই ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি ও নেশায় আসক্ত।

তাদের কেউ রিকশা চালান, কেউ ভ্যান গাড়ি, কেউবা ঠেলাগাড়ি

অন্যদিকে নিম্ন আয়ের যারা এই এলাকায় খোলা উন্মুক্ত স্থানে রাত যাপন করেন, তাদের কেউ রিকশা চালান, কেউ ভ্যান গাড়ি, কেউবা ঠেলাগাড়ি কিংবা দৈনিক মজুরিতে যেকোনও কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

পুরান ঢাকায় ফুটপাতে কিংবা উন্মুক্ত স্থানে থাকা ভবঘুরে মানুষের সংখ্যা যেমন কম নয়, তেমনি নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। ফুটপাতে রাত যাপন করা বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের।

ভ্যানগাড়িচালক বাসেত মিয়া (৫২) ১৬ বছর ধরে সদরঘাটে বসবাস করেন। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টায় সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে লালকুঠি ঘাটরে পাশে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন মেঝেতে পাতলা একটা কাপড় পেতে। কথা বলতে চাইলে প্রথমে অস্বীকৃতি জানান, পরে শীতবস্ত্র পাওয়ার আশায় নড়েচড়ে বসেন। তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গার হাওয়ায় শীতের রাতে ঘুম হয় না। এখানে শুধু গরমকালে ঘুমাতে আরাম লাগে। আর অন্য সময় ঘুমাতে ঝামেলা পোহাতে হয়।

ফুটপাতে ঘুমানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢাকা শহরে সবচেয়ে কম ভাড়া টলি (ভ্যান) চালকের। দিনে যা রোজগার হয়, তা খাওয়া-দাওয়া করে বাড়ি পাঠালে আর কিছু থাকে না। আর আমি যদি এখানে আরাম করি, তাহলে বাড়িতে ছেলেমেয়েদের কষ্ট করতে হবে। তাদের সুখের জন্যই তো ঢাকায় আসা।

পুরান ঢাকার ফুটপাতগুলোয় শতাধিক ছিন্নমূল ও সহস্রাধিক নিম্ন আয়ের মানুষ রাত যাপন করেন

শীতবস্ত্র কিনছেন না কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৫০ টাকার একটা কম্বল দোকানদার ৩০০ টাকা দাম চায়। আমার দিনে ৩০০ টাকা রোজগার করতেই কষ্ট হয়ে যায়। তাহলে আমি কীভাবে কিনবো! তা ছাড়া প্রতিবছর শীতের রাতে অনেকে দেখি কম্বল বা গরম স্যুয়েটার দেয়, তা পেলে এই শীত কেটে যাবে।

একটু এগোতেই দেখা যায় ভোলাগামী লঞ্চ টার্মিনালের সামনে বেশ কয়েকজন হাঁটু মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। তাদের মধ্যে একজন নুরুজ্জামান। তিনি সদরঘাটে কুলির কাজ করেন। গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলায়। স্ত্রী, সন্তান ও বৃদ্ধ মাসহ সাত সদস্যের পরিবার তার।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ১৮ বছর ধরে সদরঘাটে কুলির কাজ করি। স্বল্প আয়ে কোনোরকমে সংসার চলে। যা আয় হয় তা দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা আর সংসার চালাতেই হিমশিম খাই। তার ওপর গত দুই মাসে তেমন কোনও আয় নেই।

নুরুজ্জামান আরও বলেন, এখানে শুয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর কষ্ট লাগে না। বর্ষাকাল ও শীতকালে একটু সমস্যা হয়। তবে মানায় নেওয়া ছাড়া কিছু করার নাই। গ্রামে শীত পড়েছে অনেক। ছেলেমেয়েরা নতুন শীতের পোশাকের জন্য বলে রেখেছে। দু-এক দিনের মধ্যে তাদের জন্য শীতের কাপড় কিনে বাড়ি পাঠাতে হবে। তাদের কেনার আগে আমি কেমনে কিনি বলেন! তবে আমিও কিনবো আরও কিছুদিন পর।

অনেকের প্রত্যাশা, প্রতিবছরের মতো এবারও হয়তো কেউ শীতবস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসবে

কোথাও ভাড়া নিয়ে কেন থাকছেন না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় করে ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া করে বা মেসে থাকা অসম্ভব। মেসে থাকতে গেলে বাড়তি ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা খরচ হবে। সেটা বাড়িতে পাঠালে সংসার ভালো চলবে। তা ছাড়া দুই মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে। সম্বন্ধ আসে কিন্তু অভাব-অনটন দেখে চলে যায়। কিছু টাকা জমিয়েছি তাদের বিয়ে দেবো বলে। আর ছেলেদের একটা জায়গায় পৌঁছে দিতে পারলেই আমার শান্তি। এসব ভেবেই এত বছর লঞ্চ টার্মিনালে রাত কাটাই দিলাম।

বাহাদুর শাহ পার্ক বা এর আশপাশের এলাকায় গেলে দেখা যায়, বছরের পর বছর একই জায়গায় জীবন পার করছে অসংখ্য ভবঘুরে ও পথশিশু। শীত ও বর্ষা— সব সময় দেখা মেলে তাদের। তাদের একজন মো. ফয়সাল (১৩)। বাড়ি ভোলার লালমোহন উপজেলায়। পাঁচ বছর ধরে পার্কে বসবাস করছে। তা মা মারা যাওয়ার পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সৎমায়ের অত্যাচারে ছোটবেলায় বাড়ি ত্যাগ করে। মঙ্গলবার মধ্যরাতে ময়লা একটি চাদর গায়ে দিয়ে বাহাদুর শাহ পার্কের উঁচু বেদিতে শুয়ে কাঁপছিল সে।

বাংলা ট্রিবিউনকে ফয়সাল বলে, নেশা করলে নাকি শীত লাগে না। কিন্তু আমি নেশা করি না। এখানে কয়েকজন নেশা খেয়ে পড়ে থাকে। আমারে খেতে বলে কিন্তু আমি খাই না। এ জন্য নাকি আমার শীত বেশি লাগে। গত শীতে এক বড় ভাই একটা কম্বল দিয়েছিল। কয়দিন পর সেটা চুরি হয়ে গেছে। এখন যেটা গায়ে দিয়ে আছি, এটা ময়লার স্তূপ থেকে খুঁজে এনেছি। এটা দিয়েই এবার শীত পার করতে হবে।

গরম কাপড়ের অভাবে দুর্ভোগে পড়েছেন ভবঘুরে ও নিম্ন আয়ের লোকজন

তাছলিমা আক্তার (১৭) নামের এক ভবঘুরে বছর দুয়েক আগে এক সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এই বাহাদুর শাহ পার্কে। শিশু ছেলেকে নিয়ে এখন ভিক্ষা করে জীবন পার করছেন তিনি। অর্ধযুগ ধরেই এখানে তার বসবাস। তিনিও ছেঁড়া একটা কাপড় দিয়ে কোনোরকমে ছেলেকে নিয়ে শুয়ে ছিলেন পার্কের উঁচু বেদিতে।

শীতের তীব্রতা কেমন, এমন প্রশ্নে হেসে বলেন, আমার তেমন শীত লাগে না। তবে বাচ্চার শীতের কারণে ঠান্ডা লেগে গেছে। ওরে কালকে ডাক্তার দেখিয়েছি। এখানের সবাই আমার ছেলেকে আদর করে। ওরে ঢাকি রাখার জন্য এই ছেঁড়া কাপড়ও আমার কাছে ছিল না। এখানকার একজন আমার ছেলের ঠান্ডা লেগেছে দেখে এটা দিয়েছে। ছেলের বাবা কে, এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান তিনি।

তাছলিমা আক্তারের মতো এখানকার অনেকের প্রত্যাশা, প্রতিবছরের মতো এবারও হয়তো কেউ শীতবস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসবে তীব্র শীত নিবারণের জন্য; যা মুড়ি দিয়ে একটু উষ্ণতা পাবে সুখবঞ্চিত এসব মানুষ।

ছবি: শিতাংশু ভৌমিক অংকুর

/এনএআর/
সম্পর্কিত
৩৫ হাজার রিকশাচালককে ছাতা দেবে ডিএনসিসি
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দিবস আজদায়িত্ব পালনকালে কতটা সুরক্ষা পাচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা
সর্বশেষ খবর
পঞ্চম বারের মতো কমলো সোনার দাম
পঞ্চম বারের মতো কমলো সোনার দাম
নেত্রীর জন্য জান দেবেন আর সিদ্ধান্ত মানবেন না, সেটা উচিত না: দীপু মনি
নেত্রীর জন্য জান দেবেন আর সিদ্ধান্ত মানবেন না, সেটা উচিত না: দীপু মনি
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই বন্ধ করতে পারে: আব্বাস
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই বন্ধ করতে পারে: আব্বাস
টেন মিনিট স্কুলে বিকাশ পেমেন্টে ক্যাশব্যাক
টেন মিনিট স্কুলে বিকাশ পেমেন্টে ক্যাশব্যাক
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে