নড়াইলের নড়াগাতী থানার কলাবাড়িয়া গ্রামের শেখ আনিচুর রহমানের (৪১) ভাই শেখ সোহেল রানার কাছে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে বারবার পরাজিত হয়ে আসছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী জুলফিকার। নির্বাচন ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে তাদের দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সেই জেরে আনিচুরকে ৬ মাস আগে হত্যার পরিকল্পনা করে জাহিদুল। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ৩১ মে বিকালে তাকে ইটের ভাটায় ডেকে নিয়ে শামীম শেখ ও জুলফিকারের নেতৃত্বে হাত-পায়ের রগ কেটে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
মঙ্গলবার (১১ জুন) রাজধানীর কাওরান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল মো. ফিরোজ কবীর এ তথ্য জানান।
এর আগে সোমবার (১০ জুন) রাতে রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় র্যাব-৩ এবং র্যাব-৬ যৌথ অভিযানে প্রধান আসামিসহ ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। আসামিরা হলো- মূল পরিকল্পনাকারী ও অন্যতম প্রধান আসামি জাহিদুল শেখ (৫০), শামীম শেখ (২৫), হাছানুর রহমান রিপন (৫০), জুলফিকার (৪৫), রাশিদুল শেখ (২৪), লিটু (২৮), হিটু (২৫), আজিজ শেখ (২৫), হানিফ শেখ (২৮), মুশফিকুর রহিম (২২), তৈয়েবুর রহমান (৫৫), শরিফুল শেখ (৩৮) ও সাইফুল শেখ (৪০)।
আসামিরা পেশাদার খুনি। তারা বিভিন্ন এলাকায় টাকার বিনিময়ে হত্যাকাণ্ড চালায় বলে জানায় র্যাব।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. ফিরোজ কবীর বলেন, গত ৩১ মে নড়াইল জেলার নড়াগাতী থানার কলাবাড়িয়া এলাকায় শেখ আনিচুর রহমানকে আধিপত্য বিস্তার এবং পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ধাওয়া করে ইট ভাটায় নিয়ে হাত ও পায়ের রগ কেটে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় ২ জুন ভিকটিমের ভাই শেখ সোহেল রানা বাদী হয়ে নড়াগাতী থানায় ৩১ জন এবং অজ্ঞাতনামা ৭/৮ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
তিনি বলেন, গ্রেফতার এড়াতে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আসামিরা নিজ এলাকা ছেড়ে রাজধানীতে আত্মগোপন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব-৩ এর গোয়েন্দা দল পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। আসামিদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে র্যাব-৩ ও র্যাব-৬ যৌথ অভিযান চালিয়ে গতকাল সোমবার রাত ৯টার দিকে রাজধানীর শাহবাগ থানা এলাকা থেকে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীসহ মোট ১৩ জনকে গ্রেফতার করে।
নিহতের ভাই ও মামলার বাদী শেখ সোহেল রানা কলাবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত সদস্য জানিয়ে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক বলেন, আসামি জুলফিকার তার নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে আনিচুরকে উচিত শিক্ষা দিতে জাহিদুল তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে গ্রেফতার মূল পরিকল্পনাকারী জাহিদুল তার সহযোগী হাছানুর রহমান রিপন এবং মঞ্জুর শিকদারের সহায়তায় সুপরিকল্পিতভাবে গত ৩১ মে বিকালে ভিকটিমকে নিজ বাড়ি থেকে ডেকে একটি ইট ভাটার ভেতরে নিয়ে যায়। সেখানে গ্রেফতার শামীম শেখ ও জুলফিকারের নেতৃত্বে রাশিদুল, রহিম, লিটু, হিটু, আজিজ, শহীদ শেখ, ইরফান শেখসহ ১২-১৩ জনের একটি দলকে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত দেখে প্রাণের ভয়ে দৌড়ে ভাটার পাশে বাঁশের বেড়া দেওয়া একটি ঘরে আশ্রয় নেন আনিচুর। যেখানে ওঁৎ পেতে ছিল গ্রেফতার হানিফের নেতৃত্বাধীন মনিরুজ্জামান, সেকন শেখ, নাইম শেখসহ ৪-৫ জনের একটি দল। তারা ধরতে গেলে আনিচুর বেড়া ভেঙে পাশের জমিতে পড়ে যায়। এ সময় হুকুমদাতা ওসিকুর রহমানের নির্দেশে ও মূল পরিকল্পনাকারী জাহিদুলের নেতৃত্বে হাছানুর, শামীম শেখ, জুলফিকার, রাশিদুল ও শিহাব শেখ চাপাতি, ছ্যানদা ও রামদা দিয়ে নৃশংসভাবে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে তাকে হত্যা করে।
লে. কর্নেল ফিরোজ বলেন, এটি একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল ছয় মাস আগে। মূল পরিকল্পনাকারী ছিল গ্রেফতার জাহিদুল ও নির্দেশদাতা ওসিকুর। ছলে-বলে পরিকল্পিতভাবে সুবিধাজনক স্থানে নেওয়ার দায়িত্ব ছিল হাছানুর ও মঞ্জুরের। ইট ভাটায় হত্যার প্রথম প্রচেষ্টা ছিল শামীম শেখ ও জুলফিকারের নেতৃত্বাধীন ১২- ১৩ জনের একটি দলের। দ্বিতীয় প্রচেষ্টা বাস্তবায়নের নেতৃত্বে ছিল গ্রেফতার হানিফের নেতৃত্বাধীন ৪-৫ জনের আরেকটি দল। অবশেষে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয় মূল পরিকল্পনাকারী জাহিদুল ও তার সহযোগী হাছানুর, শামীম শেখ, জুলফিকার, রাশিদুল ও শিহাব শেখসহ অন্য আসামিরা।
গ্রেফতার আসামিদের বিষয়ে তিনি বলেন, আসামি জাহিদুল আনিচুর হত্যা মামলা ছাড়াও বাংলাদেশ জাতীয় কাবাডি দলের খেলোয়াড় কাইয়ূম শিকদার হত্যাসহ ধর্ষণ মামলা ও যৌতুকের মামলার আসামি। জাহিদুল শেখ পেশায় খাবার হোটেল ব্যবসায়ী। আসামি শামীম শেখও জাতীয় কাবাডি দলের খেলোয়াড় হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। তার বিরুদ্ধে নির্বাচনি সহিংসতাকে কেন্দ্র করে নড়াগাতী থানায় চারটি মামলা রয়েছে। শামীম স্থানীয় একটি স্কুলের অফিস সহায়ক। জুলফিকারও বাংলাদেশ জাতীয় কাবাডি দলের খেলোয়াড় কাইয়ুম শিকদার হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। তার বিরুদ্ধে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নড়াগাতী থানায় দুইটি মামলা আছে। সে পেশায় কৃষক।