নারী মুক্তি আন্দোলনের অনুপ্রেরণা জোগানো ৭ নারীর প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন। তাদের কেউ এখন বেঁচে নেই। তারা হলেন– জওশন আরা রহমান, ব্যারিস্টার সালমা সোবহান, অধ্যাপক নাজমা চৌধুরী, সালমা খান, সিগমা হুদা, আয়েশা খানম এবং নাসরীন হক। শনিবার (১৯ এপ্রিল) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়।
জওশন আরা রহমান
জওশন আরা রহমান এদেশের একজন সমাজবিজ্ঞানী ও লেখক। গত বছরের ১১ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। জওশন আরা রহমান ১৯৫২ সালে রচিত একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’র রচয়িতা ভাষাসৈনিক ও কবি মাহাবুব-উল-আলম চৌধুরীর সহধর্মিণী। তিনি গ্রামীণ ট্রাস্টের উপদেষ্টা, গ্রামীণ-শিক্ষা পরিচালনা পরিষদের সদস্য, গণবিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও ট্রেজারার, ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের স্পন্সরশিপে প্রকাশিত বাৎসরিক ‘এডুকেশন ওয়াচ রিপোর্ট’-এর অ্যাডভাইজরি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। এছাড়া বহুবিধ উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
জওশন আরা ১৯৩৬ সালের ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়ার চুনতি গ্রামের মুন্সেফ বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে চট্টগ্রাম নগরের ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় ১৯৫৫-৫৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালে কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিন ‘অন্বেষা’ সম্পাদনা করেন।
১৯৫৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রী সংসদের চট্টগ্রাম জেলা শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ১৯৫৮ সালে বিএ পাস করেন। সমাজকল্যাণ বিভাগে ১৯৬৪-৬৫ সালে চাকরিরত অবস্থায় নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন শহরে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা এবং ১৯৬৭ সালে ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তৎকালীন ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার থেকেও স্নাতকোত্তর করেন।
১৯৭৯ সালে জওশন আরা রহমান ইউনিসেফের নারী কর্মসূচির প্রধান হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি প্ল্যানিং ও মনিটরিং বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পান। ১৯৯৬ সালে ইউনিসেফ থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি রয়েল ড্যানিশ অ্যাম্বাসির টেকনিক্যাল উপদেষ্টা হিসেবে শিশু অধিকার ফোরামের সঙ্গে কাজ করেন। অবসরে যাওয়ার আগে কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিতে (সিআইডিএ) কর্মরত ছিলেন। তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে স্মৃতিকথা ‘একটি অজানা মেয়ে’, ‘মাহবুব উল আলম চৌধুরী স্মরণে বরণে’ উল্লেখযোগ্য।
প্রথমে নারী-উন্নয়ন কর্মসূচি প্রধান এবং পরবর্তীতে প্রোগ্রাম-প্ল্যানিং সেকশনের প্রধান হিসেবে ইউনিসেফে সাড়ে সতেরো বছর কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করেন। এসব কর্মসূচিতে নারীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে তার অবদান সর্বজন স্বীকৃত। এই সুদীর্ঘ সময়ে নারী উন্নয়ন এবং শিশু অধিকার বিষয়ের তার বিভিন্ন লেখা দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় ছাপানো হয়। এর আগে তৎকালীন সমাজকল্যাণ বিভাগে সাড়ে আঠারো বছর বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামে শহর সমাজকল্যাণ অফিসার হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে ১৯৭৫ সালে গ্রামীণ সমাজকল্যাণ ‘মাদার্স ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন।
ব্যারিস্টার সালমা সোবহান
উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম নারী ব্যারিস্টার এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক ছিলেন ব্যারিস্টার সালমা সোবহান। নারী সমাধিকার আন্দোলনের সংগঠক সালমা সোবহান জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৭ সালের ১১ আগস্ট। তার পুরো নাম সালমা রাশেদা আক্তার বানু। সালমা সোবহানের বাবা মোহাম্মদ ইকরামুল্লাহ ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব। তার মা বেগম শায়েস্তা সোহরাওয়ার্দী ইকরামুল্লাহ ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় পরিষদের সদস্য।
সালমা সোবহানের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ইংল্যান্ডের ওয়েস্টনবার্ট স্কুলে। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৮ সালে কেমব্রিজের গির্টন কলেজ থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৯ সালে লিংকন’স ইন থেকে বার এট’ ল সনদপ্রাপ্ত হন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৬২ সালে। ১৯৫৮ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ব্যারিস্টার ডিগ্রি লাভ করেন।
সালমা সোবহান কর্মজীবনের শুরুতেই ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের মেসার্স সারিজ অ্যান্ড বিচেনো ল’ ফার্মে লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালে বিয়ে হওয়ার পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। পরবর্তীতে ১৯৬২ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল’ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া)-র গবেষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট ল’ রিপোর্টসের সম্পাদক ছিলেন।
সালমা সোবহান ব্র্যাকের গ্রামীণ নারী সদস্যদের মধ্যে অধিকার সচেতনতা সৃষ্টি এবং বিরোধ নিষ্পত্তির কাজে আধা-আইনজ্ঞদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্যে একটি আইনি স্বাক্ষরতা কর্মসূচির পরিকল্পনা করেন। তিনি ও তার ৮ জন সহকর্মী মিলে ১৯৮৬ সালে গঠন করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্র। দীর্ঘ ১৫ বছর (১৯৮৬-২০০১) তিনি এই সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার নেতৃত্বে এই সংস্থা একটি নেতৃস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থায় পরিণত হয়।
নারী অধিকার রক্ষায় অবদান রাখার জন্য তিনি ২০০০ সালে ঢাকা ‘অনন্যা’ ম্যাগাজিন পুরস্কার এবং ২০০১ সালে নিউইয়র্কে ‘ল’ইয়ার্স কমিটি ফর হিউম্যান রাইটস পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া নারীদের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তার নামে ’সালমা সোবহান সাংবাদিকতা ফেলোশিপ’ প্রদান করা হয়। সালমা সোবহান রচিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘লিগাল স্ট্যাটাস অব ওমেন ইন বাংলাদেশ’ (১৯৭৫), পিস্যান্টস পারসেপশন অব ল’ (১৯৮১) এবং নো বেটার অপশন? ওমেনট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স (সহলেখক, ১৯৮৮)। সালমা সোবহান ২০০৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
অধ্যাপক নাজমা চৌধুরী
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, একুশে পদকপ্রাপ্ত গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক নাজমা চৌধুরী। দেশের নারীশিক্ষা ও নারী অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বিশেষ অবদান রয়েছে নাজমা চৌধুরীর। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা। তার সম্পাদিত বই ‘উইমেন অ্যান্ড পলিটিকস ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ প্রকাশনা হিসেবে আমেরিকান পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক পুরস্কৃত হয়।
১৯৪২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সিলেট শহরে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন নাজমা চৌধুরী। তার বাবা চৌধুরী ইমামুজ্জামান পুরকৌশলী ছিলেন। বাবার কর্মসূত্রে তিনি ঢাকা, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় পড়াশোনা করেছেন। তার মা আমিরুন্নেসা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। ১৯৬৩ সালে নাজমা চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনায় যোগ দেন। কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে লন্ডন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ওরিয়েনটেল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৭২ সালে দেশে ফিরে আবার অধ্যাপনায় মন দেন। ১৯৮৪-৮৭ সালে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে নারী উন্নয়ন ও রাজনীতি-সম্পর্কিত কোর্স প্রবর্তন করেন। নারীর বৈষম্যমূলক অবস্থান বিশ্লেষণের উদ্দেশে তিনি এসব বিষয়ে এমফিল ও পিএইচডি গবেষণায় উৎসাহিত করেন। তিনি এ বিষয়ে কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী-সম্পর্কিত গবেষণায় উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সেন্টার ফর উইমেন স্টাডিজ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নেন। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালে ফুল ব্রাইট ফেলোশিপের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন মাস ভিজিটিং স্কলার হিসেবে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। তাদের নানা প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়।২০০৩ সালে তিনি পুরোপুরি উইমেন স্টাডিজ বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে এই বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশ সরকারের কর্মপরিকল্পনা তৈরির সার্বিক কাজে নেতৃত্ব দেওয়া, ফলাফল অর্জন করা ও তা বাস্তবায়নের জন্য ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ, শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি। বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেন। ১৯৮০ সালে ইউনেসকো’র সম্মেলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ ছাড়া ১৯৮৫ সালে নাইরোবি বিশ্ব নারী সম্মেলনে তিনি প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা রাখেন। নাজমা চৌধুরী বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা এবং আজীবন সদস্য ছিলেন। উইমেন ফর উইমেনের সাবেক সভাপতি, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি।
২০০৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তাকে ‘রোকেয়া চেয়ার’ সম্মাননায় ভূষিত করে। এর আগে ১৯৯৬ সালে গবেষক হিসেবে অন্যান্য শীর্ষ ১০ পুরস্কার লাভ করেন। তার সম্পাদিত বই উইমেন অ্যান্ড পলিটিকস ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ প্রকাশনা হিসেবে আমেরিকান পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক পুরস্কৃত হয়। ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক ‘প্রফেসর ইমেরিটাস’ পদে উন্নীত হন। একই বছর দেশের অন্যতম সম্মানজনক পুরস্কার ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত হন নাজমা চৌধুরী। ২০২১ সালের ৮ আগস্ট তিনি মারা যান।
সালমা খান
নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ সংক্রান্ত (সিডও) জাতিসংঘ কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন, অর্থনীতিবিদ ও নারী অধিকারকর্মী ছিলেন সালমা খান। কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি।
সালমা খান এনজিও কোয়ালিশন ফর বেইজিং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশনের সাবেক চেয়ারপারসন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিংয়ে ডিপ্লোমা ও যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেন্ডার প্ল্যানিংয়ে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। দেশের জেন্ডার সংবেদনশীলতা, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, সিডও সনদ বাস্তবায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
‘ফিফটি পারসেন্ট: উইমেন ইন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পলিসি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে তার একটি বই আছে। দেশের বিভিন্ন সরকারি অফিসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনে নারী উইংয়ের সূচনা ও বাংলাদেশের পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ম্যাক্রো কাঠামোতে লিঙ্গ সমস্যাকে মূলধারায় আনার জন্য তিনি ভূমিকা রেখেছেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা করেন এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বও পালন করেন।
সালমা খান নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে গবেষণা ও প্রকাশনার জন্য ১৯৯০ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে স্বর্ণপদক পান। ১৯৯৭ সালে শ্রেষ্ঠ নারী প্রশাসক হিসেবে অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার এবং নারীর উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য অসামান্য সেবার স্বীকৃতি হিসেবে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল জিন হ্যারিস পুরস্কারে ভূষিত হন। এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মাননা পেয়েছেন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করা সালমা খান।
সালমা খান নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে গবেষণা ও প্রকাশনার জন্য ১৯৯০ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে স্বর্ণপদক পান। ১৯৯৭ সালে শ্রেষ্ঠ নারী প্রশাসক হিসেবে অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার এবং নারীর উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য অসামান্য সেবার স্বীকৃতি হিসেবে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল জিন হ্যারিস পুরস্কারে ভূষিত হন। এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
সালমা খানের গবেষণায় নারীর শ্রম অধিকার, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, অর্থনৈতিক নীতিতে লৈঙ্গিক সমতার বিষয়টিকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করার মতো বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। এ বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন তিনি। ২০২২ সালের ২ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সিগমা হুদা
সিগমা হুদা প্রয়াত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার স্ত্রী। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সিগমা হুদা ছিলেন বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারপারসন। অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা নারী অধিকার রক্ষায় অগ্ৰণী ভূমিকায় ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ) ও বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএসইএইচআর) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং আইন ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (আইএলডি) প্রতিষ্ঠাতা ও সচিব ছিলেন। তিনি ব্লাস্ট ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসাবে ১৯৯৪-২০০৪ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৭ সালে মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তার জীবন উৎসর্গ করার জন্য ‘পোপ জন পল II ওয়েলস্প্রিং অফ ফ্রিডম’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছিলেন। তাছাড়াও তিনি মানবপাচার সংক্রান্ত জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে সিগমা হুদা প্রচুর কাজ করেছেন। গত বছরের ১৮ জুলাই তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।
আয়েশা খানম
বাংলাদেশে নারী অধিকার আন্দোলনের প্রথম সারির নেতৃত্বে ছিলেন আয়েশা খানম। আয়েশা খানম ১৯৪৭ সালের ১৮ অক্টোবর নেত্রকোনার গাবড়াগাতি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি আমৃত্যু বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ছাত্র জীবন শেষে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি বঞ্চিত, নিপীড়িত নারীদের অধিকার আদায়ে কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন আয়েশা খানম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং নানা আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকায় তিনি অংশ নিয়েছেন। ১৯৬৯-৭০ এর দিকে সমাজবিজ্ঞানে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে থাকতেন এবং তিনি ওই হলের ছাত্র সংসদের সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতিরও দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৬২ সালে পাকিস্তান আমলে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের দাবিতে যে ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে যুক্ত ছিলেন আয়েশা খানম। এছাড়া ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধসহ, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবাধিকার ও প্রগতিশীল সব আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক ছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়ে তিনি ঢাকার শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করার পেছনে ভূমিকা রেখেছেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের শিকার নারীদের পুনর্বাসন এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় তিনি দীর্ঘ জীবন কাজ করে গেছেন৷
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এবং ছাত্রজীবন শেষে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ শুরু করেন আয়েশা খানম। ১৯৭২ সালে তিনি মহিলা পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি সংগঠনটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ২০০২ সাল থেকে ৬৮টি সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সেক্রেটারিয়েটের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।
১৯৯২ সালে ভিয়েনার মানবাধিকার সম্মেলন এবং ১৯৯৫ সালে বেইজিং-এর বিশ্ব নারী সম্মেলনে তিনি অংশ নেন। এছাড়া ২০১১ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত সিডও কমিটির এবং কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অব উইমেন-এর বিভিন্ন অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছেন। নারী ইস্যুতে পত্র পত্রিকায় লেখালেখিও করতেন তিনি। ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি তিনি মারা যান।
নাসরীন হক
নারী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী, সমাজসেবক ও সংগঠক নাসরীন হক। তিনি ‘নারীপক্ষ’ নামের সংগঠনের অন্যতম সংগঠক। ১৯৫৮ সালের ১৮ নভেম্বর তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা প্রকৌশলী মোহাম্মদ রফিকুল হক ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। মায়ের নাম জাহেদা খানম।
নাসরীনের প্রাথমিক শিক্ষা ঘরেই সম্পন্ন হয়। এরপর তিনি ঢাকা হলিক্রস স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৭৬ সালে এই স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাশ করেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ডালাস শহরের ‘হকাডে’ নামক একটি প্রাইভেট স্কুলে বৃত্তি নিয়ে লেখাপড়া করতে যান। এই স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে, তিনি টেক্সাসের হিউস্টন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরে এই বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে তিনি স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্ক পারচেইজ-এ ভর্তি হন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে তিনি বার্কলি’র ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া-তে ভর্তি হন এবং পুষ্টিবিজ্ঞানে মাস্টার্স পাশ করেন।
১৯৮৮ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে আসেন। ওই বছরে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হলে, তিনি বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ান। কিছু সহকর্মী নিয়ে তিনি নিজে বন্যার্তদের জন্য খাবার তৈরিকরণ এবং তা বিতরণের ক্ষেত্রে সশরীরের কাজ করেছেন। একই সাথে তিনি পানি শুদ্ধিকরণ উপকরণাদি প্রদানসহ প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র বিতরণ করেছেন। ১৯৮৮ সালে তিনি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকে গবেষক হিসাবে যোগদান করেন। এই সময় গ্রামবাংলার মানুষের পুষ্টির জন্য করণীয় বিষয় সম্পর্কে নানা ধরণের কার্যক্রম চালান। বিশেষ করে গৃহস্থদের সবজির বাগান করার বিষয়ে উৎসাহী করে তোলেন এবং এই বিষয়ে সহযোগিতা করেন।
১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর তিনি হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে-এ সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার হিসাবে যোগদান করেন। এই সময় তিনি এই সংস্থা এবং সরকার, দাতাগোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়নমূল সংস্থার মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। এই সময়ে তিনি অ্যাসিড দগ্ধ নারীদের পাশে এসে দাঁড়ান। তাঁর উদ্যোগের সূত্রে পরবর্তী সময়ে তৈরি হয়েছে ‘এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন’।
২০০২ সালে একটি বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানির বিজ্ঞাপন নিয়ে ‘ভয়েজ অব ডিসকভারি’ নামক জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করার চেষ্টা করলে তিনি তাঁর বিরোধিতা করেন। বন্দরের ১৪ নম্বর জেটির সামনে তিনি মানববন্ধনের মাধ্যমে প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেন। এই জাহাজটি শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করেনি।
২০০৩ সালে তিনি অ্যাকশান এইড বাংলাদেশ-এ যোগদান করেন। এই সংস্থায় কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসাবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ২০০৬ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।