গত বছর ১০ লাখেরও বেশি কর্মী বিদেশে গেছেন কাজের উদ্দেশে। এদের মধ্যে বেশিরভাগেরই গন্তব্য ছিল মধ্যপ্রাচ্য। গত বছর প্রবাসী কর্মী মৃত্যুর সংখ্যা এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ২০২৪ সালে বিদেশ থেকে প্রবাসীর লাশ এসেছে ৪ হাজার ৮১৩টি। ২০২৩ সালের তুলনায় এই সংখ্যা বেড়েছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। প্রবাসীদের মৃত্যুর ঘটনা বেশিরভাগই ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ উল্লেখ করা হলেও এর প্রকৃত কারণ কেউ জানে না। তাই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদঘাটনে দেশেই ময়নাতদন্ত করার প্রস্তাব করেছেন বক্তারা।
বৃহস্পতিবার (২৯ মে) রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উদ্যোগে আয়োজিত এক সংলাপে এসব পরামর্শ উঠে আসে।
২০২২ সালের রামরু’র এক গবেষণা অনুযায়ী, ৪৮ শতাংশ পরিবার মৃত্যু সনদে দেওয়া মৃত্যুর কারণকে সঠিক মনে করেন না। তাদের এমন মনে করার পেছনে রয়েছে— শরীরে ক্ষত চিহ্ন, পরিবারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা ও শারীরিক নির্যাতনের তথ্য।
কর্মের উদ্দেশ্যে বিদেশে গিয়ে যারা লাশ হয়ে ফিরেছেন, তাদের মৃত্যুসনদ অনুযায়ী ৩১ শতাংশ দুর্ঘটনায়, আত্মহত্যায় অথবা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে মারা গেছেন। ২০২৪ সালে ৪ হাজার ৮১৩ জন বাংলাদেশির মৃতদেহ দেশে এসেছে। এদের মধ্যে ৯৪.৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৩.৬ শতাংশ নারী কর্মী।
সভায় রামরু’র ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে প্রবাসী কর্মীদের মৃত্যু কমাতে করণীয় নিয়ে সুপারিশ চাওয়া হয়েছে। আমরা আজকের সভা থেকে উঠে আসা সুপারিশগুলো সরকারের কাছে পাঠানো হবে।
তিনি বলেন, প্রবাসীদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে লাশ পরিবহনে কিছু প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব, সেই জায়গা থেকে আমরা আলোচনা করতে চাচ্ছি। প্রবাসী কর্মীরা তাদের গন্তব্য দেশে মৃত্যুবরণ করছেন। আমরা ২০২২ সালে একটি গবেষণা করেছিলাম, তখন কিছু সুপারিশ করেছিলাম আমরা। এই যে মৃত্যুগুলো হচ্ছে, এগুলো কি সব স্বাভাবিক বা এরকমই হওয়ার কথা ছিল? যারা মারা যাচ্ছেন তাদের মৃত্যুর কারণগুলো কী। আমরা চাচ্ছি কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরতে, যাতে করে অপ্রত্যাশিত মৃত্যু কমিয়ে আনা যায়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সচিব সেবাস্টিন রেমা বলেন, যেকোনও মৃত্যুই অনাকাঙ্ক্ষিত, তবে অভিবাসীদের মৃত্যু গভীরভাবে বেদনাদায়ক। এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু রোধে বিষয়টি অভিবাসী গ্রহণকারী দেশগুলোসহ বিভিন্ন বহুপাক্ষিক ফোরামে তুলে ধরা যেতে পারে। মৃত্যু সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক প্রোটোকলগুলো যেকোনও সমঝোতা স্মারকের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, ড. নেয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, শ্রমিকের অধিকার অনেকটাই বৈশ্বিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল হলেও দেশের ভেতরে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের মাধ্যমে আমরা মৃত ব্যক্তির লাশ যথাযথ মর্যাদায় ব্যবস্থাপনা করতে পারি।
তিনি আরও বলেন, এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলোই একদিন বড় পরিবর্তনের স্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠবে।
মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব সেলিম রেজা বলেন, বিদেশ থেকে লাশ ফেরত আনায় দীর্ঘসূত্রতা অনেকটাই কমেছে, তবে এটি আরও কার্যকরভাবে পরিচালনা করা সম্ভব। সচেতনতার অভাবে অনেক কর্মী রাস্তায় ভুলভাবে পারাপার করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। এক্ষেত্রে সচেতনতার বিকল্প নেই।
বিএমইটি’র পরিচালক মাসুদ রানা মনে করেন, রেইজ প্রকল্পসহ বিভিন্ন পুনর্বাসন প্রকল্পে মৃত অভিবাসীর পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক এটিএম আব্দুর রউফ মন্ডল জানান, তিনি দ্রুত একটি সার্কুলার জারি করবেন, যার মাধ্যমে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোকে জানানো হবে যে, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তহবিল থেকে লাশ প্রত্যাবর্তন সম্ভব না হলে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব বাজেট ব্যবহার করে দ্রুত লাশ দেশে ফেরত আনা যাবে।
তিনি আরও বলেন, পূর্বে কার্গোতে আসা অন্যান্য মালামালের মধ্যেই কফিন পাঠানো হতো এবং যারা লাশ গ্রহণ করতে আসতেন, তাদের বসার নির্ধারিত স্থান থাকতো না। ২০২২ সালের রামরু গবেষণার ভিত্তিতে, এনএইচআরসি ও মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ অনুযায়ী, মৃতদেহ রাখার নির্ধারিত স্থান এবং পরিবারের সদস্যদের জন্য বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রেও হয়রানি কমে এসেছে।
একজন পরিবার সদস্য লাশ দাফন করতে গিয়ে গাড়িচাপায় মৃত ব্যক্তির পেটে বড় কাটা দেখে ময়নাতদন্ত করালে জানা যায়, তার কিডনি শরীর থেকে অপসারণ করা হয়েছে। এই বাস্তবতায় প্রফেসর ড. কামরুল হাসান, ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেন যে, মৃত্যুর কারণ নিয়ে সন্দেহ থাকলে দেশে পুনরায় ময়নাতদন্ত করা যেতে পারে।
সংলাপে আরও অংশগ্রহণ করেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালক মুহাম্মদ ইকরাম উল্লাহ, বায়রার সাবেক মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি সারোওয়াত মেহজাবিন এবং ওয়ারবে, ওকুপ, বিএনএসকে, প্রত্যাশী, সিসিডিএ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বিএনডব্লিউএলএ-এর প্রতিনিধি, আইনজীবী এবং অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
সংলাপটি হেলভেটাস বাংলাদেশ এবং সুইস দূতাবাসের সহায়তায় বাস্তবায়িত সিমস প্রকল্পের আওতায় অনুষ্ঠিত হয়।