X
শনিবার, ০৭ জুন ২০২৫
২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পর্কে যা বলা হয়েছে গুম কমিশনের দ্বিতীয় প্রতিবেদনে

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
০৫ জুন ২০২৫, ১৬:৫৬আপডেট : ০৫ জুন ২০২৫, ১৬:৫৬

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের কর্মকাণ্ড বিস্তারিত তুলে ধরে সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে গুম কমিশন। বুধবার (৪ জুন) ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: অ্য স্ট্রাকচারাল ডায়াগনোসিস অব এনফোর্স ডিজঅ্যাপায়েরেন্স অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে গুম কমিশনের এই প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে  জমা দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার (৫ জুন) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে প্রতিবেদনটি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে।

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কমিশন মোট ১৮৩৭টি অভিযোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ১৭৭২টি কেস কমিশনের ডাটাবেজে অ্যাকটিভ হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে।  এগুলোর মধ্যে ১৪২৭ জন বেঁচে আছেন, ৩৪৫ জন এখনও নিখোঁজ।

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু ইউনিটের সম্পক্ততা পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এর মধ্যে পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি, সিটিটিসি ৬৭ শতাংশ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এছাড়া অনেক ঘটনায় বিশেষায়িত গোয়েন্দা ইউনিট ডিজিএফআই ও এনএসআই যৌথ অপারেশন করেছে। মাঝেমধ্যে এসব অপারেশনে বিজিবিও যুক্ত হয়েছে। যদিও গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে ডিজিএফআই এবং এনএসআই কাউকে গ্রেফতার বা অপারেশন পরিচালনা করার কথা নয়। এটি তাদের কাজও নয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশের বিরুদ্ধে এমনিতেই ক্রসফায়ারের পুরনো অভিযোগ রয়েছে। মাদকবিরোধী অভিযানের নামে নির্বিচারে তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করেছে। হেফাজতে বা রিমান্ডে নিয়ে নানা কৌশলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে। যদিও হেফাজতে নির্যাতন দমন আইন রয়েছে, কিন্তু এটি খুব কমই প্রয়োগ হতো। গুম কমিশন পুলিশের বিরুদ্ধে শত শত ভিক্টিমকে নির্যাতনের অভিযোগ পেয়েছে, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও সরকারের সমালোচক অন্যতম। গুমের শিকার অনেককেই নির্যাতনের পর বিচার-বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে— যা পুলিশের ধারাবাহিকভাবে দায়মুক্তি, পদ্ধতিগতভাবে আইনের অপব্যবহার এবং প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি না থাকায় এসব ঘটেছে।

র‌্যাবকে অর্থবহ করতে হলে এটি বিলুপ্ত করতে হবে

র‌্যাবের বিরুদ্ধে সরাসরি অসংখ্য জোরপূর্বক গুম, হেফাজতে নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ পাওয়া গেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নথিভুক্ত অনেক ঘটনায় র‌্যাব তুলে নেওয়ার পর তাদের মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট ও যুক্তরাজ্যের সহযোগিতায় যদিও র‌্যাব গঠিত হয়েছিল সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের জন্য, কিন্তু তারা ক্রমশ ‘পলিটিক্যাল ডেথ স্কোয়াডে’ পরিণত হয়েছে। র‌্যাবের ধারাবাহিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় এক দশক আগেই যুক্তরাজ্য তাদের সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছিল। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের স্যাংশন জারি করে।

র‌্যাবের সবচেয়ে জঘন্য কর্মকাণ্ড হলো— টিএফআই সেলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা। যদিও সবাই জানে যে, সব সংস্থাই এই সেলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু এটি এককভাবে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা নিয়ন্ত্রণ করতো। র‌্যাব-১ এর কার্যালয়ে অবস্থিত এই টিএফআই সেলে হাজার হাজার মানুষকে দিনের পর দিন হাত-পা ও মুখ বেঁধে, অন্ধকার একটি কক্ষে ফেলে রাখা হতো।

গুম কমিশন এমন সাক্ষ্য পেয়েছে, এই সেলে ইলেকট্রিক শকসহ নারকীয় কায়দার আটককৃতদের নির্যাতন করা হতো। এমনকি শিশু ও মানসিকভাবে অস্বাভাবিক মানুষও এই নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি। সেনা সদস্যদের দ্বারা এটি পরিচালিত হলেও এখানে মাঝেমধ্যে পুলিশও অংশ নিতো। সারা দেশ থেকে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে তুলে এনে এই টিএফআই সেলে রাখতো। এছাড়া ডিজিএফআই এবং র‌্যাবের ব্যাটালিয়ান থেকে এখানে টার্গেটকৃত লোকজনকে ধরে ধরে পাঠানো হতো। অনেক ঘটনায় টিএফআই সেলে বন্দি থাকা ব্যক্তিদের হত্যার পর নদীতে লাশ ফেলে দেওয়া হতো।  ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে টিএফআই সেলের আলামতগুলো নষ্ট করার প্রমাণ পেয়েছে কমিশন। কমিশন মনে করে, বাহিনী হিসবে র‌্যাবকে অর্থবহ করতে হলে এটি বিলুপ্ত করতে হবে। দায়মুক্তির চক্র ভাঙতে, জনসাধারণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে এবং অধিকার-সম্মানজনক নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি করতে এর বিলুপ্তি অপরিহার্য।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়নের যন্ত্র ছিল ডিবি

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের আমলে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ বা ডিবি পুলিশকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়নের বড় একটি যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের কাজ ছিল রাজনৈনিতক প্রতিপক্ষকে টার্গেট করা, বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের। নির্বাচনের সময়ে এটি বেশি করা হতো। তাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট সংখ্যক গুমের অভিযোগও রয়েছে। ডিবির কাজ ছিল সাদা পোশাকে অভিযান চালিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তুলে এনে অজানা জায়গায় রেখে দেওয়া, সপ্তাহ বা মাস খানেক পর ভিক্টিমদের অনেকেই নির্যাতনের চিহ্নসহ ফিরে এলেও অনেককেই মৃত অবস্থায়ও পাওয়া গিয়েছে। এককভাবে অভিযানের পাশাপাশি র‌্যাব ও ডিজিএফআইয়ের সঙ্গে তারা যৌথ অপারেশনও পরিচালনা করেছে।

কমিশন মনে করে, ডিবি পুলিশের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। প্রতিটি ঘটনায় স্বাধীন তদন্ত ও বিচারিক জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

বিচারব্যবস্থাকে আইনি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে সিটিটিসি

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে গঠিত বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের মূল উদ্দেশ্য ছিল— সন্ত্রাসবাদ, সংগঠিত অপরাধ এবং আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমন। যদিও সিটিটিসি নিরাপত্তা হুমকির বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের দাবি করে আসছে, তবে এটি ইতোমধ্যে র‍্যাবসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর মতো মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দায়মুক্তির অভিযোগে জর্জরিত হয়ে উঠেছে। অন্যান্য সংস্থার তুলনায় অপেক্ষাকৃত স্বল্প সময়ে আটকের অভিযোগ থাকলেও, সিটিটিসি সদস্যরা বিচার ব্যবস্থার অপব্যবহার করে গুরুতর ক্ষতি সাধনের অভিযোগে অভিযুক্ত। তারা মিথ্যা মামলার মাধ্যমে বিচারব্যবস্থাকে ‘আইনি অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। র‍্যাবের মতোই সিটিটিসিও সন্ত্রাসবাদবিরোধী কার্যক্রমের নামে বিদেশি সরকারের সহায়তা পেয়েছে।  তবে এই আন্তর্জাতিক সহায়তা সিটিটিসিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পথ থেকে বিরত রাখতে পারেনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিটিটিসির বিরুদ্ধে গুম, নির্যাতন ও নির্বিচারে আটক করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো ‘সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী বা অপরাধী’ আখ্যা দিয়ে ব্যক্তিদের গুম করার ঘটনা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। কমিশনের তথ্যমতে, অনেকেই গুমের শিকার হয়ে নির্জন অবস্থানে আটক থেকেছেন, যেখানে তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে তথাকথিত জিজ্ঞাসাবাদের নামে। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে সাজানো অভিযোগ আনা হয়েছে, অথবা তারা আর কখনও ফিরে আসেননি। জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগও রয়েছে, যা বিচারিক প্রক্রিয়া এবং তদন্তের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

বিশেষভাবে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট (বা সংশ্লিষ্ট বলে চিহ্নিত) ব্যক্তিদের প্রমাণ ছাড়া আটক করা সিটিটিসির বিরুদ্ধে একটি নিয়মিত অভিযোগে পরিণত হয়েছে। অনেকেই একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, যা প্রকৃত নিরাপত্তা হুমকি প্রতিরোধের সঙ্গে সম্পর্কহীন। নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের বৈষম্যের শিকার বলে মনে করছেন, যা সামগ্রিকভাবে ক্ষোভ ও অবিচারের মনোভাবকে উসকে দিচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিটিটিসির কার্যক্রমে স্বচ্ছতার ঘাটতি প্রকট। তাদের অভিযান বা সাফল্য নিয়ে জনসাধারণের সামনে তথ্যপ্রবাহ নেই বললেই চলে। গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কার্যকর জবাবদিহি বা বিচারের নজির নেই। বেআইনি আটক, নির্যাতনের মতো অপরাধে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও শাস্তির সম্মুখীন হন না। এর ফলে বাহিনীর ভেতরে একটি দায়মুক্তির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যা এক সময়ের আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত র‍্যাবের অবস্থা মনে করিয়ে দেয়।

কমিশনের পর্যবেক্ষণ বলছে, একটি নিরপেক্ষ সন্ত্রাসবিরোধী সংস্থা হিসেবে কাজ করার বদলে সিটিটিসিকে সেই একই দমনমূলক পদ্ধতি ও দায়মুক্তির চর্চা অনুসরণ করছে, যেগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এক সময়ে কড়া ভাষায় নিন্দা করেছিল। র‍্যাবের অভিজ্ঞতা যদি সতর্কবার্তা হয়ে থাকে, তবে সিটিটিসি আজ সেই একই মোড়ে দাঁড়িয়ে— যেখানে অপরিকল্পিত ক্ষমতা, বিদেশি সহায়তা ও রাজনৈতিক অপব্যবহার মিলেমিশে এক বিপজ্জনক অবস্থার জন্ম দিয়েছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘন ও জনগণের আস্থাহীনতার কারণ হয়ে উঠেছে।

বিতর্কিত আয়নাঘর গণতন্ত্রের জন্য হুমকি

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই গত এক দশকে ব্যাপকভাবে গুম, বেআইনি আটক, নির্যাতন এবং রাজনৈতিকবিরোধীদের নজরদারির অভিযোগের মুখে পড়েছে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে হস্তক্ষেপসহ ঘরোয়া রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ডিজিএফআই এর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অধীন থাকা সংস্থাটির ওপর কোনও সংসদীয় নজরদারি না থাকায়, এর অপারদর্শিতা ও লাগামহীন ক্ষমতা নিয়ে সমালোচনা বেড়েছে।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টে ডিজিএফআই এর বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ উঠে এসেছে। বিশেষ করে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় অবস্থিত ‘আয়নাঘর’ (জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল বা জেআইসি) নামে পরিচিত গোপন আটক কেন্দ্রটির নাম কুখ্যাত হয়ে উঠেছে। এখানে আটক ব্যক্তিদের দীর্ঘ সময় অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সামরিক কর্মকর্তা, বিরোধী দলের নেতাকর্মী এবং কথিত সন্ত্রাসবাদে অভিযুক্ত ব্যক্তিসহ বহু সাধারণ মানুষ।

প্রতিবদেনে বলা হয়েছে, ডিজিএফআই  এর নিজস্ব সক্ষমতা সীমিত হওয়ায় তারা অনেক ক্ষেত্রেই অপারেশন চালাতে র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার সহায়তা নিতো। আটক ব্যক্তিদের র‍্যাবের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হতো, অথবা গোয়েন্দা শাখায় হস্তান্তর করা হতো, যেখানে অনেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন বা দীর্ঘদিন সাজানো মামলায় আটক ছিলেন। ‘আয়নাঘর’ ছিল সেনা কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত একটি গোপন জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্র, যেখানে কয়েকটি নির্যাতন কক্ষ ছিল। সেখানে মারধর, উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা, বৈদ্যুতিক শক, ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসিয়ে বিভ্রান্ত করা, জোরালো শব্দে ফ্যান চালিয়ে চিৎকার ঢেকে রাখা, চোখ বাঁধা ও শিকল পরিয়ে রাখার মতো পদ্ধতিতে দীর্ঘ সময় ধরে নির্যাতন চালানো হতো। এই কেন্দ্র থেকে বেঁচে ফেরা অনেকেই আজও মারাত্মক মানসিক ট্রমায় ভুগছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদিও ডিজিএফআই জাতীয় নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তবে বেসামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের ওপর এর বাড়তে থাকা প্রভাব গণতান্ত্রিক শাসন ও নাগরিক অধিকারগুলোর জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে জরুরি সংস্কার না আনলে, ডিজিএফআই একটি পেশাদার ও অরাজনৈতিক সংস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে কাজ করার বৈধতা হারাতে পারে।

জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত এনএসআই

প্রতিবদেনে বলা হয়েছে, ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স বা এনএসআই বাংলাদেশ সরকারের প্রধান বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। সংস্থাটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ধরনের গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এর কাজের পরিধির মধ্যে রয়েছে জাতীয় নিরাপত্তা, পাল্টা গোয়েন্দাগিরি, সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতা, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের নজরদারি, সীমান্ত গোয়েন্দা কার্যক্রম এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় হুমকির পর্যবেক্ষণ। এনএসআই এর কার্যক্রম অনেকাংশে ডিজিএফআই ও স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) সঙ্গে মিলিত হওয়ায় কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব, অপ্রয়োজনীয় পুনরাবৃত্তি এবং আন্তঃসংস্থাগত বিরোধ তৈরি হয়েছে। সংস্থাটির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিকীকরণের কারণে। অভিযোগ রয়েছে, এনএসআই রাজনৈতিক বিরোধী, সিভিল সোসাইটি এবং সাংবাদিকদের নজরদারির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে, যা জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত।

এনএসআই-এর ক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা এবং জবাবদিহি সংক্রান্ত কোনও স্পষ্ট আইনগত কাঠামো নেই। এটি কোনও স্বাধীন সংসদীয় বা বিচার বিভাগীয় তদারকির আওতায় পড়ে না, ফলে এই সংস্থার লাগামহীন ক্ষমতা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কমিশনের কাছে আসা অভিযোগে এনএসআইকে গুমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এনএসআই এর বিরুদ্ধে নির্যাতনসহ অন্যান্য লঙ্ঘনের অভিযোগও এনেছে, তবে এর গোপনীয় কার্যক্রমের কারণে ভুক্তভোগীদের জন্য আইনি সহায়তা পাওয়া অত্যন্ত কঠিন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদিও এনএসআই জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় এবং সন্ত্রাসবিরোধী গোয়েন্দা তৎপরতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, তবে এর কার্যক্রম রাজনৈতিক প্রভাব, স্বচ্ছতার অভাব, তদারকির দুর্বলতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো গুরুতর সমস্যায় জর্জরিত। একটি আধুনিক, জবাবদিহিমূলক এবং মানবাধিকারসম্মত গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে এনএসআইকে গড়ে তুলতে হলে এর আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় ব্যাপক সংস্কার জরুরি।

বিজিবির বিরুদ্ধেও গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সাল থেকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো, যেমন- হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিজিবিসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ এনেছে। বিশেষত ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় এসব অভিযোগ বেশি উঠে এসেছে, যেখানে তথ্যপ্রবাহ সীমিত এবং সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার বাধাগ্রস্ত। এসব এলাকায় বিজিবি অভিযানের সময় বহু নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যার সঠিক তথ্যপ্রমাণ প্রায়ই সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের অনেক ঘটনা আন্তঃসীমান্ত প্রকৃতির হওয়ায় এটি একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এমন অভিযোগ রয়েছে যে, কখনও কখনও এক দেশে অপহরণ করা ব্যক্তি আরেক দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়, যা দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়। কমিশনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) এবং বিজিবি'র মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমেই এমন ‘ক্রস-বর্ডার রেন্ডিশন’ বা সীমান্ত পেরিয়ে আটক হস্তান্তরের ঘটনা ঘটেছে। শুখরঞ্জন বালি, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ, মেহেদী হাসান ডলার এবং রাহমতুল্লাহর মতো ব্যক্তিদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা এই ধরনের আন্তঃসীমান্ত হস্তান্তরের প্রমাণ হিসেবে উঠে এসেছে। কমিশনের কাছে দেওয়া সাক্ষ্যে জানানো হয়েছে, র‍্যাব সাধারণত আগে থেকেই বিজিবিকে নির্দিষ্ট সীমান্ত অঞ্চলের তথ্য জানাতো, যেখানে কয়েকশ মিটার ভিতরে ভারতের ভূখণ্ডে গিয়ে বন্দিদের হস্তান্তর করা হতো।

যদিও বিজিবি জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কিন্তু এই বাহিনীর বিরুদ্ধে বারবার গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও আইনের শাসনের প্রতি জনআস্থাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। জবাবদিহির অভাবে এই ধরনের অপব্যবহার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করে, যা গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং নাগরিক অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলে। তাই, বিজিবি ’র কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, মানবাধিকারভিত্তিক সংস্কার এবং কঠোর জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।

/এনএল/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
দ্বিতীয় প্রতিবেদনে চাঞ্চল্যকর তথ্যগুম কমিশনের সদস্যদের হুমকি-কাজে বাধা, প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা
গুম সংক্রান্ত প্রতিবেদন ওয়েবসাইট ও বই আকারে প্রকাশের তাগিদ প্রধান উপদেষ্টার
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ট্রাইব্যুনালের বিচার অব্যাহত থাকবে: সালাহ উদ্দিন
সর্বশেষ খবর
চট্টগ্রামের ঈদুল আজহার প্রধান জামাতে মুসল্লিদের ঢল
চট্টগ্রামের ঈদুল আজহার প্রধান জামাতে মুসল্লিদের ঢল
সিঙ্গাপুরকে হারিয়ে দেশবাসীকে ঈদ উপহার দিতে চান কাবরেরা 
সিঙ্গাপুরকে হারিয়ে দেশবাসীকে ঈদ উপহার দিতে চান কাবরেরা 
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সস্ত্রীক নৌবাহিনী প্রধানের সাক্ষাৎ
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সস্ত্রীক নৌবাহিনী প্রধানের সাক্ষাৎ
ঈদের দিন দুপুরে বৃষ্টি, কোরাবানিতে সামান্য ব্যাঘাত ঘটলেও গরমে স্বস্তি
ঈদের দিন দুপুরে বৃষ্টি, কোরাবানিতে সামান্য ব্যাঘাত ঘটলেও গরমে স্বস্তি
সর্বাধিক পঠিত
এবার ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা তালিকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ৪ বিচারক
এবার ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা তালিকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ৪ বিচারক
বিমানযোগে ঢাকায় এলো কসাই দল
বিমানযোগে ঢাকায় এলো কসাই দল
প্রধান উপদেষ্টার শব্দ চয়ন রাজনৈতিক ভব্যতার সীমা অতিক্রম করেছে: বিএনপি
ডিসেম্বরেই নির্বাচনের দাবিতে অনড়প্রধান উপদেষ্টার শব্দ চয়ন রাজনৈতিক ভব্যতার সীমা অতিক্রম করেছে: বিএনপি
সাকিবের ‘অভিযোগ’ নিয়ে তামিম বললেন, ‘ব্যাপারটা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে’
সাকিবের ‘অভিযোগ’ নিয়ে তামিম বললেন, ‘ব্যাপারটা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে’
এপ্রিলে জাতীয় নির্বাচন: প্রধান উপদেষ্টা
এপ্রিলে জাতীয় নির্বাচন: প্রধান উপদেষ্টা