প্রধান বিচারপতির দায়িত্বগ্রহণের পর প্রথম অভিভাষণে বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ তুলে ধরেছিলেন ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয়, বিভাগটির কাঠামোগত সংস্কারসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থান পেয়েছিল তার সেই রোডম্যাপে। সেই অভিভাষণের পর থেকে রোডম্যাপ বাস্তবায়নে নিরলস দায়িত্বপালন করে চলেছেন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা।
২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতির ঘোষিত রোডম্যাপে তিনি স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় একগুচ্ছ প্রস্তাবনা তুলে ধরেছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘একটি ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থার কাজ হলো— নিরপেক্ষভাবে, স্বল্প সময় ও খরচে বিরোধের মীমাংসা নিশ্চিত করে জনগণ, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেওয়া। এজন্য বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা থেকে পৃথক ও স্বাধীন করা সবচেয়ে জরুরি। কেননা, শাসকের আইন নয়, বরং আইনের শাসন নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের মূল দায়িত্ব। বিচার বিভাগ যেন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে, তার জন্য আমি জরুরি ভিত্তিতে বিচার বিভাগে কিছু সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা কামনা করছি। এই সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে— বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, তা দ্রুত দূর করে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী, আধুনিক, দক্ষ ও প্রগতিশীল বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘বিচারকদের প্রকৃত স্বাধীনতা ততদিন পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না, যতদিন না বিচার বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা, অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটি হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রথম ধাপ।’
এছাড়াও তিনি সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সংবিধানের কোনও সংশোধন না করেই শুধু রুলস অব বিজনেস এবং বিচারকদের নিয়োগ, কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, বরখাস্তকরণ, শৃঙ্খলা বিধান ইত্যাদি সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত যেসব বিধিমালা প্রচলিত রয়েছে— সেগুলোতে প্রদত্ত ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের’ সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনে সেখানে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের সচিবকে অন্তর্ভুক্ত করলেই সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় তথা বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পথে আইনগত কোনও বাধা থাকবে না বলেও মন্তব্য করেছিলেন। পাশাপাশি বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দকরণ, অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি ও পদায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকল্পে এ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিচার বিভাগে মেধার চর্চার উন্মেষ, উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়ন, সব ধরনের দুর্নীতি বিলোপের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক বিচারসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারে উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে তিনি তার ঘোষিত রোডম্যাপে দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
সেই রোডম্যাপ ঘোষণার পর ১০ মাসের বেশি সময় পার হলেও পুরোপুরি দৃশ্যমান করা সম্ভব হয়নি বিচার বিভাগের জন্য পৃথক কোনও সচিবালয়। তবে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত এই পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় রয়েছে কিছুটা অগ্রগতি। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোডম্যাপের বিভিন্ন দিক নির্দেশনার বিশেষ অগ্রগতির মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট থেকে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব এবং স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশের খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। এখনও খসড়াটি মন্ত্রণালয়ে আছে। এ নিয়ে কাজটি মন্ত্রণালয়ে চলমান রয়েছে।’
জানা গেছে, এই পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, ছুটি ইত্যাদি বিষয়ে প্রচলিত দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটবে এবং বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা।
তবে প্রধান বিচারপতির ঘোষিত রোডম্যাপের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন, সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন এবং প্রক্রিয়াধীন করার বিষয়টি বেশ প্রশংসনীয় হয়েছে। যার ফলে কোনও বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলে কাউন্সিলের সুপারিশ অনুসারে রাষ্ট্রপতি পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন।
এছাড়া বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির খসড়া নীতিমালা তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে। এই নীতিমালা চূড়ান্ত হলে বিচারকদের মনে বদলি বা পদোন্নতির বিষয়টি একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে এবং এতে করে তারা স্বাধীনভাবে বিচারিক ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারবেন বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসবের বাইরেও পুরনো দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনসহ বেশকিছু আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। তবে প্রধান বিচারপতি ঘোষিত রোডম্যাপের স্বপ্নপূরণ বাস্তবায়নে প্রধান প্রতিবন্ধকতা পৃথক সচিবালয় প্রস্তুত না হওয়া। তাই পৃথক সচিবালয় গঠিত হলে স্বাধীন বিচার বিভাগ নিয়ে দীর্ঘদিনের আশা-আকাঙ্ক্ষার অধরা সেসব পরিকল্পনা দ্রুতই দৃশ্যমান ও কার্যকর হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার প্রথম কথা হলো— আমাদের কথার সঙ্গে কাজের মিল থাকতে হবে। এসব সরকারি কাজ। অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে কাজ করবে, তা তাদের ওপর নির্ভর করছে। এখানে আমাদের আইনজীবীদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না। তারপরও এই রোডম্যাপের সফলতা কামনা করছি।’
রেডম্যাপের অংশ হিসেবে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হতে পারে— এমন শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘পৃথক সচিবালয় করতে সংবিধানিক বিধানের সংশোধন করা দরকার। কিন্তু দেশে এ মুহূর্তে পার্লামেন্ট নেই। সেহেতু সরকার সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি এড়িয়ে কীভাবে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় করবে, তা নিয়ে আমার শঙ্কা আছে। এটাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতেই সংবিধান সংশোধনীর দরকার। নয়তো বিষয়টি ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জের মুখে পরতে পারে বলে আমি মনে করছি।’