কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার এক গ্রামে ২৫ বছর বয়সী এক নারীকে ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে ধর্ষণ এবং সেই নারকীয় ঘটনার ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় সারা দেশে নিন্দা ও ক্ষোভের ঝড় উঠেছে। বর্বর এই অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় তিনটি মানবাধিকার সংগঠন—গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) ও নারীপক্ষ।
রবিবার (২৯ জুন) সংগঠনগুলো পৃথক বিবৃতিতে এই ঘটনার কঠোর নিন্দা জানিয়ে বলেন, এটি নিছক একটি অপরাধ নয়—পুরুষতান্ত্রিক দমননীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার একটি নগ্ন উদাহরণ।
বিবৃতিতে তারা জানান, গত ২৬ জুন রাতের অন্ধকারে মুরাদনগরের এক গ্রামে ঘরের দরজা ভেঙে এক নারীকে ধর্ষণ করা হয়। এই পাশবিক ঘটনার ভিডিও ধারণ করে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় ফেসবুক ও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে। ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভিডিওটি ভাইরাল হয়; যা জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
তারা আরও জানান, অভিযুক্তদের মধ্যে কয়েকজনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে ন্যায়বিচার ও শাস্তি নিয়ে জনমনে এখনও শঙ্কা বিরাজ করছে।
গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি: ‘শুধু গ্রেফতার নয়, বিচার নিশ্চিত করতে হবে।’
সংগঠনটি এক বিবৃতিতে জানায়, ‘এই ঘটনা শুধু ব্যক্তি অপরাধ নয়—সমাজের গহীনে প্রোথিত নারীবিদ্বেষী মানসিকতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রীয় উদাসীনতারই ফল।’ তারা আরও অভিযোগ করে—ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার পরও ভুক্তভোগীর পরিচয় প্রকাশ করে রাজনৈতিক মুনাফা হাসিলের ঘৃণ্য চেষ্টা হয়েছে, যা অপরাধের দ্বিতীয় স্তরের সহিংসতা।
তাদের দাবি: দ্রুত ও জবাবদিহিমূলক বিচার নিশ্চিত করা, ভুক্তভোগীর মানসিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক প্রচারণায় ভুক্তভোগীর দেহকে হাতিয়ার না বানানোর আহ্বান, নারী‑নিরাপত্তায় জননিরাপত্তা ব্যবস্থায় শক্তিশালী হস্তক্ষেপ।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ): ‘ভিডিও ছড়ানো মানে নতুন করে নির্যাতন।’
মানবাধিকার ও সুশাসন নিয়ে কাজ করা এই সংস্থাটি তাদের বিবৃতিতে বলেছে—‘ধর্ষণ যেমন একটি অপরাধ, তেমনি সেটির ভিডিও ধারণ করে প্রচার করা হলো, আরেকটি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এটি ভুক্তভোগীর মানসিকতাকে বিপর্যস্ত করে এবং সমাজে সহিংসতার বার্তা ছড়ায়।’
সংগঠনটি আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য তুলে ধরে জানান, এবছরের জানুয়ারি–মে মাস পর্যন্ত ৩৮৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৭১টি ঘটনায় কোনও মামলা হয়নি। ১৯৬টি ধর্ষণের শিকার ছিল ১৮ বছরের নিচে শিশু।
এমজেএফ-এর দাবি—ধর্ষণ ও সাইবার সহিংসতার পৃথক তদন্ত করতে হবে, ভুক্তভোগীর চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে, সাইবার অপরাধে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সজাগ ও মানবিক নীতিমালা কার্যকর করতে হবে।
নারীপক্ষ: ‘আর নয় নীরবতা—রুখে দাঁড়াও’
নারীবাদী সংগঠন নারীপক্ষ তাদের বিবৃতিতে আরও জোরালো ভাষা তুলে বলেছেন, ছিটেফোঁটা কিছু বিচারের মুখ দেখলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে নেই কোনও দৃশ্যমান কার্যকর প্রতিরোধ। প্রতিবাদহীনতা ও ‘গা বাঁচিয়ে চলা’র সংস্কৃতি ধর্ষকদের সাহসী করে তুলছে।
তারা সরকারের কাছে আহ্বান জানান—প্রতিটি ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার করতে হবে, অপরাধ প্রতিরোধে প্রশাসনের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে হবে এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা, প্রতিবাদ ও সহমর্মিতার প্রসার করতে হবে।
সংগঠনগুলোর মতে, বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক কাঠামোতে ধর্ষণ কেবল ব্যক্তিগত অপরাধ নয়—এটি ক্ষমতার অপব্যবহার, লিঙ্গভিত্তিক শ্রেণিবৈষম্য ও মূল্যবোধহীনতার প্রতিচ্ছবি। আবার বিচারহীনতা ও ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ মামলার ধামাচাপা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিন সংগঠনের অভিন্ন আহ্বান
১। তদন্ত ও দ্রুত বিচার—অভিযুক্তদের গ্রেফতারের পর যেন যথাযথ প্রক্রিয়ায় আদালতে বিচার নিশ্চিত হয়।
২। সাইবার সহিংসতা প্রতিরোধ—ভিডিও ও ছবি অনলাইনে ছড়ানো যেন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।
৩। ভুক্তভোগীর সামাজিক সুরক্ষা—যেন তার পরিচয় ও সম্মান অক্ষুণ্ন থাকে।
৪। সামাজিক আন্দোলন—সবাইকে আহ্বান জানানো হয়েছে নির্যাতনের বিরুদ্ধে একজোট হতে।
সংগঠনগুলো আরও জানিয়েছেন, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—সুস্থ সমাজ গঠনে শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন যথেষ্ট নয়। মানসিকতার পরিবর্তন, আইন প্রয়োগের স্বচ্ছতা এবং মানবিক মূল্যবোধই পারে এই সহিংসতা বন্ধ করতে।