আলোকছায়ার ভেলায় ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর গল্প নিয়ে ঢাকার আকাশে বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-কে কেন্দ্র করে এক অনন্য আয়োজনের সাক্ষী থাকল হাজারও মানুষ। সোমবার (১৪ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৭টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে শুরু হয় এই উৎসবের মূল আকর্ষণ—ব্যতিক্রমধর্মী ও মনোমুগ্ধকর ‘ড্রোন শো’। ‘নতুন বছর, নতুন বাংলাদেশ’ থিমে আয়োজিত এই শো আয়োজন করে বাংলাদেশ সরকার ও চীন সরকারের যৌথ উদ্যোগে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস। এই আয়োজন কেবল বিনোদন নয়, বরং চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের এক মাইলফলক হয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
২ হাজার ৬০০ ড্রোনের সমন্বয়ে ১৪ মিনিটের শোতে তুলে ধরা হয় মোট ১২টি প্রতীকী চিত্র বা মোটিফ। প্রথম মোটিফটি সাজানো হয় ‘জুলাই অভ্যুত্থানের যোদ্ধাদের’ প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এরপর একে একে ভেসে ওঠে মুক্তির আনন্দ, শহীদ আবু সাঈদের সাহসী আত্মত্যাগ, নারী জাগরণ, দেশীয় সংস্কৃতি, জনগণের সংহতি ও আন্তর্জাতিক সংবেদনশীলতা। এর একটি চিত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের সংগ্রামের প্রতি সংহতির বার্তা তুলে ধরা হয়, যা দর্শকদের আবেগ ছুঁয়ে যায়।
‘নতুন বছর, নতুন বাংলাদেশ’— এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে চীন ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই প্রদর্শনী ছিল প্রযুক্তি, ইতিহাস, মানবতা ও সংস্কৃতির এক অনন্য সংমিশ্রণ। ১৪ মিনিটের এই শো দর্শকদের দিয়েছে আবেগ, ইতিহাস আর আশার এক মিশ্র অনুভূতি। নিচে প্রতিটি মোটিফের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
তুলে ধরা হলো—
জুলাই অভ্যুত্থানের বীরদের শ্রদ্ধা
ড্রোন শো’র সূচনা হয় ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। একে কেন্দ্র করে আবু সাঈদের প্রতীকী ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়, যিনি এই আন্দোলনের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
মুক্তির প্রতীক
ড্রোনের আলোয় উদিত হয় পাখির মতো মুক্তির চিত্র, যা জনগণের স্বাধীনচেতা মানসিকতার প্রতিফলন।
নারী জাগরণ
একটি মোটিফে নারীর উত্থান, শক্তি ও সাহসিকতাকে তুলে ধরা হয়। এই অংশে উঠে আসে নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীকী চিত্র।
দেশীয় সংস্কৃতি
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নকশা, পিঠা, মঙ্গল শোভাযাত্রার মুখোশ ও সাঁওতাল মোটিফের ভাস্কর্যরূপ ফুটিয়ে তোলা হয়।
গণসংহতি ও প্রতিবাদ
চলমান আন্দোলন এবং জনগণের প্রতিবাদী চেতনার প্রতিফলন ঘটায় একটি বিশেষ মোটিফ, যাতে দেখা যায় মানুষের মিছিল ও স্লোগান।
প্যালেস্টাইনের প্রতি সংহতি
বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সংহতি জানিয়ে একটি চিত্র প্রদর্শিত হয়, যা শো’র অন্যতম আবেগঘন মুহূর্ত হয়ে ওঠে।
জুলাই অভ্যুত্থানের গান
একটি মোটিফে ভেসে ওঠে আন্দোলনের প্রতীকী সুর ও স্লোগানের ইমেজ, যা জনগণের ঐক্যের প্রতীক।
চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী
দুই দেশের পতাকা এবং করমর্দনের চিত্র ফুটিয়ে তুলে দেখানো হয় দীর্ঘস্থায়ী কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন।
আধুনিক প্রযুক্তির অগ্রগতি
ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে তুলে ধরা হয় এক প্রযুক্তিনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে, ড্রোনে ফুটে ওঠে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর রূপরেখা।
শান্তির প্রতীক পায়রা
এক দল পায়রা আকাশে উড়ছে— এমন চিত্রে প্রকাশ পায় শান্তির বার্তা এবং মুক্তিকামী মানবতার রূপ।
ঐতিহ্যের ক্যানভাস
পুরোনো বাংলা লিপি, কবিতার পঙ্ক্তি ও গ্রামীণ চিত্র তুলে ধরে বাংলার শিকড়কে নতুন করে চেনানো হয়।
নতুন দিনের আহ্বান
শোয়ের শেষাংশে ফুটে ওঠে ‘নতুন বছর, নতুন বাংলাদেশ’ থিমের প্রতীকী ছবি— যেখানে একজন কিশোর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, হাতে জাতীয় পতাকা।
বিশেষজ্ঞদের প্রযুক্তি সহযোগিতা
এই শো পরিচালনায় কাজ করেন ১৩ জন চীনা ড্রোন বিশেষজ্ঞ এবং একটি ৬ সদস্যের কারিগরি দল, যারা ফেব্রুয়ারি মাস থেকে প্রস্তুতিতে ছিলেন। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও কারিগরি উৎকর্ষ নিশ্চিত করেই ড্রোনগুলোকে এক অভূতপূর্ব সমন্বয়ে পরিচালনা করা হয়।
একটি বার্তাবাহী শো, শুধুমাত্র বিনোদন নয়
ড্রোন শো ছিল কেবল চোখ ধাঁধানো প্রযুক্তি নয়, এতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতি, মানবিক বিপর্যয়, আন্দোলন, ঐতিহ্য ও বৈশ্বিক সংহতির বার্তা। শো শেষে দর্শকরা দাঁড়িয়ে হাততালিতে প্রকাশ করেন তাদের মুগ্ধতা, কৃতজ্ঞতা ও আশাবাদ।
শোতে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন, বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক সচিব মো. মফিদুর রহমান, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ ওয়ারেছ হোসেনসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
নববর্ষ কনসার্ট ও ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পরিবেশনা
এর আগে বিকাল ৩টায় শুরু হয় পহেলা বৈশাখের কনসার্ট। কনসার্টের সূচনা হয় বান্দরবানের বেসিক গিটার লার্নিং স্কুলের পরিবেশনার মাধ্যমে। এরপর গারো ব্যান্ড ‘এফ মাইনর’, মিঠুন চক্র, ইসলামউদ্দিন পালাকার, রাকিব, সাগর দেওয়ান, আরজ আলী ওস্তাদ, আতিয়া আনিশা, আহমেদ হাসান সানি ও পারশা একে একে গান ও পালা পরিবেশন করেন। কনসার্টের শেষ দিকে জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘অ্যাশেজ’ পরিবেশন করে ব্যান্ড সংগীত।
আদিবাসী ঐতিহ্য ও শোভাযাত্রায় বৈচিত্র্যের মিলন
সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় এতে অংশগ্রহণ করেন দেশের ২৮টি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিল্পীরা। বর্ণাঢ্য সাজ ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে বাঙালি, চাকমা, মারমা, গারো, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, হাজংসহ বিভিন্ন সম্প্রদায় একত্রে অংশ নেন। শোভাযাত্রায় প্রায় ২০০ জন ব্যান্ড মিউজিশিয়ান অংশগ্রহণ করে এবং ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে পরিবেশন করেন ‘শান্তির গান’।
উৎসবমুখর রাজধানী, ঐক্যের বার্তা
এই মহোৎসব ঘিরে পুরো রাজধানীজুড়ে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। নানা বয়সী মানুষের অংশগ্রহণে পহেলা বৈশাখ হয়ে উঠেছিল এক প্রাণবন্ত ও অনন্য দিন। নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে প্রতিফলিত হয়েছে ঐক্য, সংস্কৃতির সম্মান, এবং প্রযুক্তির সৃজনশীল ব্যবহারে ভবিষ্যতের দিগ্দর্শন।
এবারের বাংলা নববর্ষ ছিল কেবল অতীত স্মরণ নয়— এটি ছিল এক আশাবাদের আলোকচ্ছটা, যা স্মরণীয় হয়ে থাকবে দেশের ইতিহাসে।