X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘খবর দেখলেই সেই স্মৃতি মনে পড়ে’

এস এম নূরুজ্জামান
২১ আগস্ট ২০১৭, ১৯:৫৭আপডেট : ২১ আগস্ট ২০১৭, ২০:০৬

দর্শক বেঞ্চে বসে আছেন জজ মিয়া ‘খবর দেখলেই সিআইডি কার্যালয়ের সেই দিনের কথা মনে পড়ে। জেলখানার কষ্টের কথা মনে পড়ে। ২১ আগস্টের এই দিন এলেই গ্রেনেড বিস্ফোরণের খবর ও আমার ছবি দেখায়। তাই দেখে অনেকেই ফোন করেন। কেউ কেউ এড়িয়েও চলেন আমাকে।’
একটানে কথাগুলো বলে চলছিলেন জজ মিয়া ওরফে জালাল উদ্দিন, যিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার প্রথম ও প্রধান আসামি।
সোমবার ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ১৩তম বর্ষপূর্তির দিন সকাল ১১টার দিকে রাজধানীর মাতুয়াইল সংলগ্ন ঢাকা-চিটাগাং রোডের পাশেই গড়ে ওঠা শ্রমিক সংগঠনের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা পাওয়া যায় জজ মিয়ার। ওই কার্যালয়ে বসে টেলিভিশনে দেখছিলেন নিজেকে নিয়েই প্রচার করা খবর।

খবর শেষ হলে গিয়ে কথা বলি জজ মিয়ার সঙ্গে। জানতে চাই, খবরে কী দেখেন। জবাবে জজ মিয়া বলেন, ‘১২ বছর আগে ২১ আগস্টের সেই ভয়াল গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় কিভাবে প্রধান আসামি হয়েছিলাম, কিভাবে খবরের শিরোনাম হয়েছিলাম— তাই দেখি।’
জজ মিয়া বলেন, ‘খবর দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সেই দিনের সিআইডি কার্যালয়ের কথা মনে পড়ে যায়। যে ঘটনায় এত মানুষের জীবন গেছে, এত মানুষ আহত হয়েছেন— সেই বিস্ফোরণের মূল আসামি আমি ছিলাম! চিন্তা করলেই শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আবার ভাবি, আমি দুনিয়াতেই বিচার পেয়ে গেছি। যারা আমাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়েছিল, তারাই তো এখন আসামি।’
ঢাকা-চিটাগাং রোডের পাশের ওই শ্রমিক সংগঠনের কার্যালয়ে জজ মিয়া ওরফে জালালের পাশে বসেই টিভিতে খবর দেখছিলেন আরও কয়েকজন। তাদের একজন ফুটপাথের ব্যবসায়ী শফি উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘জালালের ছবি দেখার জন্যই বসেছিলাম।’ গ্রেনেড হামলার আসামিদের ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘পাপের শাস্তি যে একসময় ভোগ করতে হয়, এইটাই আল্লাহর বিচার।’
জজ মিয়ার পূর্বপরিচিত গাড়িচালক মোস্তফা বললেন, ‘জজ মিয়াকে অনেক দিন ধরেই চিনি। ওর মতো একজনকে লোককে এত বড় একটা ঘটনায় ক্যামনে ফাঁসানো হইছিল, সেইটা ভাইবা কোনও কূল-কিনারা পাই না।’
তাদের কথার সূত্র ধরে জজ মিয়া বলে ওঠেন, ‘ওরা আমার খোঁজখবর নিলেও ঘনিষ্ঠদের অনেকেই এখন আমাকে এড়িয়ে চলেন। অনেকেই আমার পরিচয় পেয়ে বিব্রত হন।’ বিব্রত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওরা ভাবে, আমাকে ধরে যখন নিয়ে গেছে তখন কিছু না কিছু তো হইছিলই, কোনও না কোনও ঘটনা নিশ্চয় ছিল। এইসব ধারণা থেকেই কেউ কেউ দূরে থাকে।’
টেলিভিশনে নিজেকে নিয়ে প্রচার করা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার খবর দেখছেন এখন কী করছেন জানতে চাইলে জালাল উদ্দিন ওরফে জজ মিয়া বলেন, ‘আমি রাজধানীর গুলিস্তানে কখনও ফল বিক্রি করেছি, কখনও সিনমোর পোস্টার বিক্রি করেছি। কখনও স্কুলের গাড়ি চালিয়েছি। এখন নিজেই নিজের প্রাইভেটকার চালিয়ে মা-বোনকে নিয়ে আমার সংসার চালাই।’

যেভাবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আসামি
জজ মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৯৯৮ সালে সূত্রাপুর থানায় দায়ের হওয়া একটি বিস্ফোরক মামলায় আসামি হয়েছিলাম। ওই মামলায় আমার ছয় বছরের সাজা হয়। সেই মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসাবে আমাকে নোয়াখালীর সেনবাগ এলাকার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর চোখ বেঁধে ঢাকায় আনা হয়। এসপি রশীদ আমাকে নিয়ে আসেন।’
জজ মিয়া বলতে থাকেন, ‘আমার চোখ খুলে দেওয়া হলে নিজেকে একটি রুমের মধ্যে দেখতে পাই। সামনে একাই বসা ছিলেন এসপি রশীদ। রুমে অনেক লাঠি, প্লাস (প্লায়ার্স), হাতুড়ি এসব ছড়ানো-ছিটানো ছিল। ওপরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে রশি ঝুলানো ছিল। বুঝতে পারলাম এই রুমে কী হয়!’
ওই সময়ের ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে জজ মিয়া বলেন, ‘‘এসপি আমাকে বলেন, ‘তোর কাছে বড় স্যার আসবে, তার সঙ্গে কথা বলবি।’ ঘণ্টাখানেক পর আবার চোখ বেঁধে অন্য রুমে নিয়ে যায়। ওই রুমে ছিলেন রুহুল আমিন স্যার। তিনি আমার সামনে বসেছিলেন, আমাকেও বসতে বললেন। তারপর টিভি ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখ, তুই কিভাবে হামলা করেছিস। বল।’ আমি তখন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।’’
জজ মিয়া জানান, ওই হামরার এক সপ্তাহ আগে থেকেই তিনি ছিলেন গ্রামের বাড়ি। ১৯৯৮ সালের একটি মামলার কথা বলে তাকে গ্রাম থেকে ধরে আনা হয়। ফলে পুলিশ কর্মকর্তাদের কথার কিছুই বুঝতে পারছিলেন না বলে দাবি করেন তিনি। তা সত্ত্বেও তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
জজ মিয়া বলেন, ‘রশীদ স্যার আমাকে আলাদা করে নিয়ে গেলেন। এরপর উল্টাপাল্টা ব্যবহার শুরু করলেন, গালিগালাজ করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে আমাকে ফ্যানের সঙ্গে রশি লাগিয়ে আমাকে উল্টো করে ঝুলিয়ে হাত ও পায়ের তালুতে পেটাতে থাকেন। কে কে ছিল, বল— এই প্রশ্ন করতে করতেই মারতে থাকেন আমাকে।’
নিজের গাড়ি চালাচ্ছেন জজ মিয়া ওই নির্যাতনের কারণে জজ মিয়ার ডান হাতের হাড়ে চিড় ধরে বলে জানান তিনি। নির্যাতনের সময় বারবার তাকে গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করতে বলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। জজ মিয়ার ভাষ্য, ‘‘রুহুল আমিন স্যারের রুমে নিয়ে গেলে তিনি আমাকে বললেন, ‘হামলার কথা স্বীকার কর। তাহলে তোর ভালো হবে। তুইও বাঁচ, আমাদেরও বাঁচা।’ স্যারের কথা শুনে আমি বললাম, ‘ক্যামনে বাঁচাবো?’ তখন তিনি বলেন, ‘এই মামলার আসামিদের আমরা পাচ্ছি না। আমরা চাপে আছি। তুই আমাদের কথা না শুনলে তোরে ক্রসফায়ার দিয়ে এই মামলা ধামাচাপা দিবো।’ তখন আমি ভয় পেয়ে বলি, ‘আমি স্বীকারোক্তি কিভাবে দিবো? আমি তো কিছুই জানি না।’ তখন তিনি বলেন, ‘আমরা তোকে শিখিয়ে দিবো।’ স্বীকারোক্তি দিলে আমাকে বাঁচাবেন কিভাবে— জানতে চাইলে সিআইডি কর্মকর্তারা বলেন, ‘তোকে আমরা রাজসাক্ষী বানাবো। কোর্টে রাজসাক্ষীর জন্য পিটিশন করব, মঞ্জুর হলেই তুই রাজসাক্ষী হয়ে যাবি। তুই বেঁচে যাবি।’’
খানিকটা বিরতি দিয়ে আবারও বলতে শুরু করেন জজ মিয়া, ‘এরপর তারা আমাকে একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার ছবি, ভিডিও দেখাতে থাকেন। বড় বড় সন্ত্রাসীদের ছবি দেখিয়ে মুখস্থ করতে বলেন। তাদের গাড়িতে করে হামলার স্পটসহ বিভিন্ন স্পটের লোকেশন বুঝিয়ে দেন। আমি যেন কোর্টে গিয়ে আসামিদের চিনতে পারি ও সব ঘটনা বলতে পারি, সে জন্য অনেকবার পরীক্ষাও নিয়েছেন তারা।’
আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার কথা কথা বলতে গিয়ে জজ মিয়া বলেন, ‘‘আদালতে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হামলার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে থাকি। কোনও তথ্য ভুলে গেলে ওসি মনে করিয়ে দেন। ম্যাজিস্ট্রেটকে আমার ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এইরকম না, ওইরকম হবে।’ এভাবে আমার জবানবন্দি শেষ হওয়ার পর ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে বলেন, ‘তোমার কথা সব রেকর্ড করা আছে। আমার কাছে যেভাবে বলেছ, উচ্চ আদালতে গিয়েও একইভাবে বলবে।’’
এরপর কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় জজ মিয়াকে। সেখানেই কাটে ছয় বছর। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা আসার পর নতুন করে মামলার তদন্ত শুরু হয়। এসময় অনেকেই জজ মিয়াকে গ্রেনেড হামলা মামলার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে জানতে চাইলেও তিনি মুখ খোলেননি।
শেষ পর্যন্ত প্রকৃত ঘটনা কিভাবে প্রকাশ পেয়েছিল, জানতে চাই জজ মিয়ার কাছে। তিনি বলেন, ‘‘একদিন মুন্সি আতিক স্যার ও কর্নেল গুলজার স্যারসহ কয়েকজন আমার সাথে দেখা করতে আসেন। তারা আমার কাছে ঘটনার সত্যতা জানতে চান। তখন আমি কর্নেল গুলজার স্যারকে জিজ্ঞাসা করি, ‘স্যার, আমি সত্য বললে কি আমাকে ক্রসফায়ারে দিবেন? নাকি আমারে আসামি বানিয়ে ফাঁসিতে দিবেন?’ গুলজার স্যার আমাকে আশ্বস্ত করেন, আমার কিছু হবে না। স্যার অভয় দিলে সব কথা বলে দেই। তিনি কথা রেখেছিলেন। আমার আর কিছু হয়নি।’

আরও পড়ুন-

‘গ্রেনেড হামলার দুদিন পরেও নেত্রী ছিলেন শোকে বিহ্বল’

‘আমাকে দেখার দরকার নেই, আমার নেতা-কর্মীদের চিকিৎসা করো’

/টিআর/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
চাইলেই কি বনের আগুন প্রতিরোধ সম্ভব
চাইলেই কি বনের আগুন প্রতিরোধ সম্ভব
একদিন আগে নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাচন স্থগিত
একদিন আগে নাঙ্গলকোট উপজেলা নির্বাচন স্থগিত
সরকার বিনিয়োগকারীদের সব সুবিধা নিশ্চিতে বদ্ধপরিকর: পরিবেশমন্ত্রী
সরকার বিনিয়োগকারীদের সব সুবিধা নিশ্চিতে বদ্ধপরিকর: পরিবেশমন্ত্রী
সর্বাধিক পঠিত
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
কারিনাকে নিজ পরিবারে স্বাগত জানালেন প্রিয়াঙ্কা
কারিনাকে নিজ পরিবারে স্বাগত জানালেন প্রিয়াঙ্কা