X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

টানা ৬ দিন ফাঁস জেএসসি’র প্রশ্নপত্র, স্বীকার করেছেন অভিভাবকরাও

রশিদ আল রুহানী
০৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:১৫আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০১৭, ০০:২৬

জেএসসি পরীক্ষার একটি প্রশ্নপত্র

১ নভেম্বর থেকে সারাদেশে জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এ দিন থেকেই এ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগেই পাওয়া যাচ্ছে ফেসবুক এবং হোয়াট্স অ্যাপ গ্রুপে। আজ বুধবার (৮ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের পরীক্ষা। এ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও পাওয়া গেছে সামাজিক যোগাযোগ এসব মাধ্যমের ক্লোজ গ্রুপে। পরীক্ষা শেষ হলে বাংলা ট্রিবিউনের হাতে আসা প্রশ্নের সঙ্গে হুবহু মিল পাওয়া যায়।

হোয়াটসঅ্যাপে এভাবেই জেএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়

১ নভেম্বর বাংলা প্রথম পত্র, ২ নভেম্বর বাংলা দ্বিতীয় পত্র, ৫ নভেম্বর ইংরেজি প্রথম পত্র, ৬ নভেম্বর ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র, ৭ নভেম্বর ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা এবং অন্য ধর্মের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা। এর সবগুলো পরীক্ষারই প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে পরীক্ষার অন্তত ১ ঘণ্টা আগেই।

পরীক্ষার শুরুর দিন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার পর থেকেই ফেসবুকে শুরু হয় প্রশ্ন দেওয়ার প্রচারণা। ‘Nk Nahida Akter’ নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে দাবি করা হয় তারা প্রতিটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগের রাত থেকেই দিতে পারবে। আল্লাহ’র শপথ করেও দাবি করেন প্রশ্ন দেবেন। এছাড়া এমন আরও বেশ কিছু ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট থেকে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রশ্ন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।’

এনকে নাহিদা আক্তার নামের একটি আইডি থেকে ফাঁস করা হয় জেএসসির প্রশ্নপত্র

এরপর পরীক্ষা শুরুর আগের দিন দুপুর থেকেই দ্বিতীয় ধাপে এগিয়ে আসে প্রশ্নফাঁস চক্রটি। যারা আগ্রহী তাদেরকে যুক্ত করেন নিজেদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট অথবা হোয়াট্সঅ্যাপে। প্রথম দিন ১ নভেম্বর ছিল বাংলা প্রথমপত্র পরীক্ষা। সেদিন পরীক্ষা শুরুর ১ ঘণ্টা আগেই প্রশ্ন হাতে পায় আগ্রহী শিক্ষার্থীরা। একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দাবি করা হয়েছে, প্রথমদিন প্রশ্ন দেওয়া হয় ফ্রিতে। বিশ্বাস অর্জনের জন্য। প্রমাণ হিসেবে প্রশ্নের ছবি তুলে দেওয়া হয় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে হোয়াট্স অ্যাপ গ্রুপে। এরপর দ্বিতীয় দিন থেকেই শুরু হয় টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন দেওয়া।

টানা ৬ দিন ধরে প্রশ্ন নিচ্ছে এমন দু’জন পরীক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানায়, ‘ফেসবুকে প্রশ্ন দেবে বলে একটা পোস্ট দেখি পরীক্ষা শুরুর কয়েকদিন আগে। ওই পোস্টে লাইক অথবা কমেন্ট করার পর থেকে তারা প্রতিদিন আমাদেরকে মেসেজ দিতে থাকে। প্রথমে আমরা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু প্রথম পরীক্ষার পর থেকে বিশ্বাস হওয়া শুরু করেছে। এখন আমাদের মধ্যে কেন যেন নেশার মতো কাজ করে। মাত্র ৫শ’ টাকায় প্রশ্ন দিচ্ছে তাও আবার উত্তরসহ। হাতের কাছে প্রশ্ন পেয়েও সেটা না নিয়ে পড়তে বসলে পড়ায় মন বসছে না।’

ফেসবুকে প্রশ্নফাঁসের প্রচারণা চালানো হয় এভাবে

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পরীক্ষার্থীর অভিভাবক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা খুবই যন্ত্রণায় রয়েছি। বুঝতেছি এটা খুবই অন্যায়। কিন্তু আমাদের সন্তানরা তো ছোট, অবুঝ। ওরা খুবই বিরক্ত করছে, নিষেধ করলে মন খারাপ করছে। পড়াশোনা না করে মুখ গোমড়া করে বসে থাকছে। খুবই মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছি আমরা। সরকার কেন এর একটি বিহিত করেনা?’ ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ নতুন প্রজন্মকে বাঁচান।’

তবে এবার প্রশ্নফাঁসকারী চক্র একটু বেশি সতর্ক। নতুন পদ্ধতিতে তারা প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাচ্ছে। জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে এমন কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়মিত প্রশ্নপত্র পেয়ে পরীক্ষা দিচ্ছেন বলে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে দাবি করেছেন তারা। শুধু তাই নয়, প্রথম থেকে সব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কিভাবে শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছানো হচ্ছে তারও ফিরিস্তি প্রমাণসহ তুলে ধরেছেন।

পরীক্ষার এক ঘণ্টা আগে ফাঁস করা প্রশ্ন উত্তরসহ দেওয়া হয়

শিক্ষার্থীদের এমন দাবির পরে সকল পরীক্ষার প্রশ্নপত্রই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে এর প্রমাণ মিলেছে। তবে বাড়তি সতর্ক অবলম্বন করছে চক্রটি। জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন দেবে আশ্বাস দিলে যারা ওই বিজ্ঞাপনের নিচে আগ্রহ প্রকাশ করে তারা আদৌ জেএসসি পরীক্ষার্থী কি না তা নিশ্চিত হতে পরীক্ষার্থীর প্রবেশপত্রের ছবি নিচ্ছে। তারপর ওই পরীক্ষার্থীকে তাদের ফেসবুক অথবা হোয়াট্সঅ্যাপের ক্লোজ গ্রুপে যুক্ত করে নিয়ে সেখানে সাজেশন আকারে আংশিক প্রশ্ন দিচ্ছে। সারারাত প্রশ্নপত্রের বিভিন্ন অংশ সাজেশন আকারে দেওয়ার পর পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই ইনবক্সে দেওয়া হচ্ছে প্রশ্নসহ ওই প্রশ্নের উত্তর। পরীক্ষার্থী তার পরীক্ষা শেষ করে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শর্ত অনুযায়ী  বিকাশ অথবা রকেটে মাত্র ৫০০ টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে। টাকা না পাঠালে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার ভয়ও দেখানো হচ্ছে। কোমলমতি শিশুরা এবং তাদের অভিভাবকরা ভয় পেয়ে টাকা পরিশোধও করছেন। এরপর তারা গ্রুপটি ডিলিট করে দিয়ে নতুন গ্রপ খুলছে। যাতে তাদেরকে প্রশাসন আইডেন্টিফাই করতে না পারে। আর এভাবেই প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বাংলা ১ম পত্র, দ্বিতীয় পত্র, ইংরেজি প্রথম পত্র,ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র, ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি পরীক্ষার।

হাতে লিখেও কিছু প্রশ্ন ফাঁস করা হয়।

কিন্তু পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের হদিস পেলে গণমাধ্যমগুলো একের পর এক প্রমাণসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাবোর্ড, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এমনকি প্রশাসনের পক্ষ থেকেও প্রথম থেকেই দায়সারা মনোভাব দেখা যায়। সবাই মিলে একযোগে লুকোচুরি করেন বলেও মনে করে শিক্ষাবিদরা। কিন্তু এতে করে এর সুদুরপ্রসারী ভয়াবহতা নিয়ে আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন তারা।

বরাবরের মতো প্রশ্নফাঁসের হদিস পেলে প্রমাণসহ শিক্ষাবোর্ডকে অবহিত করা হলেও তারা প্রশ্নফাঁসের কথা অস্বীকার করেন। তারা বলেন, বিটিআরসিকে জানানো হয়েছে, তারা অপরাধী শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। বৃহস্পতিবার সকালে যথারীতি একই উত্তর এলো শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমারের কাছ থেকে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রশ্নফাঁসের কোনও খবর নেই। বিটিআরসিকে বলা রয়েছে, তারাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।’

প্রশ্নফাঁসের পর পরীক্ষা শেষে পরীক্ষার্থীদের কাছ টাকা চাওয়া হয় এভাবে

অথচ এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার সকালে বিটিআরসি চেয়ারম্যান জানালেন ভিন্ন কথা। চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা কখনোই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে কিনা তা শনাক্ত করি না। কোন গ্রুপে প্রশ্ন দেওয়া হলো, কোন রাস্তা দিয়ে প্রশ্ন ফাঁস হলো তা অনুসন্ধান করা আমাদের কাজ নয়। আমাদের কাজ হলো কেউ অভিযোগ দিলে সেই ফেসবুক লিংকটি আমরা বন্ধ করে দেই। তাছাড়া আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনও অভিযোগও শিক্ষাবোর্ড দেয় না। অনুসন্ধানের কাজ শিক্ষাবোর্ড এবং শিক্ষামন্ত্রণালয়ের।’

অন্যদিকে, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ নিজেও আগে থেকেই এটাকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি অবশ্য এর জন্য সবসময়ই দায়ী করেছেন শিক্ষকদের। তিনি এর আগে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমাদের পরীক্ষাকেন্দ্রে অন্তত এক ঘণ্টা আগেই প্রশ্ন পাঠাতে হয়। ওই কেন্দ্রের কিছু কুচক্রী শিক্ষক প্রশ্ন হাতে পাওয়ার পর তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।’

ফেসবুকে প্রশ্নফাঁসের প্রচারণা চালানো হয় এভাবে

কিন্তু সবাই মিলে এমন দায় এড়িয়ে গিয়ে লাভ কি হচ্ছে, ক্ষতি কি হচ্ছে তা নিয়ে আতঙ্ক প্রকাশ করে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রশ্নফাঁস ছাড়া পরীক্ষা এখন কল্পনাই করা যাচ্ছে না। ক্রমাগত ঘটছে। অথচ শিক্ষামন্ত্রণালয়সহ এর সঙ্গে জড়িতরা কেউ তা স্বীকার করছে না। অভিযোগ পেলেও মন্ত্রণালয় পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাতে তো কোন লাভ হচ্ছে না। বরং দিন দিন এর ভয়াবহতা বাড়ছে। ফলে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগটি আমলে নিয়ে অর্থাৎ এটাকে শুধু অনৈতিক অপরাধ হিসেবে না নিয়ে পুরো জাতিকে বাঁচাতে ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’ হিসেবে নিয়ে সরকার নিজে আলাদা করে কাজ করে তাহলে প্রশ্নফাঁসের ভয়াবহতা থেকে বের হতে পারবো। কিন্তু তা না করে নতুন প্রজন্মকে অনৈতিক শিক্ষা দিচ্ছি।’

অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি আমাদের ঘাড়ে চেপেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘পুলিশ প্রশাসন যদিও দু একটাকে ধরছে সেখানে দেখা যাচ্ছে দলীয় লোকজন জড়িত। পরে দল থেকে তাদেরকে বের করে দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এত বড় একটা অপরাধকে আমরা শুধুমাত্র বহিষ্কার পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রাখছি। কিন্তু বহিষ্কার হওয়ার পরে সে কি আর সেই কাজে জড়াতে পারে না? তাকে কেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয় না? এর আগে এসিড সন্ত্রাসকে আমরাই দমন করেছি, এর ভয়াবহতা ছিল প্রচুর। ইভটিজিংকেও লাগাম টানার চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানেও অনেকটা স্বার্থক আমরা। কিন্তু প্রশ্নফাঁস চক্রও তো এক ধরনের সন্ত্রাসী। এটাকেও কেন আমরা এভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি না? তা না করে সবাই মিলে লুকোচুরি করছে।’

/আরএআর/ টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ