X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

হাসপাতালের বেডে শুয়ে-বসেই সময় কাটে মুনতাসিরের

তাসকিনা ইয়াসমিন
২২ ডিসেম্বর ২০১৭, ১১:৩৩আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০১৭, ১১:৩৯

হাসপাতালের বেডে মুনতাসির (৭)

ছোট্ট মুনতাসির (৭) হাসপাতালের বেডে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে  মোবাইল ফোনে গেম খেলছে। পাশেই বসে আছেন মা মোমেনা বেগম। কাছে গিয়ে পরিচয় দিতেই একগাল হাসি দিয়ে মোমেনা বেগম বললেন, ‘আমার ছ্যালাক দেখপার আইছেন?’ হ্যাঁ বলতেই উত্তর দিলেন, ‘সে এখন ভালো আছে।’
মুনতাসির ভর্তি আছে রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে। ২০ ডিসেম্বর তারিখ সেখানে কথা হয় মোমেনা বেগমের সঙ্গে।

মোমেনা খাতুনের কাছে শোনা গেল কনজেনিটাল ডিজিজে আক্রান্ত মুনতাসির জন্মের পর ভালোই ছিল। তবে ছয় মাস বয়সে তার মাথায় খুশকি হয়। এরপরই তার শরীরে পরিবর্তন দেখা দিতে থাকে। ধীরে ধীরে তার পুরো শরীরে চামড়ায় এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। একসময় তার শরীর ফুলে যায়। মানুষজন খারাপ রোগ বলে দূরে সরিয়ে দিতে চায় তাদের পরিবারকে।

মুনতাসিরকে হঠাৎ দেখলে স্বাভাবিক শিশু বলেই মনে হয়। একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে ধরা পড়ে তার সমস্যা। এতটুকু শিশুর মাথা ভর্তি খুশকি। তার পুরো শরীরের চামড়া খুলে খুলে পড়ছে। পায়ের তলার চামড়াও উঠে আসছে। তার মাথা কখনও ন্যাড়া করা যায় না। চুল কাঁচি দিয়ে ছাঁটতে হয়। ন্যাড়া করলে রক্ত বের হয়।

তার মা মোমেনা বেগম বলেন, ‘রাতে যখন ঘুমায়, তখনও ওর দুই চোখ খোলা থাকে। এই ঘটনা জানার পর থেকে ডাক্তার চোখে ড্রপ দিচ্ছেন। এখন রাতে চোখটা বন্ধ করে ঘুমায়।’

মুনতাসিরকে মা বাড়ির পাশের একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করেছিলেন। কিন্তু দু’দিন পাঠানোর পর আর দিতে পারেননি। কারণ হিসেবে জানালেন, ‘স্কুলের কোনও বন্ধু যদি ওর হাত ধরে ছলে (ঘষা দেয়) দেয়, তাহলেই চামড়া ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। এরপর থেকে আর ওকে স্কুলে যেতে দিইনি। কারও সঙ্গে ওকে খেলতেও দিতে পারি না।’

সাধারণত নিকট আত্মীয় স্বজনের মধ্যে বিয়ে হলে সন্তানের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু মুনতাসির এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তার মা-বাবা পরষ্পরের নিকট আত্মীয় নন। মোমেনা বলেন, ‘ওর যখন জন্ম হয় তখন যেমন মোটা, তেমন ফর্সা ছিল। সবাই খালি কোলে নিয়ে থাকত।’

তিনি বলেন, ‘ছেলেকে নিয়ে রংপুর দিনাজপুরের কোনও বড় ডাক্তারকে বাদ দিইনি। যে যেখানে বলেছে সেখানেই নিয়ে গেছি। কিন্তু কোনও ডাক্তার কিছু করতে পারল না।’ 

তিনি বলেন, ‘মানুষ বলে, তোমার ছেলে ভালো হবে না। ওকে আর ডাক্তার দেখাইও না। মা কোনোদিন ছেলেকে ফেলবার পারে? মায়ের মন, শুধু মা-ই জানে। আমি আল্লাহর ওয়াস্তে আমার পোলাকে ছাড়ি দিলাম। সে যদি সুস্থ করবার পারে, তো করবে।’

মুনতাসির এখন ভর্তি আছে চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এম ইউ কবির চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে। তিনি বলেন, ‘মুনতাসিরের ত্বকের গঠনগত সমস্যায় ভুগছে। রোগটি দূরারোগ্য। আমাদের প্রতি ২৮ দিন পরপর ত্বকের পরিবর্তন হয়ে নতুন ত্বক আসে। তার ত্বক প্রতিদিনই বদলায়। তার রোগ পুরো সারানো যাবে না। তবে, নিয়ন্ত্রণ করে রাখা যাবে। আমি যখন ওকে পেয়েছিলাম তার চেয়ে এখন ভালো আছে। এই রোগটি সাধারণত আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হলে হয়, কিন্তু ওর ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয়। এক্ষেত্রে অন্য বাচ্চার চেয়ে তার অবস্থা ভালো। অনেক সময় এই রোগ বয়ঃসন্ধিকালে ভালো হয়ে যায়।’

পরিবারের দারিদ্রের কারণে শিশুটি এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়েছে উল্লেখ করে ডা. কবির বলেন, ‘তার চামড়ার এলবুমিন উঠে যাচ্ছে। তাকে সবসময় পুষ্টিকর খাদ্য খেতে হবে। ডিম, দুধ, মাংস খেতে হবে। পাশাপাশি ওষুধ খেতে হবে। তাকে সবসময় তেলজাতীয় জিনিস মাখিয়ে রাখতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘এটা কন্ট্রোল করার মতো রোগ। এক বছরে আরও ভালো কন্ট্রোলে আসবে।’ 

বাংলাদেশে এই রোগ সংক্রান্ত কোনও ডাটা নেই উল্লেখ করে ডা. কবির বলেন, ‘আমি মাসে গড়ে একজন করে এই ধরনের রোগী পাই। একটি ছেলে পেয়েছিলাম, সে এখন বিবিএ শেষ করেছে। তার অবস্থা এখন বেশ ভালো।’

রংপুরের পীরগঞ্জ থানার ঠাকুরদাস লক্ষ্মীপুর গ্রামে মোমেনা বেগমের বাড়ি। তিন বছর আগে কিনডি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন স্বামী মোস্তাফিজার। এখন তিন সন্তানকে নিয়ে তার সংসার। বড় ছেলে এইচএসসি ও মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। মোমেনা বেগম বলেন, ‘বাবার বাড়ি থেকে চাল-ডাল এনে কোনোমতে দিন চালাই।’

রংপুরের তরুণ চিকিৎসক ডা. রিপন  ফেসবুকে ছবি পাঠিয়ে শিশুটির চিকিৎসায় সহায়তা চান। এরপর একদল ফেসবুক ব্যবহারকারী অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি শিশুটিকে ঢাকায় নিয়ে আসতে বলেন। এরপর তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারটিকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন ফেসবুক ব্যবহারকারী এই স্বেচ্ছাসেবকরা। তাদের মধ্যে দেশি-প্রবাসী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কয়েকজন মানুষ রয়েছেন। তারা মুনতাসিরের পুরো চিকিৎসা ব্যয় চালিয়ে যাওয়া ও পরিবারটিকে আর্থিক সহায়তার জন্য অর্থ সংগ্রহরে চেষ্টা করছেন। পরিবারটিকে হাসপাতালে দেখাশোনা করছেন তরুণ স্বেচ্ছাসেবক কাজী বাহার।  

 

 

/এএম/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আ.লীগের হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাবে বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
আ.লীগের হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাবে বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
খুলনায় বজ্রসহ বৃষ্টি
খুলনায় বজ্রসহ বৃষ্টি
কালবৈশাখী বয়ে যেতে পারে সারা দেশে
কালবৈশাখী বয়ে যেতে পারে সারা দেশে
আইপিডিসির নতুন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিক হোসাইন
আইপিডিসির নতুন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিক হোসাইন
সর্বাধিক পঠিত
অভিযোগের শেষ নেই মাদ্রাসায়, চলছে শুদ্ধি অভিযান
অভিযোগের শেষ নেই মাদ্রাসায়, চলছে শুদ্ধি অভিযান
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
কোন পথে এগোচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?
কোন পথে এগোচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো