কোরবানি করা পশুর মাংস বণ্টন ও চামড়ার ব্যবহার নিয়ে আমাদের মধ্যে কিছুটা অজ্ঞতা ও ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। কিন্তু ইসলামি শরিয়তে এ দুটির বাস্তব হুকুম কী, এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাসআলা জানা দরকার।
১। সবচেয়ে উত্তম হলো, কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করবে। একভাগ গরিব-মিসকিনকে দেবে। আরেকভাগ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের দেবে। আরেকভাগ নিজের পরিবার পরিজনের জন্য রাখবে।
কোরবানির মাংস নিজেরা খাওয়াও মুস্তাহাব ও সওয়াবের কাজ। কারও যদি প্রয়োজন হয় তাহলে কোরবানির মাংসের পুরোটাই নিজের পরিবারের জন্য রাখতে পারে। আবার কেউ চাইলে পুরোটাই সদকা করে দিতে পারে।
২। কোরবানির মাংস দিয়ে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে ওলিমার দাওয়াত খাওয়ানো যায়। কোরবানির মাংস অমুসলিমদেরও দেওয়া যায়।
৩। কোরবানির মাংস বণ্টনের প্রচলিত সামজিক প্রথা শরিয়তের দৃষ্টিতে জায়েজ নেই। কারণ, বাহ্যত এটি একটি মানবিক কাজ মনে হলেও শরিয়তের দৃষ্টিতে এতে বিভিন্নরকম আপত্তি রয়েছে। যেমন-
এক, অনেক কোরবানিদাতার পরিবারের সদস্য-সংখ্যা বেশি হওয়ায় অথবা অন্য কোনও যৌক্তিক কারণে নিজ পরিবারের জন্য বেশি মাংস রাখার প্রয়োজন হয়; ফলে সে পরিবারের জন্য বেশি মাংস রাখতে চায়। আবার অনেকে তার কোনও দরিদ্র আত্মীয়কে কোরবানির মাংস দিতে চায়। কিন্তু সামাজিক এই বাধ্যবাধকতার কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সামাজিক রীতি অনুযায়ী কোরবানির এক তৃতীয়াংশ মাংস সমাজে দিতে বাধ্য হয়। অথচ রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোনও মুসলমানের সম্পদ তার সন্তুষ্টি ব্যতীত হালাল নয়।’
দুই, প্রথা অনুযায়ী মাংসদাতা তার দানের অংশটি কাকে দেবে সে স্বাধীনতা হারায়। হয়তো সে তার নিকটাত্মীয় অথবা পরিচিত কাউকে একটু বেশি পরিমাণে দিত, কিন্তু এক্ষেত্রে তার জন্য এমনটি করার সুযোগ থাকে না।
তিন, অনেক মানুষ এমন আছেন, যারা প্রত্যেকের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে চান না। আর শরিয়তও কাউকে সবার হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে বাধ্য করেনি। কিন্তু সামাজিক এই রীতির কারণে মাংস গ্রহণকারী প্রত্যেকেই অন্য সবার হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বলাবাহুল্য এ ধরনের ঐচ্ছিক বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা মোটেই উচিত নয়।
চার, এ ধরনের বাধ্যবাধকতা আরোপের আরেকটি ক্ষতির দিক হলো, সমাজের কিছু মানুষ এমন থাকে, যাদের আয় রোজগার হারাম পন্থায় হয়। সেক্ষেত্রে জেনে-বুঝে তাদের কোরবানির মাংস সমাজের সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়। অথচ হারাম উপার্জনের মাধ্যমে কোরবানি করা পশুর মাংস খাওয়া জায়েয নয়।
মোটকথা, শরিয়তের শিক্ষা মোতাবেক প্রত্যেককে তার কোরবানির অংশ দান করার বিষয়ে স্বাধীন রাখতে হবে। প্রচলিত পদ্ধতিতে বা অন্য কোনওভাবে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যাবে না। কোরবানিদাতা নিজ দায়িত্ব ও বিবেচনা মতো যাকে যে পরিমাণ হাদিয়া দিতে চায় দেবে এবং গরিব-মিসকিনকে যে পরিমাণ সদকা করতে চায় করবে।
রাসুল (সা.)-এর সময় থেকে শত শত বছর যাবৎ এ পদ্ধতিই চলমান আছে। এই পদ্ধতিই অবলম্বন করা জরুরি। শরীয়ত যা চালু করতে বলেনি এমন কোনও প্রথা চালু করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪। কেউ মৃত্যুর সময় তার পক্ষ থেকে কোরবানি করার ওসিয়ত করে গেল। তাহলে সেই কোরবানির মাংস পুরোটা সদকা করে দেওয়া জরুরি। গরিব-মিসকিন ছাড়া অন্য কারও জন্য তা খাওয়া বৈধ নয়।
৫। সাধারণভাবে কোরবানির মাংস বিক্রি করা বৈধ নয়। হয় নিজেরা খাবে, না হয় আত্মীয়স্বজন ও গরিব-মিসকিনদের দেবে। তবে হ্যাঁ, মাংস যদি পরিমাণে এত বেশি হয়, দেওয়ার পরও রয়ে গেছে। এখন তা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা। তাহলে নষ্ট করার তুলনায় বিক্রি করে সেই টাকা গরিব-মিসকিনদের দিতে পারবে এবং তাদেরই দিতে হবে। নিজে ভোগ করতে পারবে না।
৬। কোরবানির চামড়া সদকা করে দেওয়াই সবচেয়ে ভালো। তবে কেউ চাইলে ওষুধ ইত্যাদির মাধ্যমে শুকিয়ে নিজের কাজেও লাগাতে পারে, কিংবা কাঁচা চামড়া কাউকে দিয়ে এর পরিবর্তে দীর্ঘ সময় থাকবে- এমন কোনও জিনিস নিয়ে তা নিজে ব্যবহার করতে পারবে। টাকার বিনিময়ে বিক্রি করলে সে টাকা অবশ্যই সদকা করে দিতে হবে।
৭। কোরবানির চামড়া, মাংস ইত্যাদি বিক্রি করা হলে সেই টাকা সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব। পাশাপাশি কোরবানির চামড়া মাদ্রাসার গরিব ছাত্রদের দান করা যায়। এতে দিগুণ সওয়াব হবে। একটি সদকার, অপরটি ইলমে দ্বীন প্রচারের কাজে সহায়তা করার।
৮। কোরবানির চামড়া এ উদ্দেশ্যে মসজিদে দান করা বৈধ নয় যে তা বিক্রি করে মসজিদের কাজে লাগানো হবে। তেমনিভাবে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন বা খাদেমকে বেতন-বাবদ কোরবানির চামড়া দেওয়া বৈধ নয়। পাশাপাশি কোরবানির চামড়া বিক্রিলব্ধ টাকা সরাসরি মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বাবদ খরচ করা বৈধ নয়।
৯। তবে কোরবানিদাতা যদি মাদ্রাসার মুহতামিমকে চামড়ার সম্পূর্ণ মালিক বানিয়ে দেন একং তিনি সে চামড়া নিজ কবজায় নিয়ে কারও কাছে বিক্রি করেন, তাহলে সেই টাকা তিনি মাদ্রাসার যে কোনও কাজে, শিক্ষকদের বেতন প্রদান, ভবন নির্মাণ ইত্যাদিতে সরাসরি খরচ করতে পারবেন।
১০। যদি মুহতামিম সাহেবকে চামড়ার মালিক না বানানো হয়, তা বিক্রি করার জন্য শুধু উকিল-প্রতিনিধি বানানো হয়, (সাধারণত যা হয়) তাহলে এ টাকা শুধু গরিব ছাত্রদের পেছনেই ব্যয় করতে হবে। অন্য কোনও কাজে ব্যয় করা যাবে না।
১১। কোরবানিদাতা কাউকে কোরবানির চামড়া বা মাংস দিয়ে এর পরিবর্তে তার কাছ থেকে কিছু কাপড় নিল। সেই কাপড় ব্যবহার করা তার জন্য বৈধ হবে। এর মূল্য সদকা করতে হবে না। একই সঙ্গে কোরবানিদাতা কাউকে কোরবানির মাংস দিয়ে এর পরিবর্তে তার কাছ থেকে ফলমূল কিংবা খাবার জাতীয় অন্য কিছু নিলে তা খাওয়া তার জন্য বৈধ হবে।
১২। কোরবানির চামড়া কাউকে হাদিয়া হিসেবে দেওয়া যায়। গরিবদের যেমন দেওয়া যায়, ধনীদেরও দেওয়া যায়।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী; শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।
তথ্যসূত্র : মুসনাদে আহমাদ, ফাতাওয়া শামি, ফাতাওয়া তাতারখানিয়া, বাদায়েউস সানায়ে, দুররে মুখতার, আহসানুল ফাতাওয়া, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া, কিতাবুল ফাতাওয়া, জাওয়াহেরুল ফিকহ এবং ‘জিলহজ ও কুরবানী লি মামুন আব্দুল্লাহ কাসেমী’।