শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধে ১৯৮২ সালে তৎকালীন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জারি করা আদেশটি এখনও ধরে রেখেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার (২৮ মে) মন্ত্রিপরিষদের নিয়মিত সভায় এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই ইস্যুটিসহ এ ধরনের অন্য বিষয়গুলোও একত্রিত করে পরবর্তী বৈঠকে উত্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, এমন একাধিক সিনিয়র মন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব বাংলা ট্রিবিউনকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহম্মদ শফিউল আলম বলেন, ‘বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে তোলা হয়েছিল। কিন্তু কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। এ সংক্রান্ত আরও কোনও বিষয় পেন্ডিং থাকলে, সেগুলোও একত্রিত করে পরবর্তী যেকোনও বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে, সোমবারের মন্ত্রিসভা বৈঠকে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের ইস্যুটি উত্থাপন করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সরকারের একাধিক সিনিয়র মন্ত্রী। তারা বলছেন, ১৯৮২ সালে তৎকালীন সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের শাসনামলে জারি করা বিষয়টি হঠাৎ এতদিন পর আবার কেন মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে তোলা হলো? তারা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমলারা এই সময়ে কেন সেই পুরনো বিষয়টি নতুন করে উপস্থাপন করলেন, তা বোধগম্য নয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে কোন সময় কোন বিষয়টি উপস্থাপন করতে হবে, তা কি তারা বোঝেন না?’
জানতে চাইলে সরকারের একজন সিনিয়র মন্ত্রী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত সামরিক সরকারের আমলে জারি করা সব আইন-কানুন, বিধিবিধান ও অধ্যাদেশ উচ্চ আদালতের নির্দেশে বাতিল হয়ে গেছে। তাহলে ওই সময়ের একটি ইস্যু আবারও মন্ত্রিসভার বৈঠকে কেন উপস্থাপন করা হলো, তা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে।’
এর আগে শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি বন্ধ করা সংক্রান্ত একটি বিষয় মন্ত্রিসভা বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য পাঠানো হয়েছিল। মন্ত্রিসভা থেকে বিষয়টি নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেওয়া হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়টি প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে উপস্থাপন করে। সচিব কমিটি বলেছে, মন্ত্রিসভা বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত পরিবর্তন বা পরিমার্জন করার এখতিয়ার সচিব কমিটির নেই। এরপরই বিষয়টি মন্ত্রিসভা বৈঠকে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সোমবার (২৮ মে) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ বিষয়টি আলোচিত হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দেশে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার জন্য মন্ত্রিসভা বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তিনি তার দলের ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজের রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে অন্য সব রাজনৈতিক দলকে তাদের ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
একইসঙ্গে ওই সময় মন্ত্রিসভা বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতিমুক্ত থাকবে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে। এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কী কী সুবিধা দেওয়া যেতে পারে, তা খুঁজে বের করার জন্য তৎকালীন শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু ওই কমিটি আজ পর্যন্ত সংক্রান্ত কোনও প্রতিবেদন জমা দেয়নি। সরকারের নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রিসভা বৈঠকের কোনও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত না হলে তা মন্ত্রিসভাকে জানাতে হয়। প্রতি তিন মাস পরপর সেই প্রতিবেদন মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করে তার অনুমোদন নিতে হয়।
জানা গেছে, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতি বিষয়ে দুটি সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব অনুমোদনের বিষয়টি মন্ত্রিসভা বৈঠকের এজেন্ডায় দেখে অনেক মন্ত্রীই অবাক হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে একজন সিনিয়র মন্ত্রী বলেন, ‘আমলাদের কি আর কাজ নেই? পুরনো একটি ইস্যু তুলে বিতর্ক সৃষ্টি করছেন। আগামীকাল রাত থেকেই টকশো শুরু হবে। পত্রিকাগুলো বিশেষ কলাম লেখা শুরু করবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত একটি স্ট্যান্ডবাজি ছিল। কারণ, তার জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন মাঠে ছিল না। নিজের ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ করে তিনি তৎকালীন বিরোধী দলগুলোকে ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিলেন।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে একজন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘উচ্চ আদালত বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে। এ অবস্থায় ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার সুযোগ নেই। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্টুডেন্ট কেবিনেট গঠন করে শিক্ষার্থীদের গণতন্ত্রের প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়। এ সবকিছুই ছাত্র রাজনীতির অংশ।’ তিনি বলেন, ‘আদালত তো সামরিক সরকারের সব আইন-কানুন, বিধি-বিধান, অধ্যাদেশ বাতিল করে দিয়েছেন। এরপরও ওই সময়ের একটি সিদ্ধান্ত আবার কোন মতলবে আমলরা যে সামনে নিয়ে আসছেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়।’