২০১১ সাল, ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে মুখোমুখি বাংলাদেশ ও ভারত। টিভির পর্দায় সেই ম্যাচ দেখতে দৃষ্টিনিবদ্ধ মোহাম্মদ প্রান্তিক নওরোজ নাবিলের। আশা ছিল ম্যাচ শেষে মেতে উঠবেন জয়ের উল্লাসে। কিন্তু ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে (২০১১) বাংলাদেশ ম্যাচটা হেরে যায় ৮৭ রানে। সেই হার তাকে এতই যন্ত্রণা দেয়, জেগে ছিলেন সারা রাত। সেই সময়ই এমন ভাবনা পেয়ে বসে প্রান্তিককে−‘একদিন ক্রিকেটার হয়ে ঠিকই দলকে জেতাবো।’
প্রান্তিকের ক্রিকেটার হওয়ার অদম্য ইচ্ছার শুরুটা এখান থেকেই! যা তাকে নিয়ে এসেছে বিশ্বকাপের মঞ্চে।
প্রান্তিক মূলত টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। প্রয়োজনে মিডিয়াম পেসেও বল করতে পারেন। সব মিলিয়ে আধুনিক ক্রিকেটারদের সবরকম গুণই আছে প্রান্তিকের দখলে। সেই গুণের প্রাথমিক প্রকাশ ঘটে গেছে এর মধ্যেই। এখন তিনি নিজেকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে পারেন দক্ষিণ আফ্রিকায় শুরু হতে যাওয়া অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে।
অনূর্ধ্ব-১৯ যুব বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ১৫ যোদ্ধাকে নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা ট্রিবিউনে। আজ থাকছে টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ প্রান্তিক নওরোজ নাবিলের একান্ত সাক্ষাৎকার−
বাংলা ট্রিবিউন: শুনেছি আপনি ভালো ছাত্র, ক্রিকেটে কেন এলেন?
প্রান্তিক: ২০১১ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রথম ম্যাচ চলছিল। আমাদের যতটুকু প্রত্যাশা ছিল তার চেয়ে বেশি ভালো ব্যাটিং করেছে ভারত। বাংলাদেশ হেরে যাওয়ার পর অনেক খারাপ লেগেছিল তখন। কান্না করেছিলাম। বাংলাদেশের হারের পর মনে হয়েছিল ক্রিকেট আমার আবেগের জায়গা, যদি খেলতাম জেতাতে পারতাম। এগুলো আমার মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে শেয়ার করেছিলাম। আমার স্বপ্ন পূরণ করতে আসলে উনিই ভূমিকা রেখেছেন।
বাংলা ট্রিবিউন: কীভাবে উনি আপনার স্বপ্ন পূরণ করলেন?
প্রান্তিক: রাজীব আল মামুন, আমার মামাতো ভাই। উনি আমার মেন্টর, গাইড সবকিছু। আমার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রভাব রেখেছেন উনি। ক্রিকেটের প্রতি তারও আবেগ ছিল। উনি বাসায় বলেছিলেন বিকেএসপিতে ভর্তি হতে চান। কিন্তু তার পরিবার ভর্তি হতে দেয়নি। তখন অবশ্য আমাদের ক্রিকেটও এতটা প্রতিষ্ঠিত ছিল না। তাকে ভুল বুঝিয়ে ক্যাডেটে ভর্তি করানো হয়। অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। নিজের স্বপ্ন পূরণ না হলেও আমার স্বপ্ন পূরণ করতে ভূমিকা রেখেছেন অনেক। এরপর ২০১১ সালে উনি আমাকে খুলনা মোহামেডান ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন।
বাংলা ট্রিবিউন: ক্রিকেটার হওয়ার বাকি পথটা কেমন ছিল?
প্রান্তিক: আমার ক্রিকেট দীক্ষা শুরু মোহামেডানের কোচ সেলিম স্যারের কাছ থেকে। ২০১৫ সালে দিনাজপুর বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পর অঙ্কন স্যার এবং টুটুল স্যারের অনেক ভূমিকা আছে। তাদের না পেলে আমি হয়তো পথহারা হয়ে যেতে পারতাম। একটা সময় কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে। স্যাররা আমার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে ম্যাচও আয়োজন করেছিল। সেখানে আমি একটি সেঞ্চুরি করে আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নিতে পেরেছিলাম।
বাংলা ট্রিবিউন: পরিবার থেকে কোনও বাধা এসেছিল?
প্রান্তিক: পরিবারের সমর্থনটা শুরুতে আসে না। আমি এমনিতেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র ছিলাম। পড়াশোনাতেও ভালো ছিলাম। সবমিলিয়ে পরিবার চাইতো না ক্রিকেট খেলি। শুরুতে কষ্ট করতে হয়েছে। আমার দিন শুরু হতো সকালে স্কুল দিয়ে, দুইটার দিকে বাসায় আসতাম, কেবল খেতে। মাঝে মাঝে না খেয়েই বেরিয়ে যেতাম। মাঠে যেতে ২০ মিনিটের মতো লাগতো। ঘাম নিয়েই আবার যেতাম কোচিংয়ে। সেখান থেকে রাত ৯-১০টা বাসায় ফিরতাম।
বাংলা ট্রিবিউন: এই মুহূর্তে আপনাকে নিয়ে পরিবারের ভাবনা কী?
প্রান্তিক: বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে যখন বাংলাদেশের জার্সিতে খেলতে থাকলাম, স্বাভাবিকভাবেই পরিবার খুশি হতে লাগলো। আর্থিকভাবে আমার পরিবার ক্রিকেটের ওপর নির্ভরশীল নয়। ক্রিকেটটা মূলত আবেগ থেকেই খেলা হয়। আমার স্বপ্ন আমি টেস্ট ক্রিকেট খেলবো। বাংলাদেশের সেরা টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান হবো। অনেক বড় পরিবর্তন আনবো। নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করবো। আমি ক্রিকেট খেলে আর্থিকভাবে অনেক কিছু করবো, এমনটা আমার পরিবার আশা করে না।
বাংলা ট্রিবিউন: খুব নিকটে বিশ্বকাপ, দলের প্রস্তুতি কেমন?
প্রান্তিক: আমাদের দলের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে−এখানে কেউই মনে করে না যে তারা এক্সট্রা অর্ডিনারি। এখানে সবার আলাদা আলাদা দায়িত্ব দেওয়া আছে। কেউ চায় না যে আমি হিরো হবো। আমরা ক্যাম্প করতে করতে, একসঙ্গে থাকতে থাকতে পরিবারের মতো হয়ে গেছি। সবাই জানে সবার ভূমিকা কী, আমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বগুলো ভাগ করে নিয়েছি। আমাদের দলের কম্বিনেশনটাই আমাদের শক্তিশালী দিক।
বাংলা ট্রিবিউন: তাহলে নিশ্চয়ই এবার বিশ্বকাপের আক্ষেপটা দূর হচ্ছে?
প্রান্তিক: আমাদের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে আমরা অনেক আশাবাদী। তবে যেহেতু এটা ক্রিকেট খেলা, কেউই জানে না কী ঘটবে! কেননা ক্রিকেটে যে কোনও কিছুই হতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা আছে অন্তত ফাইনালে যাওয়া। তবে আমাদের লক্ষ্য ম্যাচ বাই ম্যাচ খেলা। মূল লক্ষ্য তো বিশ্বকাপ জেতাই। কিন্তু শুরুতেই এভাবে ভাবলে চাপ তৈরি হয়ে যাবে। গত দুই বছর আমরা যে কষ্ট করেছি, অবশ্যই এই ট্রফি ডিজার্ভ করি।
বাংলা ট্রিবিউন: এই ধরনের কন্ডিশনে খেলতে অভ্যস্ত নন, ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিস্থিতি কতটা কঠিন হবে?
প্রান্তিক: ইংল্যান্ড সফরটা খারাপ হওয়ার কারণে আমি নিউজিল্যান্ড সফরে যেতে পারিনি। আমার জন্য ওটা একটা শিক্ষা ছিল। ইংল্যান্ড সফরে উইকেট দেখেছি। ওখানে পারফরম্যান্স না হওয়াতে দেশে ফিরে কঠোর পরিশ্রম করেছি। এরপর আমার রান বেড়েছে। সবমিলিয়ে প্রস্তুতি ভালোই। এখন দেখা যাক মূল মঞ্চে কী করি।
বাংলা ট্রিবিউন: ব্যক্তিগত লক্ষ্য কী?
প্রান্তিক: ধীরে শুরু করে আক্রমণে যাওয়া আমার খেলার ধরন। আমি কোনও সংখ্যা দিয়ে আমার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে চাই না। এভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ করলে আমার বাড়তি চাপ তৈরি হয়। আমি সামর্থ্য অনুযায়ী খেলতে চাই, ঠিক দলের পরিকল্পনা অনুযায়ী।
বাংলা ট্রিবিউন: শুনেছি মিডিয়াম পেসে কয়েকবার ব্রেক থ্রু নাকি দিয়েছেন?
প্রান্তিক: নেটে বোলিং করতে গিয়ে দেখি, বোলিংটা ভালোই হচ্ছে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে টেস্ট ম্যাচে ওদের উইকেট পড়ছিলই না। দিনের শেষ ওভারে আমি বোলিংয়ে গেলাম। একটা কট বিহাইন্ডের সুযোগ এলো। কঠিন ছিল কিন্তু মিস হলো। শেষ বলে উইকেট পেলাম। ওই উইকেট পাওয়ার পর দল যেভাবে উদযাপন করেছে, সেটা কোনও সিরিজ জিতলেও করা হয় না। ওখান থেকে আমার বোলিংটা শুরু হয়। এর পরে আরও কয়েকবার ব্রেক থ্রু দিয়েছিলাম। এখন নিজের বোলিংয়ের ওপর বিশ্বাস আছে। কখনো প্রয়োজন পড়লে আমি বোলিংয়ে ভালো করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী।
বাংলা ট্রিবিউন: মুশফিককে কেন অনুসরণ করেন?
প্রান্তিক: তার কাছ থেকে শেখার অনেক কিছু আছে। তিনি সর্বোচ্চ শিক্ষিত একজন মানুষ। তাকে আইকন হিসেবে নেওয়ার অনেক কিছু আছে। আমি তার মতো হতে চাই। তার মতো খেলোয়াড় না হতে পারি, তার মতো মানুষ হতে চাই। এর বাইরে আমার স্টিভেন স্মিথ, বিরাট কোহলি ও কেন উইলিয়ামসনের খেলা ভালো লাগে।
প্রোফাইল
নাম মো: প্রান্তিক নওরোজ নাবিল
ডাক নাম: নাবিল
জন্ম: ১৩ নভেম্বর, ২০০৩
জন্মস্থান: খুলনা
উচ্চতা: ৫ ফুট সাড়ে ৭ ইঞ্চি
পড়াশোনা: এইচএসসি প্রথমবর্ষ
প্রথম ক্লাব: মোহামেডান ক্রিকেট একাডেমি
বর্তমান ক্লাব: বিকেএসপি
ব্যাটিং স্টাইল : বাঁহাতি
প্রিয় শটস : স্কয়ার কাট
প্রিয় ডেলিভারি: লেন্থ বল যখন আউটসুইং হয়ে বেরিয়ে যায়
প্রিয় মানুষ: অনিক আল মামুন
প্রিয় ক্রিকেটার: মুশফিকুর রহিম
প্রিয় বন্ধু : তোকি তাজওয়ার
ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত : প্রথম এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৫৮ রান করেছিলাম।
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন।