X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

‘প্রথম দিন থেকেই আয়ের চিন্তা করতে হবে’

হিটলার এ. হালিম
০১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৯:৩৩আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৯:৩৯

আরিফ নিজামী ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক। তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উদ্যোক্তাদের গড়ে ওঠা, ব্যর্থ হওয়া, ঝরে পড়া খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। উদ্যোক্তাদের সমস্যা দূর করতে গড়ে তোলেন প্রেনিউর ল্যাব নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সমস্যা দূর করতে গিয়ে তিনি নিজেই এখন একজন সফল উদ্যোক্তা। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানিয়েছেন তার স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজের বিভিন্ন বিষয় এবং স্টার্টআপ নিয়ে। 

 

আরিফ নিজামী

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি বিভিন্ন ডেভেলপার গ্রুপ নিয়ে কাজ করেন। কাজ করেছেন গুগল ডেভেলপার গ্রুপ নিয়ে। যদি এ থেকে প্রাপ্তির বিষয়টি জানান।

আরিফ নিজামী: আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো বিশ্বের টেক জায়ান্টদের যেকোনোভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে ‘এনগেজড’ করা। বাংলাদেশে যে বিশাল তরুণ সমাজ আছে সেটা তাদের সামনে তুলে ধরা যেন বাংলাদেশে কাজ শুরু করে। আমরা গুগল ডেভেলপারস গ্রুপ চালুর আগে বাংলাদেশে কোনও গুগল কমিউনিটি ছিল না। ফলে আমাদের সঙ্গে গুগলের কোনও যোগাযোগও ছিল না। এটা চালুর পর আমাদের সঙ্গে সেই যোগাযোগটা চালু হয়ে যায় এবং এরপর যা হয়েছে তা বিস্ময়কর। বাংলাদেশের যে গুগল ম্যাপ করা সেটা কিন্তু আমাদের তরুণরাই করেছে। বাংলাদেশ থেকে গুগল ট্রান্সলেটরে সবচেয়ে বেশি শব্দ যোগ হয়েছে। সাত লাখেরও বেশি শব্দ যোগ হয় এখান থেকে। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি ৭৪৬ টা অ্যাপ একদিনে তৈরি করা হয়েছে। লোকাল গাইডসে বাংলাদেশ পুরস্কারও পেল।

এই যে বাংলাদেশে উবার এলো, উবার কিন্তু গুগল ম্যাপ দেখেই চলে। অর্থাৎ গুগল ম্যাপ যদি ভালো না হতো তাহলে আমরা উবারের সেবাটাও এতো সঠিকভাবে পেতাম না। গুগল ভয়েসের ক্ষেত্রেও তাই। 

গুগলের কোনও সামিটে যখন উইমেন টেকমেকার্সের কথা আসে তখন বাংলাদেশের উইমেন টেকমেকার্সের কথা সেখানে আসে। আমরা এক মাসে ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছিলাম। যেটা বিশ্বের অন্য কোনও দেশে হয় না। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিলো তরুণদের জন্য সুযোগ তৈরি করা। যাতে তারা কিছু না কিছু করতে পারে। যে শুধু ম্যাপ বানায় সে যেন ম্যাপিংটাও করতে পারে। তাদের জন্য যেন একটা সুযোগ তৈরি হয়। তরুণরা যেন প্রযুক্তিকে একটা টুল হিসেবে ব্যবহার করে, কেবল বিনোদনের জন্য নয়।

একটা উদাহরণ দিলে এই কাজের ফল বুঝতে পারবেন। এই যে বাংলাদেশে উবার এলো, উবার কিন্তু গুগল ম্যাপ দেখেই চলে। অর্থাৎ গুগল ম্যাপ যদি ভালো না হতো তাহলে আমরা উবারের সেবাটাও এতো সঠিকভাবে পেতাম না। গুগল ভয়েসের ক্ষেত্রেও তাই। সেটাও আমাদের তরুণরাই করেছে। এখন যে দেখছেন গুগলে বাংলা কথা বললে সেটা টাইপ হয়ে যাচ্ছে- সেটাও এখানকার তরুণদেরই করা।

বাংলা ট্রিবিউন:  আপনি বর্তমানে দেশে ফেসবুক ডেভেলপার কমিউনিটি নিয়ে কাজ করছেন। সাড়া কেমন পাচ্ছেন আর কাজের ধরনটাই বা কেমন?

আরিফ নিজামী: ফেসবুকের ক্ষেত্রে বলতে গেলে, ফেসবুক যখন চিন্তা করলো ডেভেলপারদের জন্য কমিউনিটি করবে তখন বাংলাদেশ প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে ছিলো। এর কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে তারুণ্যের প্রাচুর্য এবং উর্ধ্বগামী ডিজিটাল ল্যান্ডস্কেপ। ফেসবুক কমিউনিটি তৈরির উদ্দেশ্য ছিল যেন আমাদের তরুণরা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ফেসবুককে কাজে লাগিয়ে উপার্জন বা স্টার্টআপ করার সুবিধাটা মিস না করে। যেমন ‘ফেসবুক স্টার্ট’ নামে একটা সুবিধা আছে অনলাইনে যেটাতে ফেসবুক স্টার্টআপদের নানা ধরনের সহযোগিতা করে। যেমন ৫০ হাজার ডলারের একটা ফ্রি ফেসবুক ক্রেডিট দেয়। একটা নতুন ব্যবসার প্রচারণার জন্য এটা বেশ সহায়ক।

এখন ফেসবুকের ডেভেলপার সামিটে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ করছে। বাংলাদেশেও আমরা ফেসবুকের ‘ডেভেলপার সামিট হোস্ট’ করি। সেখানে ফেসবুকের প্রতিনিধি থাকে। ফলে তরুণদের জন্য আরও সুযোগ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ফেসবুকের স্টার্টআপদের শো-কেস করার জন্য একটা ওয়েবসাইট আছে সেখানে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রকল্প স্থান পেয়েছে। এমনকি মার্ক জাকারবার্গের কি-নোট স্পিচেও বাংলাদেশে স্টার্টআপের নাম এসেছে। এটা আমাদের স্টার্ট-আপদের জন্য অনেক বড় একটি সুযোগ। ফেসবুকের ফ্রি বেসিকের ফলে আমাদের দেশের অনেকে ফ্রি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছে। সেখানে খুঁজুন নামে একটা সার্চ ইঞ্জিন দিয়ে বাংলাদেশের অনেক ওয়েবসাইট ব্রাউজ করা যায়। এমন অনেক সুবিধার দুয়ার ফেসবুক খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের ফেসবুক কমিউনিটি এখন বিশ্বের মধ্যে অনেক বড়। কয়েক মাস আগেও আমাদের কমিউনিটিটা সবচেয়ে বড় ছিলো। বর্তমানে মুম্বাই সবচেয়ে বড়।

বাংলা ট্রিবিউন:  গুগল, ফেসবুকের প্রধান কার্যালয় ঘুরে দেখার সুযোগ আপনার হয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটিতে কাজের পরিবেশ কেমন?

আরিফ নিজামী:  বাংলাদেশে যখন আমরা কোনও আইটি অফিসের চিন্তা করি তখন দেখি হয়তো ১০-২০ জন মানুষের একটা অংশগ্রহণ। গুগলের ক্যাম্পাস কিন্তু একটা এলাকা। সেখানে একটা বিল্ডিং হচ্ছে একটা ইউনিট। ফেসবুকের অফিস হচ্ছে আবার একটা ছোটখাটো শহরের মতো। সেখানে মোটামুটি সব আছে। সেখানে দেখা যায় বড় বড় সব কর্মকর্তা শর্টস পরে চলে আসছে। তাদের কাছে ফর্মালিটিজেরর চেয়ে কাজটা গুরুত্বপূর্ণ। এসব বড় কোম্পানির কার্যালয়গুলোর মুক্ত পরিবেশ হচ্ছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সেখানে ফেসবুক হোক বা গুগল সব জায়গাতেই আছে। তবে যেহেতু দুটি আলাদা আলাদা কোম্পানি একটু আলাদা তো হবেই।

স্বেচ্ছাসেবক থেকে উদ্যোক্তা আরিফ নিজামী

বাংলা ট্রিবিউন: প্রেনিউর ল্যাব গড়ে ওঠার কাহিনী জানতে চাই।

আরিফ নিজামী: ছোটবেলা থেকেই আমার আইটির প্রতি আগ্রহ ছিলো। আমি অনেক জায়গায় ভলান্টিয়ার হিসবে কাজ করেছি। এই দু’টি ক্ষেত্রই ছিল আমার আগ্রহের জায়গা। সে সময় ভাবলাম কিভাবে আমার দু’টি আগ্রহের জায়গায় একসঙ্গে কাজ করা যায়। আইটিকে কাজে লাগিয়ে সামাজিক সমস্যা সমাধানের চিন্তা মাথায় আসে সেখান থেকে। তার ওপর সোশ্যাল এন্টারপ্রেনিয়ররা সবসময় আলাদা সম্মানও পায়। সেটিও একটি প্রভাবক ছিল এদিকে কাজ করার জন্য। সেই চিন্তা থেকে প্রেনিউর ল্যাব শুরু করা। যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো উদ্যোক্তাদের সহায়তা করা। কাজ শুরুর কয়েক মাস পরে দেখলাম আমাদের দেশে উদ্যোক্তা সেভাবে তৈরি হয়নি। যে কয়েকটি স্টার্টআপ আছে তারাও সেভাবে ফোকাসড না। পরে আমরা নিজেরাই চিন্তা করলাম  প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করব।

বাংলা ট্রিবিউন: প্রেনিউর ল্যাব মূলত কী ধরনের কাজ নিয়ে এগুচ্ছে?

আরিফ নিজামী: প্রেনিউর ল্যাব থেকে আমরা তিনটা বিষয়ের ওপর মূলত ফোকাস করেছি। তারুণ্য, নারী ও উদ্যোক্তা। আমরা নারীদের জন্য প্রযুক্তি তৈরি করি। ঢাকা শহরে পাবলিক টয়লেট নিয়ে আমাদের একটা প্রকল্প ছিল যেটা আমাদের অনেক পুরস্কার এনে দিয়েছে। ‘টেক ফর পিস’ নামে একটি প্রকল্প আছে যেটা তরুণদের শিক্ষা দেয় কিভাবে আমরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে একটা শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়তে পারি। ‘ডোনেট ডট কম ডট বিডি’ নামে একটা ওয়েবসাইট আছে যেটা বিভিন্ন দুর্যোগের সময় দুর্গতদের ‘হেল্প’ করতে আমরা তৈরি করেছি।

স্টার্টআপে টিকে থাকার মূল উপায় হচ্ছে প্রথম দিন থেকেই আয়ের চিন্তা করতে হবে। ‘ফান্ড’ পাওয়া কোনও কোম্পানির মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। কোম্পানির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পণ্য তৈরি করা এবং আয় করা।

বাংলা ট্রিবিউন: কাজ করতে গেলে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় উদ্যোক্তাদের? 

আরিফ নিজামী: বাংলাদেশে প্রযুক্তিবিষয়ক কিছু করতে চাইলে প্রথম যে চ্যালেঞ্জ আসে সেটা হচ্ছে একটা কার্যকর টিমের অভাব। পারিবারিক চাপও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আরেকটি চ্যালেঞ্জের জায়গা হচ্ছে, বাজার গবেষণার কোনও প্রতিষ্ঠান নেই। আমাদের অনেক সেবাপণ্য ব্যর্থ হচ্ছে কেবল আমাদের কাছে তথ্য নেই যে এই সেবাপণ্যটির সম্ভাবনা কতটা। ‘ফান্ডিং’ একটা সমস্যা বটে। তবে সেটা দরকার হয় ‘স্কেলিং আপ’-এর জন্য। ফান্ডিংটা যেন চাপের না হয়। ফান্ডিং হওয়ার পরে যদি বার বার চাপ আসে তাহলে সেটা বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর।

বাংলা ট্রিবিউন: স্টার্টআপ গুলোর টিকে থাকা বা সফল হওয়ার মূলমন্ত্র কী?

আরিফ নিজামী: স্টার্টআপে টিকে থাকার মূল উপায় হচ্ছে প্রথম দিন থেকেই আয়ের চিন্তা করতে হবে। ‘ফান্ড’ পাওয়া কোনও কোম্পানির মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। কোম্পানির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পণ্য তৈরি করা এবং আয় করা। আমাদের অনেক স্টার্টআপ এখনও জানে না তাদের প্রকল্প থেকে কিভাবে টাকা আসবে। এমন হলে আসলে সেটি একটি ভালো ‘আইডিয়া’ হিসেবেই থেকে যাবে। কখনও স্টার্টআপ হয়ে উঠবে না।

বাংলা ট্রিবিউন: আগামীতে কোন খাতে স্টার্টআপ ভালো করতে পারে বলে মনে করেন?

আরিফ নিজামী: বাংলাদেশে এখনও লোকালাইজড টেকনোলজি, এডুকেশন ও হেলথ সেক্টরে অনেক কাজ করার সুযোগ আছে। এসব ক্ষেত্রে যেসব কাজ হচ্ছে আমার মনে হয় সব সারফেস লেভেলে হচ্ছে। আশাকরি আগামীতে আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রযুক্তিগত বড় পরিবর্তন আসবে। 

বাংলা ট্রিবিউন: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আরিফ নিজামী: বাংলা ট্রিবিউনকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ।

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

শ্রুতি লিখন: এম এম রহমান

 

 

/এইচএএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
ন্যাশনাল ব্যাংকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন, নিয়োগ পেলেন ১০ জন 
ন্যাশনাল ব্যাংকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন, নিয়োগ পেলেন ১০ জন 
স্বস্তির জয়ে শিরোপার লড়াইয়ে ফিরলো লিভারপুল
স্বস্তির জয়ে শিরোপার লড়াইয়ে ফিরলো লিভারপুল
সর্বাধিক পঠিত
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
সব জেনেও পুলিশকে কিছু জানাননি মিল্টনের স্ত্রী
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ডিবি হারুনসব জেনেও পুলিশকে কিছু জানাননি মিল্টনের স্ত্রী