X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস

দেশে শ্রমজীবীদের ডিজিটাল সাক্ষরতার চিত্র কেমন

হিটলার এ. হালিম, সুবর্ণ আসসাইফ ও ওবাইদুর সাইদ
১২ ডিসেম্বর ২০২২, ২৩:২৭আপডেট : ১২ ডিসেম্বর ২০২২, ২৩:৩৬

মনোযোগ দিয়ে ফেসবুকিং করছেন মোহাম্মদ আজাদ মিয়া। বরিশাল থেকে ঢাকায় এসেছেন রিকশা চালাতে। যাত্রী না থাকায় মোবাইলে ফেসবুক ব্যবহার করছিলেন। কথা বলে জানা গেলো স্মার্টফোন ব্যবহার করেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। বললেন, ‘ঢাকায় রিকশা চালাই। চাইলেও যখন-তখন যেতে পারি না। ভিডিও কলে কথা বলি।’ যখন অবসর পান বা যাত্রী থাকে না সেই সব ফাঁক-ফোকরে ফেসবুকে স্ক্রল করে দেশের খবর জানার চেষ্টা করেন। জানালেন এমবির (ইন্টারনেট) পেছনে মাসে ৩০০-৪০০ টাকা খরচ হয়।

সোমবার (১২ ডিসেম্বর) ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় রিকশা ও সিএনজি চালকদের সঙ্গে কথা হয়।

তাদের বেশ কয়েকজন জানান, স্মার্টফোন আসায় পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সুবিধা হয়েছে। আগে শুধু কথা বলা যেতো। এখন কথা বলার পাশাপাশি ভিডিও কলে সবাইকে দেখা যায়। অবসর সময়ে বসে না থেকে দেশ-বিদেশের খবর জানা যায়। টাচ মোবাইল (স্মার্টফোন) ব্যবহারে খরচ বেড়েছে। কাজের ফাঁকে স্মার্টফোন হাতে একজন অটোরিকশাচালক

মোহাম্মদ লিমন হোসেন ভাড়ায় সিনএনজিচালিত অটোরিকশা চালান। স্মার্টফোনে রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান ‘ও ভাই’ অ্যাপ ব্যবহার করে ট্রিপ পান। তবে পরিমাণটা অল্প। জানালেন, এসব অ্যাপসের চেয়ে সাধারণভাবে চালালেই আয় বেশি। ৪০০ টাকার এমবি (ডেটা বা ইন্টারনেট) হলে মাস চলে যায়। অবসর সময় তিনি ফেসবুক, ইউটিউব চালান, পরিবারের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন। আগে ঢাকায় এসে একমাসের বেশি থাকা যেতো না। ছোট ছেলে-মেয়েদের জন্য হলেও বাড়ি যেতে হয়। এখন দেড় মাস-দুই মাস পর বাড়ি যাই। স্মার্টফোন হয়ে সুবিধা হয়েছে সবাইকে ঢাকায় থেকেই দেখতে পারি। কথা বলতে পারি।

রাসেল মিয়া এসেছেন জামালপুর থেকে। ঢাকার রাস্তায় রিকশা চালান। রিকশা চালালেও প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে নেই। লাভা ফোন ব্যবহার করেন। এই ফোন দিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেন নিয়মিত। প্যাকেজ ভিত্তিতে ৪০০-৪৫০ টাকার প্যাকেজ কেনেন। প্রতিদিনই পরিবারের সঙ্গে একবেলা হলেও ভিডিও কলে কথা বলেন।

কেন এতো টাকার প্যাকেজ কেনেন জানতে চাইলে বলেন, প্রতিদিন কথা বললে তো ১০ টাকার মতো লাগে। সে হিসেবে ৩০০ টাকা লাগে। পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তাই টাকার হিসাব করি না। তার চেয়ে একটু বেশি দিয়ে মিনিট ও এমবি উভয়ই কিনে ভিডিও কলে কথা বলি ও ইউটিউব চালাই।

এছাড়া ব্যক্তিগত বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের গাড়ি চালকদের এ সময়ে বিনোদনের প্রধান উপকরণ হয়ে ওঠেছে তাদের হাতের মোবাইল ফোন। ফেসবুক রিলস, ভিডিও, ইউটিউব, টিকটক ইত্যাদি দেখে তাদের সময় কাটে। বিভিন্ন ধরনের গেমসও খেলে থাকে তারা মোবাইল ফোনে। বিশেষ করে শ্রমজীবী এ শ্রেণির কাছে মোবাইলে লুডু খেলা খুব পছন্দের। দেশে শ্রমজীবীদের ডিজিটাল সাক্ষরতার চিত্র কেমন

বর্তমানে দেশে সাড়ে ৫ কোটির বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী। বাংলাদেশে ১৮ কোটি ১৪ লাখের বেশি মোবাইল সংযোগ, ১৩ কোটির বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছেন। এর একটা বড় অংশ সমাজের শ্রমজীবী শ্রেণির লোকজন যারা স্মার্টফোন ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠছেন। ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ডভ্যান চালকেরা অ্যাপ ব্যবহার করে কাজ বুক করছেন। ফিচার্ড ফোন চালাতে পারা লোকজনও ধীরে ধীরে স্মার্টফোনে দক্ষ হয়ে উঠছেন। সিএনজি অটোরিকশা চালকদের অনেকেই এখন বিকাশ বা নগদে ভাড়া নিচ্ছেন। সেই টাকা সপ্তাহ বা মাস শেষে পাঠিয়ে দিচ্ছেন পরিবারের কাছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) টিএসসির চা বিক্রেতা সিরাজুল ইসলাম সিরাজ ৩ বছর ধরে স্মার্টফোন ব্যবহার করছেন। ইউটিউব, ফেসবুকের সঙ্গে তার পরিচয় থাকলেও গুগল, পাঠাও, ফুডপান্ডা শব্দগুলো তার একেবারেই অচেনা। স্মার্টফোন দিয়ে কী কী করেন জানতে চাইলে বলেন, ফোনে কল দেওয়া ছাড়া লুডু নামিয়ে দিয়েছে ভার্সিটির এক মামা। লুডু খেলি মাঝেমাঝে। এক মামা ফেসবুক খুলে দিয়েছে তবে চালানো হয় না, কীভাবে কী করে বুঝি না। ইউটিউবে গান, সিনেমা, নাটক দেখি। বিকাশ ব্যবহার করেন, তবে ফোনে ট্রেনের টিকিট কাটা যায় তার জানা নেই।

কিশোরগঞ্জ থেকে ৬ বছর আগে ঢাকা এসেছেন জুয়েল। তখন থেকেই রিকশা চালানো তার পেশা। স্মার্টফোন আছে কিনা জানতে চাইলে, তিনি পকেট থেকে বাটন ফোন বের করে দেখান। স্মার্টফোন দিয়ে কী কী করা যায় জানা আছে কি এবং সামনে কেনার ইচ্ছে আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাটন ফোন দিয়ে কল করি, গান শুনি। টাচ ফোন কেনার টাকাতো নেই, তবে ইচ্ছে আছে।

ভ্যানচালক আনোয়ার হোসনকে স্মার্টফোনের কথা জিজ্ঞাসা করলে বলেন, আমার টাচফোন নেই, বাটন ফোন চালাই। টাচফোন কেনার সামর্থ্য নেই। সামনে টাকা-পয়সা হলে কিনবো। যখন কাজ থাকে না এক ভাইয়ের ফোনে ২-৪ জন মিলে লুডু খেলি।

অনেক শিক্ষার্থী বা বেকার তরুণ হাতের স্মার্টফোনের সঙ্গে একটি বাইসাইকেল জোগাড় করে রুটি-রুজির জন্য নেমে পড়ছে রাস্তায়। ফুড ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের অ্যাপ ব্যবহার করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসবই ডিজিটাল বাংলাদেশের দৃশ্যমান উন্নতি। ডিজিটাল বাংলাদেশের অবকাঠামো তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। এখন সেখান থেকে উত্তরণের পালা। আগামীতে স্মার্ট বাংলাদেশের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে দেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে প্রয়োজন হবে চারটি মূল ভিত্তির। এর একটি স্মার্ট সিটিজেন বা স্মার্ট নাগরিক। প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ না হলে স্মার্ট হওয়া যাবে না।

এ বিষয়ে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার সফলভাবে বাস্তবায়নের পর আমরা এখন নতুন কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। সেটি হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি—এ চার মূলভিত্তির ওপর গড়ে উঠবে ২০৪১ সাল নাগাদ একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ।

তবে স্মার্ট সিটিজেন বা স্মার্ট নাগরিক হতে হলে ডিজিটাল লিটারেসি বা ডিজিটাল সাক্ষরতা প্রয়োজন। এটার অভাব দেশে প্রকট। রিকশা বা অটোচালক বা গ্রামের একজন মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ফেসবুক ব্যবহার করতে পারলেও আইডি খুলতে জানেন না। যারা জানেন তাদের কাছ থেকে আইডি খুলে নেন। পাসওয়ার্ডটাও নিজে জানেন না। বিকাশ বা নগদ অ্যাকাউন্ট খোলার বেলায়ও একই ধরনের ঘটনা ঘটছে। ডিজিটাল লিটারেসি থাকলে আর এমনটা হয় না বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। যদিও সরকার এই বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে। আইসিটি বিভাগ ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার খুলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

নাম ও পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ডিজিটাল লিটারেসি সেন্টার থেকে আড়াই লাখের বেশি লোকজন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। যেকোনও বয়সের যেকেউ অনলাইনে কোর্সটি করতে পারে।

অনেকে বলছেন, ডিজিটাল লিটারেসি হলো ডিজিটাল ডিভাইস একসেস করতে পারা। অনেকেই পারে, আবার অনেকে পারে না। এই যে অনেকে পারে না এই সংখ্যাটা একেবারে কম নয়। ডিজিটাল লিটারেসির অভাব, ক্রয় ক্ষমতার বাইরের স্তরে বসবাস ইত্যাদির কারণে দেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের সংখ্যা মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের ৩০ শতাংশের কিছু বেশি বলে মনে করেন স্থানীয় মোবাইল উৎপাদক ও আমদানিকারকরা। যদিও জিএসএমএ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে বাংলাদেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪১ শতাংশ।

ছবি: ওবাইদুর সাইদ

/এমএস/
সম্পর্কিত
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
এআই স্মার্টফোন আনলো টেকনো
ল্যাটিটিউড সিরিজের নতুন ল্যাপটপ আনলো ডেল
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!