X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

খতিয়ে কী দেখবেন?

জোবাইদা নাসরীন
১১ জুন ২০২২, ২০:০৭আপডেট : ১১ জুন ২০২২, ২০:১১

একটি মুখ দেখে কলিজাটা ধড়ফড় করে ওঠে। বাচ্চা মেয়েটির বয়স ৭ মাস। মামার কাঁধে চেপে এসেছে ডিএনএ পরীক্ষা দিতে। শিশুটি কিছুই বোঝে না। কিন্তু অন্যরা জানে, হয়তো এই বাচ্চার ডিএনএ প্রমাণ করবে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া তার বাবার দেহ। কারণ দেহ দেখে শনাক্ত করার আর কোনও চিহ্ন বাকি নেই। সবই পুড়ে গেছে আগুনের লেলিহান শিখায়।

এখন আর এসব ঘটনায় কেউই হতবাক হয় না। তবে সাধারণ মানুষ সবার আগে ছুটে যায়। তারা আগুন নেভাতে পানি নিয়ে যায়, ওষুধপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে, সামান্য সিএনজি চালক বিনা ভাড়ায় হাসপাতালে আহতদের নিয়ে ছোটে। মিনিটে-মিনিটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভরে ওঠে রক্তদানের আহ্বানে। এটাই এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে মানবিক চিত্র। ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তারা ভেবেছিল সাধারণ আগুন লেগেছে। তাদের বলা হয়নি– সেখানে বিস্ফোরক রয়েছে। এর পরিণতিতে ফায়ার ব্রিগেড কর্মীদের মধ্য থেকে চলে গেছে নয় জনের প্রাণ।

গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী, সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে আগুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন মোট ৪৯ জন। হাসপাতালে ভর্তি আছে ২০০’র মতো।

ঘটনাটি গত ৪ জুন রাত দশটায় শুরু হয়। আগুনের খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে ছুটে যায় মানুষ। খবরটি সবার কাছে ছড়িয়ে দিতে অনেকেই ফেসবুকে লাইভ করেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ভিড় জমে যায়। তখনও কেউ জানতো না সেখানে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড আছে। মালিক পক্ষও এ বিষয়ে কাউকে সতর্ক করেনি। পরবর্তী ঘটনা হয়ে উঠেছে আরও ভয়াবহ। পানি পেয়ে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রূপ নিয়েছে বোমায় এবং একের পর এক কনটেইনার বিস্ফোরিত হয়েছে। মুহূর্তেই পুরো এলাকা প্রকম্পিত হতে শুরু করে। ঘটনার ব্যাপকতা এত বেশি ছিল যে, আশেপাশের তিন কিলোমিটার এলাকার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখনও কনটেইনার ডিপোতে লাশ খুঁজছে অনেকে। কারণ অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন।

একই ধরনের ঘটনা যখন বারবার ঘটে তখন আর সেসব দুর্ঘটনা থাকে না। তাই সীতাকুণ্ডে আগুনের ঘটনাকেও কোনোভাবেই ‘দুর্ঘটনা’ কিংবা ‘ট্র্যাজেডি’ বলা যাবে না। এগুলো সবই আসলে হত্যাকাণ্ড। প্রতিবছরই দেশে কোনও না কোনও গুদামে অথবা পোশাক কারখানায় (গার্মেন্ট) আগুন লাগে, এরপর পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া দেহ বের করা হয় গুনে গুনে। প্রতিবারই রাষ্ট্রীয় কর্তব্যক্তিরা বলেন– খতিয়ে দেখা হবে, তদন্ত হবে, দোষীদের শাস্তি দেওয়া হবে। কিন্তু কোনও কিছুরই আর দেখা মেলে না। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট জমা দিলেও তাতে কী লেখা থাকে কেউ জানে না। এভাবেই হারিয়ে যায় নিমতলী, তাজরীন গার্মেন্টস, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জুস কারখানা কিংবা সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোর মতো হত্যাকাণ্ড। কোনোটিরই আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি।

এবারের হত্যাকাণ্ডটির পর মালিক পক্ষ থেকে একটি নতুন বাহানা যোগ হয়েছে। আগুনের কারণ হিসেবে স্মার্ট গ্রুপ এবং ডিপোটির মালিক পক্ষের দাবি, এটি একটি নাশকতা। অর্থাৎ তাদের কোনও দোষ নেই। রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে অন্য কেউ এই নাশকতা ঘটিয়েছে। ডিপোটির মালিক রাজনীতিবিদ। তাই হিসাব-নিকাশ অনেকটাই সহজ করে ফেলেছেন তিনি। তবে এক্ষেত্রে মাননীয় একজন মন্ত্রীর ভূমিকার কথা তো বলতেই হবে। মালিকের আগেই তো সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী নাশকতার শঙ্কা প্রকাশ করে হত্যাকাণ্ডটিতে অনেকটাই রাজনীতির প্রলেপ দিয়ে ফেলেছেন। মৃত ৪৯ জন মানুষ নিয়ে থাকলে চলবে? মালিককে তো বাঁচাতে হবে!

মন্ত্রীর এই বক্তব্য মালিককে বেশ কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে তো বটেই, অনেকটা বাঁচিয়েও দিয়েছে বলা যায়। তাই তিনি মহৎ হওয়ার লক্ষ্যের দিকেই এগোচ্ছেন। কারণ দেখা গেছে, স্মার্ট গ্রুপকে অনেকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। কারণ নিজ প্রতিষ্ঠানের অনেক ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও তিনি এই দুর্ঘটনায় নিহত এবং আহতদের জন্য ‘নজিরবিহীন মানবিকতা’ দেখিয়েছেন। তিনি এই ঘটনায় মৃত ফায়ার ব্রিগেড কর্মীদের জন্য ১৫ লাখ টাকা, অঙ্গহানি হওয়া ব্যক্তিদের জন্য ১০ লাখ টাকা এবং আহতদের জন্য ৭ লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছেন। এছাড়া ডিপোর নিহত কর্মকর্তাদের জন্য ১০ লাখ টাকা, অঙ্গহানি হওয়া ব্যক্তিদের জন্য ৬ লাখ টাকা এবং আহতদের জন্য ৪ লাখ টাকা করে দেওয়ার কথাও ঘোষণায় এসেছে।

যার কারণে বা যে একদল লোকের কারণে এত বড় ‘হত্যাকাণ্ড’ ঘটলো সেখানে টাকা দিয়ে পুড়ে যাওয়া অঙ্গারকে অনেকটাই নিলামে তুলে টাকার মোড়কে ঢেকে দেওয়া হলো। এভাবে আর যাই হোক ‘মানবিক’ হওয়া যায় না। এখানে দায়ী অনেক পক্ষ। ডিপোর মালিক ব্যবসায়ী। তিনি ক্ষমতাসীন সরকারি দলের লোক। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কীভাবে ডিপো সঠিকভাবে পরীক্ষা করে সনদ দিলো? এ দেশে ক্ষমতা ও টাকা দিয়েই সব হয়। অবৈধভাবে কেন ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড রাখা হলো? যখন ফায়ার ব্রিগেড এলো আগুন নেভাতে তখনও কেন তাদের এই তথ্য দেওয়া হলো না?

এখন আর কোনও কিছু তদারকির দরকার পড়ে না। ক্ষমতাবানদের হাতেই সবকিছু তদারকি হয়ে যায়। আগুন শুধু সীতাকুণ্ডেই নয়; নিমতলী, তাজরীন, রূপগঞ্জের মতো আমার আপনার আশেপাশেই লাগতে পারে। কারণ বেআইনিভাবে জিনিসপত্র রাখা, শ্রমিকের জীবনের সুরক্ষা না থাকা, মিথ্যা তথ্য দিয়ে কাগজ বানানো– সবই এ দেশে সম্ভব। সবাই সবকিছু জানে। শুধু জানতে পারে না সাধারণ মানুষেরা। যারা ছুটে যায় অন্যকে বাঁচাতে। তারা জানে না– এমন মৃত্যুকূপ সব জায়গাতেই তৈরি হয়ে আছে।

আমরা এভাবে লোকজনের মৃত্যু দেখে এমনই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, এখন মেনে নিয়েছি– এগুলোর বিচার আর হবে না। এ পর্যন্ত স্বজনদের কাউকে বিচার চাইতে শুনিনি। তারা যখন জানতে পারে মালিক ক্ষমতাবান, তখন ভাবে বিচার চেয়ে আর কী হবে? তার চেয়ে বিচার না চাওয়াই বরং ভালো। আর এই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে ক্ষমতাবানরা। ঝনঝনিয়ে অর্থের শব্দ করে তোলে তারা। শেষমেষ সেই নিলামেই সব শেষ হয়ে যায়।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/জেএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সুন্দরবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু
সুন্দরবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক, পদসংখ্যা অনির্ধারিত
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক, পদসংখ্যা অনির্ধারিত
টানা তৃতীয়বার লন্ডনের মেয়র হলেন সাদিক খান
টানা তৃতীয়বার লন্ডনের মেয়র হলেন সাদিক খান
৪ বছর বয়সে শুরু, জিতেছেন ১৬টি গ্র্যামি
শুভ জন্মদিন৪ বছর বয়সে শুরু, জিতেছেন ১৬টি গ্র্যামি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ