X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

‘আঙুল ফুলে বট গাছ’

রুমিন ফারহানা
২৩ মার্চ ২০২৩, ১৬:২৯আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২৩, ১৬:২৯

আঙুল ফুলে বট গাছ– সেই গাছের ঝুড়ি নেমে গেছে বহুদূর, শেকড় মাটির গভীরে। পাঠক ভাবতে পারেন ‘আঙুল ফুলে কলা গাছ’ শুনেছি এতদিন, বট গাছ কেন? বট গাছ এ কারণেই যে বাংলাদেশে সমসাময়িককালে হঠাৎ করে ধনী হওয়া কিছু মানুষের সম্পদের পরিমাণ শুনলে কলা গাছ খুব তুচ্ছ, খুব ছোট মনে হয়। হঠাৎ করে হওয়া বলেই কিনা জানি না সেই সম্পদের প্রদর্শনী হয় দেখার মতো। ৪৫ কোটি টাকা দিয়ে সোনার বাজ পাখি তৈরি হয়, ব্যবসা উদ্বোধনে দেশ-বিদেশ থেকে উড়িয়ে আনা হয় নামিদামি তারকা। অতীত মুছতে মুছতে এমন পর্যায়ে যায় যে নামটা পর্যন্ত পাল্টে যায়। সোহাগ, রবিউল, আপন, হৃদিক নাম পেরিয়ে নতুন পরিচয় হয় আরাভ খান। বাবা ভাঙারির ব্যবসা করতেন, ছেলে করে সোনার ব্যবসা।

সেই সোনার ব্যবসা আবার যে সে সোনার ব্যবসা না। এই সোনার ব্যবসা নিয়ে তুলকালাম। দুবাইয়ের নিউ গোল্ড সুকে আরাভ জুয়েলার্স নামে একটি সোনার দোকান দিয়েছেন তিনি। যেটি উদ্বোধন করতে বাংলাদেশ থেকে উড়ে গেছেন ক্রীড়াঙ্গন ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের বেশ কয়েকজন তারকা। এদের মধ্যে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান যেমন আছেন, তেমনি আছেন লেখক সাদত হোসেইন, গায়ক নোবেল,  রুবেল খন্দকার, বেলাল খান, জাহেদ পারভেজ, পরিচালক দেবাশিষ বিশ্বাস। এমনকি বাদ পড়েননি হিরো আলমও।

একদিকে দুবাইয়ে যখন চলছে তারকা মেলা, চলছে জুয়েলার্স উদ্বোধন, তখন বাংলাদেশ পুলিশ বলছে ওই আরাভ খানই প্রকৃতপক্ষে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার রবিউল ইসলাম। ৪ বছর আগে ঢাকায় একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার আসামি হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন তিনি। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৮ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন এমরান খান হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে ভারতে চলে যান সে সময়ের ৩০ বছর বয়সী রবিউল ইসলাম। সেখানে বিয়ে করেন। পরে ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করেন। সেই পাসপোর্ট দিয়েই পাড়ি জমান দুবাইয়ে। এখন তিনি দুবাইয়ের বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী।

মামুন হত্যাকাণ্ড নিয়ে অবশ্য ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে আরাভ খানের। তার মতে, খুনটি হয় তার অফিসে, যেটি ছিল সম্পূর্ণ একটি এক্সিডেন্ট। তিনি দাবি করেন, সে সময় তিনি অফিসেও ছিলেন না। ছিলেন বাসায়। তার মতে, তার অপরাধ একটাই– তিনি অফিসের মালিক।

আরাভের সম্পদ কেবল সোনার দোকানেই সীমাবদ্ধ নয়। তার ফেসবুক স্ট্যাটাস অনুযায়ী তিনি দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা টাওয়ারের ৬৫ তলায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। যার নম্বর ৬৫১০। আরও ৪-৫টি ফ্ল্যাটের মালিকও তিনি। পাশাপাশি রয়েছে একটি সুইমিংপুল ও বাগানসহ বড় ডুপ্লেক্স বাড়িও। যেখানে মাঝে মধ্যে মায়াবী হরিণ জবাই দিয়ে বাংলাদেশিদের দাওয়াত খাওয়াচ্ছেন। বাগানে চাষ করছেন বাংলাদেশি সবজি। রয়েছে একাধিক দামি গাড়ি। আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধন উপলক্ষে ৬০ কেজি সোনা দিয়ে বানানো হয়েছে বাজ পাখির আদলে লোগো, যা তৈরিতে সময় লেগেছে প্রায় আড়াই মাস। এটা তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, পুলিশের সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার টাকায় দুবাইয়ে সোনার ব্যবসা শুরু করেন আরাভ খান। একজন খুনের মামলার আসামিকে দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করা, তাকে টাকা দিয়ে ব্যবসার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া, এ সবকিছুই করেছেন পুলিশের সাবেক একজন কর্মকর্তা। পুলিশের এই তথ্য অনেক রহস্য পরিষ্কার করে। এই ঘটনার সঙ্গে বেশ কিছু বিষয় জড়িত।

১) একজন খুনের মামলার আসামি দেশ থেকে বাইরে যায় কী করে? এ ধরনের আসামি সম্পর্কে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে তথ্য থাকার কথা। সেই তথ্য অনুযায়ী দেশ ছাড়ার সময় তাকে আটক করার কথা।

২) যে শত কোটি টাকা খরচ করে আরাভ দুবাইতে কয়েকটি ফ্ল্যাটসহ ভিলা কিনেছেন, সোনার ব্যবসাসহ অন্যান্য ব্যবসা গড়ে তুলেছেন, সেই টাকার উৎস কী?

৩) টাকা কি তিনি দুবাইতে উপার্জন করেছেন নাকি দেশ থেকে নিয়ে গেছেন?

৪) ২০১৮ সালে দেশ ছাড়ার পর তার যে উত্থান দুবাইয়ে তাতে এটি স্পষ্ট যে টাকা তিনি দেশ থেকেই সংগ্রহ করেছেন। তাহলে এখন খুব যৌক্তিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, দেশের টাকা বিদেশে পাচার হলো কী করে? পাচার রোধে যে সংস্থাগুলো কাজ করার কথা তাদের ভূমিকা কী ছিল?

৫) একজন ভাঙারি ব্যবসায়ীর ছেলে কার সহায়তায় শত শত কোটি টাকা পাচার করলো?

৬) খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেহেতু বলছে এসবের সঙ্গে পুলিশের সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত, এই ব্যাপারে তারা কি কোনও পদক্ষেপ নিয়েছে?

৭) গণমাধ্যম সূত্রমতে, তিনি প্রায়ই দেশে আসেন। তার এই দেশে আসা-যাওয়ার তথ্য পুলিশের কাছে থাকে না কী করে?

৮) সর্বশেষ তথ্যমতে, এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই তিনি দেশে এসেছিলেন, ফেসবুকে লাইভ করেছেন, আর পুলিশ তাকে ইন্টারপোল দিয়ে খুঁজছে, পুরো বিষয়টি কি হাস্যকর না?

৯) এখন তাকে ধরে আনার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলের কথা বলা হচ্ছে, এতদিন তাহলে পুলিশ কী করেছে?

১০) অভিযোগ আছে, এই ঘটনায় ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার সহায়তায় বিদেশে গিয়ে নিজের বদলে অন্য এক ব্যক্তিকে আদালতে আত্মসমর্পণ করিয়ে কারাগারে পাঠান আরাভ। দেশের পুলিশ এবং বিচার বিভাগের কোনও অংশের সরাসরি যোগসাজশ ছাড়া এমন কিছু ঘটা কি আদৌ সম্ভব?

১১) এই আলোচনা যখন তুঙ্গে তখন ‘ঠাকুর ঘরে কে, আমি কলা খাইনি’র মতো পুলিশের সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন আরাভ নামে কাউকে তিনি চেনেন না।

শোনা যায়, আরাভকে নিয়ে এতদিন পর পুলিশের হঠাৎ এই নড়েচড়ে বসা তাদের নিজেদের মধ্যকার বিভেদের একটা বহিঃপ্রকাশ। আরাভও বারবারই বলছেন দেশে আসতে কিংবা মামলা ফেস করতে তার কোনও সমস্যা নেই যদি না তাকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়। অর্থাৎ একটি পক্ষ যদি তাকে নিজের জন্য হুমকি মনে করে তাহলে তাকে ক্রসফায়ারে দিয়ে সকল প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা হতেই পারে। যদি পুলিশের দুটি পক্ষের বিবাদের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে আরাভ ইস্যু সামনে আসে তাহলে একটি পক্ষের আপ্রাণ চেষ্টা থাকবে তাকে সরিয়ে দেওয়ার, যাতে কোনও তথ্য প্রকাশিত হতে না পারে। আর অন্য পক্ষ চাইবে তাকে সামনে এনে তথ্য উদ্ঘাটনের।  

অনলাইনে তরুণদের মধ্যে অতি জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক গেইম হলো ‘ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস’। এটির জনপ্রিয়তা বোঝাতে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে এটি এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আয় করা গেইম, যার প্রতিদিনের আয় এক মিলিয়ন ডলার। এই খেলায় ভিন্ন গোত্র থাকে যারা পরস্পরের সঙ্গে তীব্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়; থাকে কয়েক ঘণ্টার প্রস্তুতি দিবস, আক্রমণ দিবস ইত্যাদি।

বর্তমান বাংলাদেশের দিকে তাকালে এই খেলাটির একটি বাস্তব চিত্র পাওয়া যায় বলে আমার ধারণা। সরকারের গত একযুগ সময়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতায় থাকার অবশ্যম্ভাবী ফল ফলেছে- বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারকে আনতে এবং রাখতে গিয়ে বেশ কিছু গোষ্ঠীর (ক্ল্যান) জন্ম হয়েছে। এরমধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটি ক্ল্যান সরকারি দলের নেতাকর্মী-সমর্থক-ক্যাডার বাহিনী আর প্রশাসন। এছাড়াও আর আছে সরকারের ‘ক্রোনি’ ব্যবসায়ী, পেশাজীবীদের ক্ল্যান। আবার এক ক্ল্যানের মধ্যে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে সাব-ক্ল্যান; আছে ভিন্ন ভিন্ন ক্ল্যান থেকে সদস্য নিয়ে তৈরি করা নতুন হাইব্রিড ক্ল্যান। অর্থাৎ পারমুটেসন, কম্বিনেশনের এক বিশাল কাহিনি। অতি অল্প সময়ে আরাভের এই বিস্ময়কর উত্থান প্রশাসনের দুই সাব-ক্ল্যানের মধ্যকার গণ্ডগোলের প্রকাশ বলে দাবি করছে অনেকেই। সময়ই বলবে এই দাবির সত্যতা কতটুকু।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। প্রকাশক ও সম্পাদক, ইত্তেহাদ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
বঙ্গবন্ধু শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন: এমপি কাজী নাবিল
বঙ্গবন্ধু শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন: এমপি কাজী নাবিল
ত্যাগের মহিমায় স্বামী বিবেকানন্দ মানবসেবা করে গেছেন: মেয়র তাপস
ত্যাগের মহিমায় স্বামী বিবেকানন্দ মানবসেবা করে গেছেন: মেয়র তাপস
জাকের পার্টির ‘বিশ্ব ইসলামি সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত
জাকের পার্টির ‘বিশ্ব ইসলামি সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ