X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

ভুলে যাই সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ

আবদুল মান্নান
০৬ এপ্রিল ২০২৩, ১৮:১৯আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২৩, ১৮:১৯

বলা হয় সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ। সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের দায়িত্ব হচ্ছে সমাজে ভালো মন্দ যা-ই ঘটুক তা জনগণের সামনে বস্তুনিষ্ঠ ও নির্মোহভাবে তুলে ধরা। সংবাদপত্রে যা-ই প্রকাশিত হোক সবকিছুই সংবাদ নয়। আমাদের দেশে বা অন্য দেশেও গণমাধ্যমে ফ্যাশন, বাগান পরিচর্যা, পড়ালেখা বিষয়ক নানা পরামর্শ অথবা রাশিফল ইত্যাদি অনেক ফিচার প্রকাশিত হয় যাকে, সঠিক অর্থে সংবাদ বলা যাবে না। কোনও কোনও সংবাদকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যমের নিজস্ব মন্তব্য বিশ্লেষণও থাকতে পারে। সাধারণত একটি দেশে একমাত্র যুদ্ধের সময় ছাড়া গণমাধ্যম সঠিক তথ্যই প্রকাশ করবে, তা-ই আশা করা হয়। কিন্তু দেখা যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা সময় কিছু গণমাধ্যম অর্ধসত্য, অসত্য, বানোয়াট সংবাদ পরিবেশন করে সমাজে নানা রকমের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। ১৯৯০ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের একটি পত্রিকা উসকানিমূলক সংবাদ প্রকাশ করে দেশে একটি ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হানাহানি সৃষ্টি করেছিল।

সাংবাদিকতা একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল পেশা। তাই এই পেশায় যারা কাজ করেন তাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হয় সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে। কোনও দেশে কোনও সংস্থা বা কোনও পেশার মানুষ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সাংবাদিকরাও নয়। আবার অনেক পেশার জন্য রাষ্ট্রের কিছু আইন আছে। চিকিৎসা, আইন, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, বিনোদন পেশার মতো সাংবাদিকতা পেশার জন্যও আইন আছে। সেই আইনে নানা দুর্বলতা থাকতে পারে কিন্তু সেই আইন যতক্ষণ পর্যন্ত বলবত আছে ততক্ষণ তার অধীনেই পেশাজীবীদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। কেউ নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবা উচিত নয়। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলির সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য উল্লেখ করতে চাই। কোনও একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতির রায়ের ব্যাপারে তিনি কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করে মন্তব্য করেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বলে কি যা ইচ্ছা তা করা যায়? জমিদারি নাকি?’ (বিশ্ববাংলা সংবাদ, কলকাতা, ৩০ মার্চ, ২০২৩)। এটি একজন সিনিয়র বিচারপতি সম্পর্কে আর একজন নিম্ন আদালতের বিচারপতির মন্তব্য।

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জমি নিয়ে বিবাদের কারণে অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন এখন কলকাতায় আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য গত মঙ্গলবার গ্রেফতার হয়ে কিছু পরে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ৩৪টি অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। আগামীতে আরও হওয়ার কথা আছে।

সম্প্রতি দেশের অত্যন্ত একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবসে তাদের অনলাইন ভার্সনে ছবিসহ একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। দেশের অনেকের মতে তা ছিল কিছুটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও কিছুটা ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করে লেখা। সংবাদটি লিখেছে সাভারের স্থানীয় প্রতিনিধি শামসুজ্জামান। অবশ্য এই সংবাদটির যারা পক্ষ নিয়েছেন তাদের ভাষ্য ভিন্ন। তারা ছবি আর সংবাদটির গ্রহণযোগ্যতার পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে নানা রকমের যুক্তি তুলে ধরেছেন। ছবিতে দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধের অদূরে দাঁড়িয়ে সাত বছরের এক বালকের জবানিতে বলা হচ্ছে- ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করমু। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’

ছবিটিকে শিরোনামে রেখে দাবি করা হয়েছে এই বক্তব্যটি জনৈক দিনমজুর জাকির হোসেনের। পরে অনুসন্ধান করে দেখা যায় ওই সাত বছরের বাচ্চাটির নাম সবুজ মিয়া, আর সে সাভারের বাসিন্দা। জাকির হোসেন নামের কেউ আদৌ ওই এলাকায় আছে কিনা তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সবুজ মিয়ার বয়স সাত বছর, পড়ে স্থানীয় স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে। মা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ এলাকায় ফুল বিক্রি করে। স্কুলের পর সবুজ মিয়াও মাকে সঙ্গ দেয়। তার ছবি তোলার আগে শামসুজ্জামান তাকে দশ টাকা দেয়। এটি ছিল একটি গর্হিত অপরাধ। কারণ, শামসুজ্জামান তার বা তার পত্রিকার স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য একটি সাত বছরের নাবালককে অপব্যবহার করেছে, যা আইনের পরিপন্থি।

উল্লেখিত সংবাদটি শামসুজ্জামান তার পত্রিকায় পাঠালে তারা তা তাদের অনলাইন ভার্সনে প্রকাশ করেন। সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার ১৭ মিনিটের মাথায় পত্রিকাটি দাবি করেছে তারা ছবিটি ভুল ছিল বলে তা তুলে নিয়েছে ও দুঃখ প্রকাশ করেছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যুগে মুহূর্তেই তা হাজার-লক্ষ জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদপত্র আছে যারা অনলাইনে কিছু অসত্য বা অর্ধসত্য সংবাদ প্রকাশ করে, যা তাদের প্রিন্ট ভার্সনে থাকে না। ২৬ তারিখ দিবাগত  রাত সাড়ে তিনটায় পুলিশের সিআইডি কর্মকর্তারা শামসুজ্জামানকে তার বাড়ি থেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পরিবারের ও কয়েকজন পড়শির সামনে তাদের কার্যালয়ে নিয়ে যায়। এরপর তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অধীনে মামলা হয় এবং সে মামলার সূত্র ধরে পুলিশ তাকে আটক করে পরদিন আদালতে পাঠায়, আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। শামসুজ্জামানকে গত রবিবার আদালত জামিন দিয়েছে। এই সংবাদের সূত্র ধরে পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধেও একই আইনে একটি মামলা হয় আর সেই মামলা থেকে তিনি এরই মধ্যে আগাম জামিন পেয়েছেন।

শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলা বা তার আটক হওয়াটা পরিবেশিত সংবাদের কারণে ছিল নাকি উদ্দেশ্যমূলকভাবে মহান স্বাধীনতা দিবসে একটি বানোয়াট ছবি ও বক্তব্য কেন্দ্রিক ছিল তা নিয়ে দিন দশেকের বেশি সময় ধরে তর্ক-বিতর্ক চলছে। এই বিষয়ে তর্কের আরও নানা ডালপালা গজিয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন এই ঘটনার কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির প্রচণ্ড ক্ষতি হয়েছে। একজন বিজ্ঞজন প্রশ্ন তুলেছেন ‘তাহলে কি সাংবাদিকরা অনুসন্ধানী সংবাদ পরিবেশন করবে না?’ এখানে অনুসন্ধানী সংবাদ কী ছিল তা বুঝা গেলো না।

সংবাদটি তো অসত্য বলে কেউ দাবি করেনি। আর দেশে বিশ্বের অন্য সব দেশের মতো সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য যে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে তা সরকারও অস্বীকার করছে না। আর দেশের সব গণমাধ্যম প্রতিদিন এই বিষয়ে নানা ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। সরকার চেষ্টা করছে পরিস্থিতি যতটুকু স্বাভাবিক করা যায় তা করতে। তবে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে হয়তো পেরে উঠছে না। এই ছবি বা তাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি বঙ্গবন্ধুর আমলে উত্তর বঙ্গে জাল পরা বাসন্তীর কথা মনে করিয়ে দেয়। এই প্রজন্মের অনেকেই বাসন্তীকে চিনবে না। সালটা ১৯৭৪।

স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় দেশে দেখা দিলো ভয়াবহ বন্যা। উত্তরবঙ্গে পর পর দুবার ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হলো। বঙ্গবন্ধু তখন একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। অর্থনীতি তখনও বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর। বিদেশ থেকে কোনও পণ্য সরাসরি আমদানি করার মতো সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর তখনও সম্পূর্ণ চালু করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যারা পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। কেউ সর্বহারা নামে কেউ বা জাসদের নামে। আজ এই খাদ্য গুদামে আগুন লাগছে তো কাল অমুক স্থানে থানা লুট হচ্ছে। একদিন আশুগঞ্জ সার কারখানা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে উড়ে গেলো। মাওলানা ভাসানীর দলেও ভিড়ে গিয়েছিল অনেক স্বাধীনতাবিরোধী। দেশে দেখা দিলো চরম খাদ্যাভাব। পরিস্থিতির সুযোগ নিতে আবির্ভাব ঘটলো একশ্রেণির মুনাফাখোর টাউট বাটপার আর কালোবাজারির। তাদের অনেকের গায়ে আবার আওয়ামী লীগের লেবাস। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত হয়ে এসেছে। টাকা থাকলেও বাজারে পণ্য মিলছে না। ৪০ টাকা মণের চাল অনেক স্থানে মানুষকে ৮০ টাকায় কিনতে হলো। বড় বড় শহরের দেয়ালে লেখা হলো ‘আশি টাকা চালের দাম হরে কৃষ্ণ হরে রাম’। এটি ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও তাতে ভারতের ভূমিকাকে কটাক্ষ করা। খাদ্য সাহায্য নিয়ে কয়েকটি দেশ এগিয়ে এলো যার, মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া), অস্ট্রেলিয়া অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রও তাদের পিএল ৪৮০ অধীনে (সাহায্যের বিনিময়ে শান্তি কর্মসূচি) বাংলাদেশকে খাদ্য সহায়তা দিতে রাজি হলো। গম নিয়ে দুটি জাহাজ রওনা দিলো চট্টগ্রামের উদ্দেশে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে শ’খানেক নটিকেল মাইল দূরে থাকতে জাহাজে খবর এলো বাংলাদেশকে কোনও খাদ্য সাহায্য দেওয়া যাবে না। কারণ, তারা যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকাভুক্ত শত্রু দেশ কিউবার কাছে কিছু চটের বস্তা বিক্রি করেছে।

এই কর্মসূচির অধীনে বাংলাদেশের এমন কর্ম ছিল সম্পূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে বেআইনি। যা জানা ছিল না সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের। খাদ্য নিয়ে ফিরে গেলো সেই দুই জাহাজ। বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান ড. নূরুল ইসলাম তাঁর গ্রন্থ ‘Making of a Nation-Bangladesh’ গ্রন্থে তা  বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। পরিস্থিতি দ্রুত অবনতিশীল। এসবকে পুঁজি করে জাসদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হলো দৈনিক গণকণ্ঠ। তাদের একমাত্র কাজই ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে নিত্যদিন সত্য-মিথ্যার মিশেল দিয়ে নানা ধরনের গুজবের জন্ম দেওয়া। এরই মধ্যে মঞ্চস্থ হলো সেই বাসন্তী নাটক। উত্তরবঙ্গের রংপুর জেলার কুড়িগ্রামের চিলমারীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের জেলে পাড়ার এক হতদরিদ্র জেলে পরিবারে মানসিক প্রতিবন্ধী বাসন্তীকে আবিষ্কার করলেন দৈনিক ইত্তেফাকের ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমেদ।

তার পরিবারের হাতে সামান্য কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বাসন্তীর ছেঁড়া শাড়িটি খুলে তাঁকে একটি মাছ ধরার জাল পরিয়ে ভাসমান কলাগাছের ওপর দাঁড় করিয়ে তোলা হলো ছবি। তখন শাড়ির মূল্য ছিল দশ থেকে পনের টাকা আর দেড়শ’ টাকার কমে কোনও জাল পাওয়া যেত না। সেই জাল পরা ছবি ছাপা হলো দৈনিক ইত্তেফাকের মতো পত্রিকায়। আর জাল পরা বাসন্তীকে আন্তর্জাতিক মিডিয়া ব্যবহার করলো এটি প্রকাশ করতে যে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে টিকে থাকতে পারবে না, যা তাদের অনেকেই আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। এই প্রেক্ষাপটেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো ।

শামসুজ্জামানের সেই প্রতিবেদন আর ছবি লন্ডন থেকে প্রকাশিত দ্য গার্ডিয়ানের মতো পত্রিকা আর আল-জাজিরার মতো টিভি প্রচার করলো শামসুজ্জামানকে নাকি গ্রেফতার করা হয়েছে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সংবাদ প্রকাশ করার জন্য। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন একেবারে চটজলদি ঘটনার সমালোচনা করে একটি কড়া বিবৃতি দিয়ে দাবি জানালো যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শামসুজ্জামানকে আটক করা হয়েছে তা বাতিল করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে নিত্যদিন বন্দুকধারীরা স্কুলে ঢুকে নির্বিচারে গুলি করে বাচ্চাদের হত্যা করে। সাধারণ মানুষের সেনাবাহিনীতে ব্যবহার করা হয় এমন অস্ত্র রাখা ও তা বহন করা সেই দেশে আইনগতভাবে সিদ্ধ।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা অথবা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চুপ। আর বিশ্বে এই মুহূর্তে মিয়ানমারের গণমাধ্যম সর্বাধিক বিপদের মধ্যে আছে। মিয়ানমারের কথা এলে পশ্চিমা বিশ্ব আর আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ কেমন জানি নপুংশকের ভূমিকায় চলে যায়।

এই পবিত্র রমজান মাসে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী মুসলমানদের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় স্থাপনা জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদে ঢুকে মুসল্লিদের ওপর নির্বিচারে হামলা করেছে। পশ্চিমা বিশ্বের কেউ কোনও প্রতিবাদ করেনি।

সম্প্রতি ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর বাঙ্গালোরে এক সভায় বলেছেন, পশ্চিমা বিশ্ব এটি ধরে নিয়েছে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলা তাদের ঈশ্বর প্রদত্ত অধিকার।

বাসন্তী নাটক নিয়ে বাংলাদেশবিরোধী শিবিরে তখন যেমন তোলপাড় হয়েছিল, ঠিক তেমনটি হচ্ছে শামসুজ্জামানের আটক নিয়ে। এই বিষয়টি নিয়ে বিএনপি মাঠ গরম করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এমনকি সামসুজ্জামানের সেই ক্যাপশন ব্যবহার করে বিএনপি তাদের অনেক সভা সমাবেশের ব্যানার করেছে। বাসন্তী নাটকের আফতাব আহমেদকে খালেদা জিয়া একুশে পদকে ভূষিত করেছিলেন।  বিএনপির নেতারা টিভিতে এসে গলা ফাটিয়ে বলার চেষ্টা করেছে এই সরকারের আমলে সাংবাদিকরা সত্য কথা বলতে গেলে তাদের ওপর নেমে আসে চরম নির্যাতন। অনেকটা ‘ভূতের মুখে রাম নাম’। বিএনপি হয়তো ভুলে গেছে তাদের শাসনামলে ১৬ জন সাংবাদিককে প্রাণ দিতে হয়েছে। জিয়াউর রহমানের আমলে জহুর হোসেনের মতো প্রাতঃস্মরণীয় সাংবাদিককে কোমরে দড়ি দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছিল। বেগম জিয়ার আমলে ১৯৯১ সালে দৈনিক আজকের কাগজের (অধুনালুপ্ত) প্রকাশক কাজী শাহেদ আহমেদ, সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান আর রিপোর্টার সৈয়দ বোরহান কবিরকে রাতে অফিস থেকে আটক করে সারা রাত থানায় বসিয়ে রাখা হয়েছিল। কাজী শাহেদ আহমেদকে প্রায় ৮৭টি মামলার আসামি হতে হয়েছিল। প্রায় ছয় শত দিন আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছিল। তাদের অপরাধ ছিল তারা অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের মন্ত্রী হওয়ার আগে দুর্নীতি বিষয়ক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন।

২০০২ সালে ডিসেম্বর মাসে বোমা ফাটলো ময়মনসিংহের সিনেমা হলে। ঢাকায় গ্রেফতার হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুনতাসীর মামুন,  সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, সাংবাদিক  এনামনুল হক চৌধুরী (বর্তমানে ডেইলি সানের সম্পাদক), রাজনীতিবিদ মতিউর রহমান (পরে শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় ধর্ম প্রতিমন্ত্রী), আওয়ামী লীগের সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী। এরপর সাংবাদিক বরুন ভৌমিক নয়নকেও আটক করা হলো। জামিন পাওয়ার পর এনামনুল হক চৌধুরী ও বরুন ভৌমিক দুজন অনেক দিন সোজা হয়ে হাঁটতে পারেননি, আটক অবস্থায় নির্যাতন ছিল এতই ভয়াবহ। তাদের অপরাধ ছিল তারা ময়মনসিংহের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাকে জঙ্গিবাদীদের কাজ বলে বিদেশি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন।

আর এক প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক দৈনিক জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান, নির্বাহী সম্পাদক বোরহান আহমেদকে অফিস থেকে আটক করেই পুলিশ ক্ষান্ত হয়নি, পত্রিকার অফিসের বিদ্যুতের লাইন কেটে দিয়েছিল। অনেকে মনে করেন শামসুজ্জামানের সংবাদটিকে অপরাধ হিসেবে না দেখে ভুল হিসেবে দেখা উচিত। অপরাধ আর ভুল দুটি ভিন্ন জিনিস। যা কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সজ্ঞানে ক্ষতি করার জন্য করা হয় সেটা অপরাধ। আর ভুল করা হয় অজান্তে। রান্নার সময় তরকারিতে একটু লবণ বেশি দিলে তা হয় ভুল, আর যখন একটি দেশের স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করার জন্য কোনও কিছু করা হয় তা হয় অপরাধ, কখনও কখনও রাষ্ট্রবিরোধী। আর শামসুজ্জামান একজন শিশুকে অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া তার নাজায়েজ কর্মের জন্য ব্যবহার করেছেন, যা একটি শিশু নির্যাতনের শামিল। এটি অপরাধ।

প্রকাশিত ভুয়া সংবাদটি প্রকাশের জন্য একজন শামসুজ্জামানকে একা অপরাধী করা ঠিক হবে না। কারণ, ঘটনাস্থল থেকে যে সংবাদ একজন সাংবাদিক পাঠান তা দফতরে এসে একাধিক পেশাদার সম্পাদকের হাত ঘুরে তা প্রকাশিত হয় এবং তা নির্ভর করে সম্পাদকীয় নীতির ওপর। এই সংবাদটি যখন প্রকাশের জন্য যায় তখন তা কোন কোন দায়িত্ব পালনরত ব্যক্তির হাত ঘুরে গেছে তাও পরিষ্কার করা উচিত।

শামসুজ্জামান এখনও বলতে গেলে তরুণ। তিনি জামিনে মুক্তি পেয়ে বলেছেন, ভবিষ্যতেও সাংবাদিকতা পেশায় থাকবেন, তবে তা নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে নয়। এজন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে শুরু হতেই অনেক আলোচনা সমালোচনা। এমন আইন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর সব দেশেই আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের অনেক সাংবাদিক এমন আইনে কারাগারে আটক আছেন।

আইনে কোনও দুর্বলতা থাকলে তা দ্রুত পরিবর্তন বা পরিমার্জনের কথা খোদ আইনমন্ত্রীই বলেছেন। আর এই আইনের যেন কোনও অপব্যবহার না হয় সে দিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। যে পত্রিকাটি নিয়ে এত কথা তার ভূমিকা আগামীতে কী হবে তা পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন আছে। কারণ, তাদের অতীত ইতিহাস তেমন একটা ভালো নয়। অনেকে প্রশ্ন তুলেন এটি কি স্বাধীনতাবিরোধী পত্রিকা? উত্তরে বলি, তা নয়, এটি শুধু শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ-বিরোধী। তাদের অতীত কার্যকলাপে তা প্রমাণিত। আগামীতে তাদের অবস্থান পরিবর্তন হবে তা মনে করার কোনও কারণ নেই।

লেখক: গবেষক ও বিশ্লেষক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকাডুবিতে নিহত ৮ বাংলাদেশির মরদেহ আসছে আজ
তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকাডুবিতে নিহত ৮ বাংলাদেশির মরদেহ আসছে আজ
থাইল্যান্ড সফর নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করছেন প্রধানমন্ত্রী
থাইল্যান্ড সফর নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করছেন প্রধানমন্ত্রী
অবশেষে চট্টগ্রামে স্বস্তির বৃষ্টি
অবশেষে চট্টগ্রামে স্বস্তির বৃষ্টি
আদালতে ড. ইউনূস
আদালতে ড. ইউনূস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ