X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভোটকেন্দ্র পাহারায় ‘ফেরেশতা’ লাগবে কেন?

আমীন আল রশীদ
১৯ অক্টোবর ২০২৩, ১৬:৩৭আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২৩, ১৬:৩৭

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, লাখ লাখ ভোট কক্ষ পাহারা ‘ফেরেশতা’র পক্ষে সম্ভব। এটা নির্বাচন কমিশন পারবে না। ১২ অক্টোবর ‘তৃণমূল বিএনপি’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে সিইসি বলেন, ভোট কক্ষে প্রার্থীকে অবশ্যই পোলিং এজেন্ট দিতে হবে। প্রার্থীর ঘর (ভোট কক্ষ) পাহারা দিতে তিনি পারবেন না। একজন মানুষের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। কেবল ‘ফেরেশতা’র পক্ষে সেটা সম্ভব। (সমকাল, ১৩ অক্টোবর ২০২৩)।

প্রশ্ন হলো, ভোটকেন্দ্র পাহারা দিতে ‘ফেরেশতা’ লাগবে কেন? পৃথিবীর অন্যান্য দেশে—বিশেষ করে যেসব দেশের নির্বাচন নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই, সেসব দেশের ভোটকেন্দ্র কি ফেরেশতারা পাহারা দেয়?

সিইসি সম্ভবত জনবলের প্রসঙ্গে ‘ফেরেশতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ লাখ লাখ ভোটকেন্দ্রের প্রতিটিতে পাহারা দিতে হলে কমিশনের কয়েক লাখ কর্মী (পাহারাদার) লাগবে। সেটা অসম্ভব। কিন্তু ভোটকেন্দ্র পাহারা দেওয়ার প্রশ্নটিই বা কেন এলো? একটি সর্বজনগ্রাহ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে প্রতিটি কেন্দ্র পাহারা দেওয়ার প্রসঙ্গ আসতো না।

এর আগে বিভিন্ন নির্বাচনের প্রতিটি বুথে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে পুরো ভোট নজরদারির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সেটি একটি বা দুটি কিংবা বড়জোর দশটি নির্বাচনে হয়তো সম্ভব। কিন্তু একদিনে যখন তিনশ’ আসনে ভোট হলে সব কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা দিয়ে সেগুলো মনিটর করার মতো প্রযুক্তি সহায়তা যেমন কঠিন, তেমনি নির্বাচন কমিশনের এত জনবলও নেই। তার মানে প্রতিটি বুথে সিসি ক্যামেরাও চূড়ান্ত সমাধান নয়। চূড়ান্ত সমাধান হচ্ছে একটি ভালো নির্বাচনি পদ্ধতি—যে পদ্ধতির ব্যাপারে সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্য থাকবে। যে ব্যবস্থা নিয়ে ভোটাররা সন্তুষ্ট এবং কোনও বিতর্ক থাকবে না। যে ব্যবস্থার ওপর বিদেশি বন্ধু এবং উন্নয়ন সহযোগীরাও ‘কনভিন্সড’ হবেন। কিন্তু গত অর্ধ শতাব্দীতে বাংলাদেশে কি এরকম একটি নির্বাচনি ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, সর্বজনগ্রাহ্য একটি নির্বাচনি ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনও লক্ষণ কি দেখা যায়?

যখনই নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসে, তখনই সেখানে কয়েকটি খুব সাধারণ শব্দ উচ্চারিত হয়। যেমন: অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক, বিতর্কমুক্ত, গ্রহণযোগ্য ইত্যাদি। বাস্তবতা হলো, নির্বাচন সুষ্ঠু মানেই অংশগ্রহণমূলক নয়। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক মানেই অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নয়। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ মানেই গ্রহণযোগ্য নয়, বিশ্বাসযোগ্য ও ভালো নির্বাচন নয়। গ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য ও ভালো নির্বাচনের মানদণ্ড অনেক। সেই মানদণ্ডে বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচনকেও পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য বলা যাবে কিনা, সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

বর্তমান প্রজন্ম ওই ধরনের নির্বাচন হয়তো দেখে যেতে পারবে না। কেননা, এটার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন। একটা রাষ্ট্র গঠন আর জাতির মানসকাঠামো গঠন এক কথা নয়। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে ঠিকই; একটি মানচিত্র পাওয়া গেছে বটে—কিন্তু সেই মানচিত্র ও স্বাধীন ভূখণ্ডের মানুষেরা তাদের রাষ্ট্রটিকে কীভাবে গড়ে তুলবেন; তাদের শাসনভার যাদের ওপর, তারা দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে কতটা আন্তরিক, কতটা দলনিরপেক্ষ এবং কতটা জনবান্ধব—সেই প্রশ্নের উত্তর সবার জানা। অতএব, বিচ্ছিন্নভাবে নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলা অর্থহীন—যদি না পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাটিকেই ঠিক করা যায়।

তারপরও যেহেতু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন এবং বড় কোনও ঘটনা না ঘটলে যেহেতু আগামী জানুয়ারিতেই নির্বাচন হওয়ার কথা; যেহেতু এই নির্বাচন নিয়ে অনেক দিন ধরেই নির্বাচন কমিশন তৎপর এবং বর্তমান কমিশনের সদস্যরা বারবারই জোর দিয়ে বলছেন তারা একটি অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার ব্যাপারে আন্তরিক—সে কারণে সিইসির সাম্প্রতিক ওই বক্তব্যটি নিয়ে নতুন করে আলোচনা হচ্ছে। সেটি হলো, একটি ভালো ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনি ব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে; নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তথা সবার জন্য সমান সুযোগ থাকলে এবং মাঠ প্রশাসন নির্ভয়ে, কোনও ধরনের প্রভাব ও চাপমুক্ত থেকে দায়িত্ব পালন করতে পারলে এবং দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ওই নির্বাচনে অংশ নিলে; ভোটকেন্দ্রে সকল প্রার্থীর এজেন্ট থাকলে ভোটকেন্দ্রে ‘ফেরেশতা’র প্রয়োজন নেই। প্রার্থী ও প্রার্থীর কর্মী সমর্থকরাই ভোটকেন্দ্র পাহারা দেবেন। নির্বাচন কমিশন, মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং যদি সশস্ত্র বাহিনীও ভোটের মাঠে থাকে, তাদের প্রত্যেকে যদি নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকে, তাহলে ভোটকেন্দ্র পাহারা দেওয়ার জন্য বিদেশ থেকে কিংবা অন্য গ্রহ থেকে কাউকে ভাড়া করে আনার প্রয়োজন নেই।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচনের সকল পক্ষ কি নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত থেকে নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছ, পারছে বা পারবে? এই প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং সিইসির বক্তব্যের মধ্যেই রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনের সময় দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকবে। তাই সরকার নিরপেক্ষ থাকবে কিনা– এ নিয়ে অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনই বাংলাদেশে মূল সরকার।’

সুতরাং আমরা যখন অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক, বিতর্কমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলি, তখন এটিও মনে রাখতে হবে যে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনটিও শেষ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে—যদি প্রধান দলগুলো ভোটে অংশ না নেয়। আবার সব দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ ভোটও শেষ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে, যদি রিটার্নিং কর্মকর্তা কারসাজি করে ভোটের ফল পাল্টে দেন। যে পদ্ধতিতে ভোট হবে, সেই পদ্ধতির ব্যাপারে অন্তত প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না থাকলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং ভোটকেন্দ্রের পাহারায় ‘ফেরেশতা’ লাগবে কি লাগবে না—তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, নির্বাচনটি যে পদ্ধতিতে হচ্ছে, সেটির ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐকমত্য আছে কিনা?

সিইসি বলেছেন, ‘নির্বাচন একটা খেলা। ভালো খেলতে না পারলে জেতার আশা করা কঠিন।’এই কথাটি যৌক্তিক। কিন্তু খেলার মাঠ প্রস্তুত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। তারা যদি মাঠটি কারও জন্য সমান এবং কারও জন্য উঁচু নিচু করে রাখেন; যদি মাঠ প্রশাসন ইসির কথা না শোনে এবং সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকা দল যদি যেকোনও উপায়ে নির্বাচনে জিততে চায় এবং তাদের জিতিয়ে আনার জন্য মাঠ প্রশাসন যদি পক্ষপাতমূলক আচরণ করে, তাহলে ‘ফেরেশতা’ দিয়েও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। কেননা, একটি নির্বাচন শুধু নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না। পুরো সিস্টেম যদি ভালো নির্বাচনের সহায়ক না হয়, তাহলে একজন সিইসি এবং চার জন কমিশনারের পক্ষে কিছুই করার নেই।

নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নেই। ভোট পরিচালনায় যে বিপুলসংখ্যক জনবল দরকার, সে পরিমাণ লোক তার নেই। ফলে তাকে পুরো নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্ভর করতে হয় নির্বাহী বিভাগ তথা সরকারের ওপর।

অতএব, মাঠ প্রশাসন যদি ইসিকে সহায়তা না করে; তারা যদি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর মতো আচরণ করে; মাঠ প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ না থাকে বা থাকতে না পারে—তাহলে খুব ভালো নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয়।

মুশকিল হলো, অনেক সময় সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোটকে গুলিয়ে ফেলা হয়। পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটি শান্তিপূর্ণ হওয়ার পরও সেই ভোট গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। যেমন, একটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের ফল ঘোষণা পর্যন্ত হানাহানি হলো না; কোনও প্রার্থীর প্রচারে বাধা দেওয়া হলো না, কাউকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে চাপ দেওয়া হলো না, কিন্তু দেখা গেলো মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি বা ভোটার উপস্থিতি খুবই কম। যেহেতু আমাদের সংবিধানে এটি বলা নেই যে ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট পেতে হবে, বরং ১০ শতাংশ ভোট পেয়েও যেহেতু জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়া যায়, সুতরাং কোনও একটি ভোটে যদি ২০ শতাংশ মানুষও ভোট দেয়, তারপরও ওই ভোটকে অবৈধ বলার সুযোগ নেই। ওই সামান্য সংখ্যক ভোট পেয়ে যিনি নির্বাচিত হয়েছেন, তাকেও অবৈধ বলা যাবে না। কিন্তু এই নির্বাচনটি কি গ্রহণযোগ্য হলো?

আবার পুরো নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণ হলো, প্রচুর মানুষ ভোট দিলো, কিন্তু ফল পাল্টে দেওয়া হলো, সেটিকে সুষ্ঠু নির্বাচন বলা গেলেও গ্রহণযোগ্য বলার সুযোগ নেই। অর্থাৎ সহিংসতামুক্ত নির্বাচন মানেই সেটি গ্রহণযোগ্য ভোট নয়। বরং একটি ভোটকে গ্রহণযোগ্য হতে গেলে তার কিছু মানদণ্ড রয়েছে এবং সেগুলো নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আবার নির্বাচন কমিশন সেই দায়িত্ব পালনে কতটা সফল হবে, সেটি নির্ভর করছে সরকারের ইনটেনশনের ওপর। অর্থাৎ সব পক্ষ যদি অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার ব্যাপারে একমত না হয়, তাহলে একা নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও ভালো নির্বাচন করা সম্ভব হবে না।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড
মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে জাতিসংঘে সমালোচনার মুখে তালেবান
মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে জাতিসংঘে সমালোচনার মুখে তালেবান
লক্ষ্মীপুরের পাঁচ ইউপির তিনটিতে নতুন মুখ, দুটিতে পুরোনোতে আস্থা
লক্ষ্মীপুরের পাঁচ ইউপির তিনটিতে নতুন মুখ, দুটিতে পুরোনোতে আস্থা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ