X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

পোশাক খাতের অস্থিরতা ও যুক্তরাষ্ট্রের নতুন স্মারক

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২২ নভেম্বর ২০২৩, ১৮:১৩আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০২৩, ১৮:১৩

গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মোটামুটি শান্তই ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত– তৈরি পোশাক শিল্প। অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের উদ্যোগে রেট্রোফিটিং ও রেমিডিয়েশন কাজ ভালোভাবে হওয়ায় অগ্নিকাণ্ড বা অন্য কোনও বড় দুর্ঘটনাও ঘটেনি।

করোনার সময় শ্রমিকদের কাজ করানো না করানো নিয়ে কিছু বিতর্ক সৃষ্টি হলেও শেষ পর্যন্ত সরকার এবং বিজিএমইএ’র মাধ্যমে পরিস্থিতি অনুকূলে রাখা গেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে ইউরোপের বাজারে চাহিদার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও এই খাতকে বড় সমস্যায় ফেলেনি।

কিন্তু সাম্প্রতিককালে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই হঠাৎ উত্তাল হয়ে ওঠে এই শিল্প খাত। দেখা দেয় বড় শ্রমিক অসন্তোষ। হাজার হাজার পোশাক শ্রমিক তাদের ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। সরকারের নিয়োগ করা মজুরি বোর্ড গত ৭ নভেম্বর পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন ৬৫ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা করার ঘোষণা দেয়। ডিসেম্বর মাস থেকে নতুন এই বেতন কার্যকর হবে এবং শ্রমিকরা জানুয়ারি মাস থেকে নতুন ঘোষণা করা এই মজুরি পাবেন।

আগে থেকেই আন্দোলনে থাকা শ্রমিকরা এই মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। আন্দোলনকারী শ্রমিকদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার পুলিশের সংঘর্ষ ঘটে, শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে, কিছু পোশাক কারখানাতে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। আগামী ২৬ নভেম্বর এই মজুরির রোয়েদাদ থাকবে না নতুন কাঠামো নির্ধারিত হবে সেটা চূড়ান্তভাবে জানা যাবে। তবে এই শ্রমিক আন্দোলন, আন্দোলন দমাতে পুলিশি ব্যবস্থা, শ্রমিকের মৃত্যু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই খাতকে বড় ভাবমূর্তির সংকটে ফেলেছে। বিজিএমইএ সবসময় বলছে এটা ন্যূনতম মজুরি যারা শিক্ষানবিশ হিসেবে কারখানায় কাজ নিচ্ছে তাদের জন্য। বাস্তবে অভিজ্ঞ শ্রমিকের মজুরি অনেক বেশি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে মাসে ৫০,০০০ টাকারও বেশি।

অবস্থা এতটা নাজুক হয়েছে যে শত শত কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন মালিকরা, যেগুলো এখন আবার খুলেছে। বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১৩-এর ১ ধারায় বলা হয়েছে, “কোনও প্রতিষ্ঠানের কোনও শাখা বা বিভাগে বে-আইনি ধর্মঘটের কারণে মালিকরা উক্ত শাখা বা প্রতিষ্ঠান আংশিক সম্পূর্ণ বন্ধ করিয়া দিতে পারিবেন এবং এরূপ বন্ধের ক্ষেত্রে ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকগণ কোন মজুরি পাইবেন না”।

পোশাক খাতের মালিকরা বিজিএমইএ’র সাথে পরামর্শ করে এই ধারার সদ্ব্যবহার করেছেন। এবং এর পাল্টা সুযোগ নিয়েছে এই খাত সংশ্লিষ্ট কিছু শ্রমিক নেতানেত্রী, যারা কথায় কথায় যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান, বা নীতিনির্ধারকদের সাথে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করতে পারেন। তারা শ্রমিকদের সাথে মালিকদের একটা দূরত্ব সৃষ্টিতে সবসময় সক্রিয় থাকেন এবং এবার সেই সুযোগটা অনেক দিন পর তাদের সামনে উপস্থিত হওয়ায় তা কাজে লাগিয়েছেন এই রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়।

এর মধ্যেই জানা গেলো, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার ও শ্রমিকদের মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি স্মারকে (প্রেসিডেনসিয়াল মেমোরেন্ডাম) সই করেছেন। গত বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, বিভিন্ন দেশের সরকার, শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, সুশীল সমাজ ও বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেন, যারা শ্রমিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে যাবেন, শ্রমিকদের হুমকি দেবেন, ভয় দেখাবেন, তাঁদের ওপর প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। শ্রম অধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই নীতির বিষয়ে জানাতে গিয়ে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের পোশাক খাতের শ্রমিক আন্দোলনের নেতা কল্পনা আক্তারের নামটিও উল্লেখ করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের এই স্মারকে শ্রমিকদের অধিকার হরণ করলে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ নানা নিষেধাজ্ঞার কথা থাকায় তাকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করা দরকার হয়ে পড়েছে সরকার এবং এ খাতের মালিকদের জন্য। তবে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল মনে করছে, যে ধরনের পরিস্থিতিতে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আসে, বাংলাদেশে সে ধরনের পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি।

ব্লিংকেন কল্পনা আক্তারের নাম নিয়েছেন। তিনি এখনও জীবিত আছেন, কারণ আমেরিকার দূতাবাস তাঁর পক্ষে কাজ করেছে। এটি একটি ভয়ংকর অভিযোগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেন রাষ্ট্র তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সরকারের দিক থেকে এর একটি জবাব আসা প্রয়োজন, কারণ অভিযোগটি গুরুতর। আমরা জানি না কল্পনা আক্তার শ্রমিক অধিকারের কথা বলতে কখনও শ্রম মন্ত্রণালয় বা এর আওতাধীন কোনও প্রতিষ্ঠানে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কোনও অভিযোগ করেছেন কিনা বা তাদের সাহায্য চেয়েছেন কিনা।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেহেতু বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকারকর্মীর নাম উল্লেখ করেছেন সেহেতু এটিকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। কীসের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নামটি সামনে নিয়ে এলো, তা খতিয়ে দেখতে পুরো স্মারক বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্র যে নীতি গ্রহণ করে, তার পশ্চিমা মিত্ররা অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং জাপান ও অস্ট্রেলিয়াও একই নীতি অনুসরণ করে। তাই দেশের সার্বিক অর্থনীতির স্বার্থে এই স্মারকটিকে আমলে নিতে হবে। বিজিএমইএকেও ভাবতে হবে তার করণীয় কী? সরকার ও বিজিএমইএ উভয়ের জন্যই এখন প্রয়োজন ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা।  

এ দেশের তৈরি পোশাক রফতানির বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে পোশাক রফতানিতে তৃতীয় শীর্ষ দেশ বাংলাদেশ। পোশাক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত মৎস্য, চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্যসহ নানা ধরনের পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ। তাই এই স্মারককে গুরুত্ব দিয়ে শ্রমিকদের মজুরি, তাদের কর্ম-পরিবেশ নিয়ে আরও বড় পরিসরে চিন্তাভাবনা করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর: শেখ হাসিনা
সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর: শেখ হাসিনা
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি নিশ্চিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে: রাষ্ট্রপতি
কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি নিশ্চিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে: রাষ্ট্রপতি
দিনাজপুরে একসঙ্গে ২০ হাজার কণ্ঠে গীতা পাঠ
দিনাজপুরে একসঙ্গে ২০ হাজার কণ্ঠে গীতা পাঠ
উপজেলা নির্বাচন আগের যে কোনও নির্বাচনের চেয়ে ভালো হবে: ইসি হাবিব
উপজেলা নির্বাচন আগের যে কোনও নির্বাচনের চেয়ে ভালো হবে: ইসি হাবিব
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ