X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

এত প্রার্থী সরে দাঁড়ালেন কেন?

আমীন আল রশীদ
০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:৩২আপডেট : ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:৩২

১. শামীম ওসমানের আসনে সরে দাঁড়ালেন জাপার প্রার্থী, কারণ ব্যক্তিগত: প্রথম আলো, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩।

২. নৌকার বিজয় নিশ্চিতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী: সমকাল, ০৪ জানুয়ারি ২০২৪।

৩. নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা শাজহাজান ওমরের প্রতিদ্বন্দ্বী মনিরুজ্জামানের: ডেইলি স্টার বাংলা, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩।

৪. হবিগঞ্জ-১ আসনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন স্বতন্ত্র প্রার্থী: যমুনা টেলিভিশন, ০১ জানুয়ারি ২০২৪।

৫. যশোর-২, নৌকায় সমর্থন দিয়ে সরে দাঁড়ালেন স্বতন্ত্র প্রার্থী: বিডিনিউজ, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩।

৬. নির্বাচন থেকে একে একে সরছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা: প্রথম আলো, ০৪ জানুয়ারি ২০২৪।

মধ্য ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত এরকম অনেক প্রার্থী নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন—যারা মূলত জাতীয় পার্টি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী। অর্থাৎ দলীয় সিগন্যাল পেয়েই যারা নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে ছিলেন। কিন্তু তাদের অনেকেই এখন আর ভোটের মাঠে নেই। এমনকি যেসব স্বতন্ত্র প্রার্থী নৌকার শক্তিশালী প্রার্থীর বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারেন বলে মনে হচ্ছিলো, এমন একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থীও ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে এবং কেউ কেউ দলীয় প্রার্থীর পরাজয় ঠেকাতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। 

শুধু আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই নন, অন্য দলের অনেক প্রার্থীও নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে ভোট থেকে সরে গেছেন। যেমন বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে তরিকত ফেডারেশনের প্রার্থী সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, তিনি এ আসন থেকে চার মেয়াদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং এর মধ্যে তিনটি মেয়াদে নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছেন। তাই তিনি মনে করেন, তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে ভোটব্যাংক বিভক্ত হবে যা নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিজয়ে প্রভাব ফেলতে পারে। সে কারণে তিনি ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। প্রশ্ন হলো, নৌকা প্রতীককে বিজয়ী করাই যদি তার এবং তার দলের লক্ষ্য হয়, তাহলে তারা নির্বাচনে অংশ নিলেন কেন? নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করাই তার দলের রাজনীতি? তার নিজের কোনও রাজনীতি নেই? তাহলে দলই বা গঠন করলেন কেন?

নানা অভিযোগ ও অসন্তোষ জানিয়ে ৩ জানুয়ারি সিলেট ও চুয়াডাঙ্গায় জাতীয় পার্টির তিনজন প্রার্থী নির্বাচন না করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ নিয়ে ভোটের প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় পার্টির অন্তত ১৫ জন প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এর বাইরে এবার জাপার আরও ১১ জন প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন পেয়েও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। শোনা যাচ্ছে, ভোটের মাঠে নানা ধরনের প্রতিকূলতায় পড়ে জাপার অনেক প্রার্থী হতাশায় পড়েছেন। ফলে শেষ পর্যন্ত আর ভোটের মাঠে থাকছেন না।

গত ৩ জানুয়ারি সিলেট-৫ আসনের প্রার্থী সাব্বির আহমদ সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘সরকার ও নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনি মাঠে সে রকম পরিবেশ নেই। এ অবস্থায় নির্বাচন করা খুবই কঠিন।’ তিনি জানান, গত ৩০ ডিসেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে নির্বাচনি পরিবেশ নিয়ে কিছু অভিযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু অভিযোগের সুরাহা হওয়া তো দূরে থাক, এরপর থেকে আরও ব্যাপকভাবে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে।

ভোট থেকে সরে যাওয়া জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের অভিযোগ, নির্বাচনি প্রচারে নেমে তারা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কোনও ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছেন না। উল্টো নানা ধরনের চাপ, অনেক জায়গায় হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন। তবে এই হুমকি বা চাপ কেবল নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের কাছ থেকে নয়। দলটির স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছ থেকেও আসছে।

দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবার জাতীয় পার্টিকে যে ২৬টি আসনে ছাড় দিয়েছে, তার বাইরে অন্য আসনগুলোয় প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী জাপার প্রার্থীরা তাদের দল থেকেই সহযোগিতা পাচ্ছেন না—এমন অভিযোগও আছে। কেউ কেউ বলেছেন যে, তারা জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতাদের আচরণে হতাশ। কেননা তারা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ছাড় পাওয়া ২৬ জন প্রার্থীকে নিয়ে ব্যস্ত।

প্রশ্ন হলো, যে নির্বাচনের ফলাফল সবার জানা এবং যে নির্বাচনে ওই অর্থে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই; বিরোধী দলের প্রার্থী পরিচয়ে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তারাও প্রকারান্তরে সরকারি দলেরই অংশ, সেরকম একটি নির্বাচন থেকেও কেন একের পর এক প্রার্থী সরে দাঁড়ালেন? তার মানে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা একটি আসনেও ছাড় দিতে চাচ্ছেন না? যদি তিনশো আসনের মধ্যে পৌনে তিনশো আসনেই নৌকার প্রার্থীরা জয়ী হন; যদি জাতীয় পার্টিসহ আওয়ামী লীগের শরিক দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমান সুযোগ না থাকে, তাহলে পৌনে তিনশো বা তারও বেশি আসন নিয়ে আওয়ামী লীগ যে সংসদ গঠন করবে, সেটি কি দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে? সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য এটি কি ভালো কোনও উদাহরণ তৈরি করবে?

যে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও তাদের শরিক দলগুলো অংশ নিচ্ছে না বলে নির্বাচনকে তুলনামূলকভাবে অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর রাখতে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নমনীয় অবস্থান ঘোষণা করেছিল, সেই নির্বাচনে একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী কেন সরে দাঁড়ালেন? আওয়ামী লীগ কি তাহলে কোনও ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে চায় না?

একশো আসনেও যদি নৌকা ছাড়া অন্য প্রতীকের প্রার্থীরা জয়ী হন, তাতেও আওয়ামী লীগের জন্য সরকার গঠনে কোনও অসুবিধা হবে না। সুতরাং এরকম একটি নির্বাচনও কেন প্রশ্নমুক্ত রাখা যাচ্ছে না? কেন শরিক দলের প্রার্থীরাও একে একে সরে দাঁড়াচ্ছেন? তারা কেন ভোটের মাঠে টিকতে পারছেন না? এই প্রবণতা কি ভোটকে অংশগ্রহণমূলক করার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে না?

বলা হচ্ছিলো যে, সরকার ও সরকারি দল এবার ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি চায় না। অর্থাৎ আগের দুটি নির্বাচন নিয়ে যেরকম সমালোচনা আছে, এবারের নির্বাচনকে সেই সমালোচনার উর্ধ্বে রাখা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই নির্বাচনটিও কি সমালোচনা ও বিতর্কের উর্ধ্বে রাখা যাচ্ছে? যদি না যায় তাহলে এই নির্বাচন কি দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে? যদি না হয় তাহলে বাংলাদেশকে কীভাবে এর খেসারত দিতে হবে—সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।

এমতাবস্থায় গত বৃহস্পতিবার (৪ জানুয়ারি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ব্রাসেলসভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) বলেছে, প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে হতে যাওয়া নির্বাচনে গ্রহণযোগ্যতার অভাব থাকায় তা কেবল বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভাজনই বাড়াতে যাচ্ছে, আর সাথে যোগ করছে সহিংসতার ঝুঁকিও। যেহেতু নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার মতো সময় এখন আর নেই, তাই স্বল্পমেয়াদে অস্থিতিশীলতা এড়াতে এবং একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে কাজ করতে সংস্থাটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপির মধ্যে নির্বাচনের পর সংলাপের তাগিদ দিয়েছে। আইসিজি মনে করে, এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ভোটাররা প্রকৃত অর্থে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পাবে। (ডয়েচেভেলে, ০৪ জানুয়ারি ২০২৪)।

তবে অতীত অভিজ্ঞতা এবং আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় না ভোটের পরেও এই দুই দলের মধ্যে কোনও সংলাপ হবে। কেননা আইসিজি যেদিন এই আহ্বান জানালো, সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে ছাত্রলীগের ৭৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শোভাযাত্রাপূর্ব সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘৭ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপিকে চিরতরে লালকার্ড দেখানো হবে।’ প্রশ্ন হলো, খেলার মাঠ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিদের লালকার্ড দেখিয়ে উঠিয়ে দিলে কি আর আলাপ-আলোচনার সম্ভাবনা থাকে?

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চীনের দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক ধসে নিহত ৩৬
চীনের দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক ধসে নিহত ৩৬
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
রাশিয়ার বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের
রাশিয়ার বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের
কেনিয়ায় বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৮১
কেনিয়ায় বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৮১
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ