X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন: এই পাশবিকতার শেষ কোথায়?

আবু জাফর মিয়া
০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১৪:০২আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১৪:০২

কিছু দিন ধরে একের পর এক ট্রেনে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় মৃত্যুবরণ করেছেন বেশ কিছু সাধারণ মানুষ। সর্বশেষ গতকাল রাত আনুমানিক ৯টা ৪৫ মিনিটে বেনাপোল এক্সপ্রেস নামক ট্রেন কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছানোর কিছু আগে গোপীবাগে থাকাকালীন দুর্বৃত্ত কর্তৃক অগ্নিসংযোগ করা হয় ট্রেনটিতে।

এতে এখন পর্যন্ত যা খবর, তাতে মা, শিশুসহ একই পরিবারের ৪ জন আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আহত হয়েছেন অনেকে, নিখোঁজ রয়েছেন আরও অনেক। কী নিষ্ঠুর পাশবিকতা! কী বীভৎস! এক মানুষ আরেক মানুষকে পুড়িয়ে মারে! কোন যুগে বাস করছি আমরা? এখন না আধুনিক যুগ চলমান? সভ্য যুগ? কিন্তু এ কোন অসভ্যতা? মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও  হার মানাবে এ নিষ্ঠুরতা।

‘আইয়ামে জাহেলিয়া’ যুগে কন্যাসন্তান জন্ম নিলে তাদের জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। অর্থাৎ জীবন্ত পুঁতে ফেলে তাদের হত্যা করা হতো। অত্যন্ত বর্বর ছিল এ যুগ। তাই মধ্যযুগের এ বর্বরতাকে মধ্যযুগীয় বর্বরতা নামে অভিহিত করা হয়। এ মধ্যযুগের মানুষরাও কিন্তু অন্য মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারার কথা চিন্তা করেনি।

সেখানে এই আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক সভ্য যুগে মানুষ মারার উদ্দেশ্যে যাত্রীবাহী বাস কিংবা ট্রেনে আগুন দিচ্ছে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’, অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ, ভাবা যায়?

চোখ বন্ধ করে একটু ভেবে দেখুন তো, ভয়ে আতঙ্কে আপনার শরীরের সব পশম দাঁড়িয়ে যাবে। বাকরুদ্ধ হয়ে যাবো আমি-আপনি।

এ নাশকতার মানে কী? এর অর্থই বা কী! এর শিকার হচ্ছেন তো দেশের সাধারণ মানুষ। যারা দ্রব্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বগতির বাজারে জীবন প্রবাহকে স্বাভাবিক, সচল রাখতে হাঁসফাঁস করছেন, একদিন কাজে না গেলে তাদের কপালে ভাত জুটবে না, হরতাল-অবরোধে ঘরে বসে থাকলে যেমন তাদের দৈনন্দিন সাংসারিক খরচের জোগান হবে না, তেমনি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ কিংবা চিকিৎসার খরচ জুটবে না।

বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই বেশ কয়েকটি আগুন সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে। গত ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখ মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশনে অগ্নিসংযোগ করলে ৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এতে এক শিশু মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে দুজনেরই মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।

এছাড়া ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখ ট্রেনের লাইন কেটে রেখে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটানো হয়। এতে ট্রেনটির ৭টি বগি বাইরে পড়ে যায়। ফলে একজন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। স্বাধীন দেশের কোন মানুষ অন্য মানুষকে পৈশাচিক কায়দায় আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করবে?

মুক্তিযোদ্ধারা নিশ্চয়ই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ বাংলাদেশ দেখার জন্য স্বাধীন করেননি। নিশ্চয়ই এই বাংলাদেশের কল্পনা করে ৩০ লাখ শহীদ তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেননি, সবচেয়ে মূল্যবান জীবনকে হাসতে হাসতে উৎসর্গ করেননি। ২ লাখ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারাননি।

তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের, যে বাংলাদেশে কোনও পরাধীনতার শৃঙ্খলে কেউ আবদ্ধ থাকবে না। যেখানে কোনও হানাহানি, মারামারি, খুন-খারাবি থাকবে না, মানুষে মানুষে থাকবে না কোনও বৈষম্য।

সবচেয়ে বড় কথা, তারা সবাই এমন নিরাপদ বাংলাদেশ চেয়েছিলেন, যেখানে প্রত্যেক মানুষ স্বাধীন ও নির্বিঘ্নে জীবনযাপন ও চলাফেরা করতে পারবে। জীবনের নিরাপত্তা থাকবে। কিন্তু সেই চাওয়ার কতটুকু প্রতিফলন হয়েছে? নিজ দেশের মানুষের হাতে নিরপরাধ মানুষগুলো এভাবে আগুনে দগ্ধ হয়ে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়া তো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি বহন করে না।

প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্বৃত্তরা এই অগ্নিসন্ত্রাসের আশ্রয় কেন নিচ্ছে?  আজ (৭ জানুয়ারি) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ তার সমমনা ২৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে। বিএনপি ও তার সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকেছে।

সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নানামুখী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে সফলভাবে  দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর। অন্যদিকে বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো এ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে অনড়। তাই তারা একের পর এক হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। খেটে খাওয়া মানুষগুলো করোনার ২ বছর না খেয়ে, না পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করেছে।

করোনা তাদের স্বাভাবিক জীবন প্রবাহকে আমূল বদলে দিয়ে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করেছে। অনেক ব্যবসায়ীকে দেখেছি করোনাকালীন ঘর ভাড়া দোকানের সব মালামাল বিক্রি করেও পরিশোধ করতে পারেননি। ব্যাংকের ঋণ, ঘর ভাড়া এবং কর্মচারীর বকেয়া পরিশোধের জন্য তার একমাত্র সম্বল নিজের জমি কিংবা বাড়ি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছেন। খেটে খাওয়া মানুষ তাদের স্বর্ণালংকার, ফার্নিচার বিক্রি করে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে।

করোনা পরবর্তী মানুষ যখন ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে, তখন গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে আবির্ভাব হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। কেননা, এ যুদ্ধের ফলে সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও খাদ্যশস্যসহ সকল পণ্যের দাম আকাশচুম্বী বেড়ে যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট প্রায়ই অস্থিতিশীল রাখছে এ বাজার ব্যবস্থা।

এহেন নানামুখী বিরূপ পরিস্থিতি সরকার প্রয়োজনীয় ও কার্যকর উদ্যোগের মাধ্যমে উতরানোর চেষ্টা করেছে এবং বলা চলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকার সফলও হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন বানচালের নিমিত্তে বিরোধী দলগুলোর হরতাল-অবরোধ সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারছে না কোনও রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়; বরং নিজেদের প্রয়োজনে। যেমন– খেটে খাওয়া মানুষগুলো হরতাল-অবরোধে ঘরে বসে থাকলে তাদের আয়রোজগার একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবনের সব চাকা থেমে যাওয়ার উপক্রম হবে।

করোনার কারণে শিক্ষা ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হরতাল-অবরোধের কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হবে। তাই তো হরতাল-অবরোধের আতঙ্ক মাথায় নিয়েও সাধারণ মানুষ প্রত্যেকেই ঘর থেকে বের হচ্ছে নিজেদের প্রয়োজনে। সেখানে দুর্বৃত্তরা হরতাল-অবরোধে একের পর অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে কেড়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবন। জীবনে শত অভাব অনটনে জর্জরিত এসব সাধারণ মানুষ আসলে কে ক্ষমতায় আসলো, আর কে ক্ষমতা থেকে গেলো এগুলো নিয়ে ভাববার একদম অবকাশ তাদের নেই। তাদের ভাবনা স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকা।

রাজনীতি করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষের কল্যাণ করা। সুতরাং যেই সাধারণ মানুষের কল্যাণ করার কথা রাজনীতিবিদদের, সেখানে বাসে কিংবা ট্রেনের মধ্যে সেই সাধারণ মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে পুড়িয়ে মারার মধ্যে কী কল্যাণ লুকিয়ে থাকতে পারে। এ কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে এসব নাশকতার মূলে হচ্ছে রাজনীতি। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে ৭ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখের নির্বাচনকে ঘিরে।

সরকার তথা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দাবি করছে, সরকার বিরোধী দলগুলোর কেউ কেউ নির্বাচনকে বানচাল করার জন্যই নাশকতা তথা সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছে। তাই তারা নির্বাচন অংশগ্রহণ না করে অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে মানুষকে পুড়িয়ে মারছে। এ কথা সত্য হলে, বলতে হয় ক্ষমতায় যেতে হলে সাধারণ মানুষের জনমত নিয়ে এবং তাদের সঙ্গে নিয়েই ক্ষমতায় যেতে হবে। তাদের পুড়িয়ে হত্যা করে ক্ষমতার মসনদে যাওয়া যাবে না। কেননা, মানুষ মারার রাজনীতি করে সাধারণ মানুষের সমর্থন আদায় করা যাবে না। বরং সাধারণ মানুষ এসব রাজনীতিবিদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন কিংবা সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার বাস্তবায়নের পক্ষে কথা বলেই সাধারণ মানুষের সমর্থন আদায় করা সম্ভব হবে।

একইভাবে বলা যায়, সাধারণ মানুষের জান মালের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের একান্ত দায়িত্ব। বাসে, ট্রেনে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে যারা মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করছে, তাদের চিহ্নিত করা সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব।

আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে-পরে অগ্নিসন্ত্রাস ও পেট্রোলবোমার মাধ্যমে যে বা যারা মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করেছে, তাদের অনেকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু কোনোটারই বিচার এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করা হয়নি। সুতরাং বর্তমানে যে দুর্বৃত্তরা আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি সবার। সরকারকে এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।

দোষী যেই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাজনীতি আর কেউ করার সাহস না পায়। এর ব্যত্যয় হলে সরকারও এর দায়ভার এড়াতে পারবে না। বিরোধী দলগুলো দাবি করছে সরকার নিজেই এ ঘটনাগুলো ঘটিয়ে বিরোধীদের ওপর দায় চাপাচ্ছে।

মনে রাখতে হবে সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর দিয়ে কেউ ক্ষমতায় যেমন যেতে পারবে না, তেমনই এ ধরনের অপকর্মের বিচার নিশ্চিত না করতে পারলে জনগণের আস্থা অর্জনও সম্ভব হবে না। সুতরাং সরকারকে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দেখিয়ে এ অপকর্মগুলোর সঙ্গে জড়িতদের (যে দলেরই হোক না কেন?) খুঁজে বের করে কঠোরতম শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তবেই এ ধরনের অপকর্মের বিনাশ সম্ভব।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কেনিয়ায় বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৮১
কেনিয়ায় বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৮১
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে
বিদেশফেরত যাত্রীকে নিয়ে ফেরার পথে ট্রাকচাপায় ৫ জন নিহত
বিদেশফেরত যাত্রীকে নিয়ে ফেরার পথে ট্রাকচাপায় ৫ জন নিহত
মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত, রাজবাড়ীতে রেল যোগাযোগ বন্ধ
মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত, রাজবাড়ীতে রেল যোগাযোগ বন্ধ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ