X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়

রেজা সেলিম
২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৮:১০আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৮:১০

বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর প্রধান দুই রূপ- গ্রামীণ ও নগর সমাজের গোড়াপত্তনের ইতিহাস একরৈখিক বা সমান্তরাল নয়, উপরন্তু গ্রামীণ সমাজের ইতিহাস দীর্ঘতম ও বৈচিত্র্যময়। এর প্রধান কারণ গ্রাম সমাজ উৎপাদন ব্যবস্থার প্রধান ধারক। যদিও উভয় কাঠামোয়ই সমাজের মৌল ভিত্তি নির্ভর করে সমাজের অর্থনৈতিক বা উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর। সংগত কারণেই আমাদের দেশে সমাজের উপরি-কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে নগর সমাজ বা নগরের চালিকাশক্তি, যার ফলে দৃশ্যমান হয় রাষ্ট্র, সরকার ও আইন, এমনকি এই সমাজের শিল্প, কলকারখানা। কিন্তু গ্রামীণ সমাজে চলমান উন্নয়নের সুবিধায় ও গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো নির্মাণে জনসংখ্যা আধিক্যের ভূমিকা থাকায় গ্রামীণ মধ্যবিত্ত এখন উপরি-কাঠামো নির্মাণ ও পরিচালনায় কম-বেশি প্রত্যক্ষ অংশ নিচ্ছে।

ফলে এও সত্য যে উৎপাদনের সঙ্গে বহুকালের স্থাপিত সম্পর্কে গ্রাম নাগরিকের কোনও ভাটা পড়েনি বা দূরত্ব তৈরি হয়নি, তদুপরি তথ্য-প্রযুক্তি ও সাংস্কৃতিক সম্প্রসারণ এই সমাজের মধ্যে একটি নতুন শ্রেণিকরণের মনন তৈরি করেছে, যা আমাদের উপেক্ষা করা উচিত হবে না।

‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’ বাস্তবায়নকালে হয়তো এই কারণে Social exclusion চিন্তা নিয়ে কোনও কোনও বিচক্ষণ কর্মকর্তা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ফলে গ্রামীণ সমাজে নতুন বসতিপ্রাপ্ত দীন-দরিদ্র পরিবারগুলোকে আলাদা করে দেখার মনো-সংস্কৃতি তৈরি হলেও তা আমাদের বিবেচনায় রাখা যেন social inclusive বা অন্তর্ভুক্তিমূলক মিশেল সমাজ গঠনের সমাধান-উপায় আমাদের হাতে থাকে।

গ্রামীণ সমাজের শ্রেণিবিন্যাসে আশ্রয়ণের অধিবাসীদের তুচ্ছ বা বিচ্ছিন্ন করে রাখার বা দেখার কোনও অবকাশ থাকবে না যদি এই সদ্য ভূমিপ্রাপ্ত পরিবারগুলো প্রত্যক্ষ উৎপাদনে ও বাজারজাতকরণে ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়। শ্রমবাজারে দিনমজুর বা কায়িক শ্রমে ফসল উৎপাদনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখলেও এসব পরিবারের সব সদস্যের সব উৎপাদন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ‘অন্তর্ভুক্তি’ শেখ হাসিনার মর্মবাণী, যা এই প্রকল্পের লক্ষ্যপূরণের অন্তর্নিহিত দর্শন। ইতোপূর্বেকার গুচ্ছগ্রামের অধিবাসীদের ক্ষমতাধর সমাজ কাঠামো নানাভাবে বিড়ম্বনায় ফেলেছে সে অভিজ্ঞতা যাচাই করে আশ্রয়ণের বসতিতে যেন সেসবের পুনরাবৃত্তির সুযোগ না ঘটে তা গোড়া থেকে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের অংশ হতে হবে।

আশ্রয়ণ যে সমাজ কাঠামো নির্মাণ করতে চলেছে তা বাংলাদেশের মিশেল গ্রাম সমাজের অন্যতম উদাহরণ। এখানে একটি বিষয় অতি গুরুত্বপূর্ণ যে যেসব মানুষের কোনও বসতভূমি ছিল না, সরকারি উদ্যোগে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় তাদের জন্যে বসতি গড়ে দেওয়া হয়েছে ও ভূমির মালিকানাসমেত তাদের স্থায়ী করা হয়েছে। এসব জমির অধিকাংশই খাস বা সরকারি জমি, যেগুলো ভূমি ব্যবস্থাপনার নিয়মে অন্তর্ভুক্ত করে ভূমিহীন সমাজের কাছে সেসবের মালিকানা হস্তান্তর করা হয়েছে। খাস জমির দুষ্প্রাপ্য ক্ষেত্রে সরকার কিছু স্থানে জমি কিনে এসব বসতি স্থাপনে সহায়তা করেছে। যেহেতু সরকারের মূল উদ্দেশ্য দেশের ভূমিহীন-বসতিহীন মানুষের ঠিকানা প্রতিষ্ঠা করা, এ ক্ষেত্রে কর্মসূচির অগ্রাধিকার ছিল ভূমিহীন চিহ্নিত করে সফল ব্যবস্থাপনায় ভূমিসমেত নির্মিত গৃহ হস্তান্তর নিশ্চিত করা। ফলে বসতি স্থাপনের পরে অধিবাসীদের জীবনধারণ, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, শিশুদের শিক্ষা, বয়স্কদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও সর্বোপরি গ্রামীণ শ্রমবাজারে প্রবেশের সীমাবদ্ধতা মূলধারার সমাজ জীবনের সঙ্গে নতুন বসতির মানুষদের বাধ্যগত দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সে কারণেই অনিবার্যভাবে উত্থাপিত হয় ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে শেখ হাসিনা মডেল’।

এ ক্ষেত্রে সম্ভবত শেখ হাসিনাই উপমহাদেশে প্রথম একটি গ্রাম সমাজের নয়া বসতি স্থাপনের সুদূরপ্রসারী পরিস্থিতির সামগ্রিক উন্নয়ন বিবেচনার ঐতিহাসিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন, “আমাদের উন্নয়নের একটি মানবিক অবয়ব রয়েছে। দারিদ্র্য ও ঝুঁকির মধ্যে থাকা জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন আমাদের উন্নয়ন কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অন্যতম নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে”। এই বক্তব্যে যুগপৎ ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি’ ও এর ফলে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির’ দূরপ্রসারী ‘নিয়ামক’ চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে।

এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী? আমরা জানি আমাদের পারিবারিক কাঠামোয় উত্তরাধিকার যখন কৃষি জমির মালিকানা বিভক্ত করে নেয় তখন তার বসতিভূমিও খণ্ডিত হয়। এমনকি গাছপালা, পুকুর বা আঙিনাও খণ্ডিত হয়। দুর্ভাগ্যবশত শহর সমাজ বসতির এককেন্দ্রিক জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত গ্রামের জীবনেও একটি বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার বিচ্ছিন্ন ভূমিতে পরিবার পরিজনের সুবিধার্থে আলাদা বসতি গড়ে তোলে। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে কখনও সমাজ বাধ্যগত দূরত্ব তৈরি করে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেড়ার ঘরগুলো টিনের হয়ে এখন সেমি-দালান বা দালানের ঘরে ঝুঁকে নিজে থেকেই বসতির দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে।

মাত্র এক দশক আগেও যেখানে টেলিভিশন ও ডিশের সংযোগ গ্রাম সমাজের মধ্যে সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বে নতুন মাত্রা যোগ করে নিয়েছিল সেখানে এখন যুক্ত হয়েছে ইউটিউব, স্মার্ট ফোন ও ফেসবুক। ফলে গ্রাম সমাজের মনোসংযোগে বিশ্বযোগ ঘটেছে, যার ফলশ্রুতিতে একটি ডিজিটাল প্রযুক্তিনির্ভর ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’ ঘরে ঘরে মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এই প্রভাব মোটেই উদ্বেগজনক নয়, শঙ্কার বিষয় যা তা হলো গ্রামের কৃষিজাত উৎপাদন, ফসল সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, বাজার ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে গ্রাম সমাজের নয়া বসতি কেমন করে অংশ নিতে পারে, যা শেখ হাসিনার ‘অন্তর্ভুক্তি উন্নয়নের’ মৌলিক চিন্তাকে সম্মানজনক নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

প্রান্তিক পর্যায়ে প্রযুক্তি বিকাশের ফলে বাংলাদেশের গ্রাম সমাজের সব অনুষঙ্গের প্রতিফলিত ডাটাবেজ থাকা দরকার। আশ্রয়ণের বড় শক্তি শ্রমবাজারের জোগান, কারণ এসব ভূমিহীন মানুষের নিজের আঙিনা ছাড়া কৃষি বা গার্হস্থ্য পণ্য উৎপাদনের কোনও জমি নেই। যে দেশে কৃষিপণ্যের বাজার এখনও মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে সেখানে একে ছাড়িয়ে নিয়ে প্রকৃত উৎপাদন সমাজের হাতে ছেড়ে দিতে হলে কৃষি শ্রমশক্তির গ্রামভিত্তিক ডাটাবেজ তৈরি হতে হবে। ফলে এর ব্যবস্থাপনা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নচিন্তার গ্রামভিত্তিক সমবায় কৌশলের হাতে ছেড়ে দেওয়া সহজ হবে। প্রচলিত সমবায় ভূমি, আবাদ, ফসল বা গেরস্থালি উৎপাদন, কুটির শিল্প অর্থাৎ কোনও না কোনও পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু গ্রামভিত্তিক শ্রমবাজারের ডাটাবেজ অনুযায়ী যদি ‘শ্রমশক্তির সমবায়’ গঠন করা যায় সেই সমবায় একই সঙ্গে উৎপাদন, বাজারজাত, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা, প্রক্রিয়াজাত শিল্পে মনোনিবেশ করতে পারে। আর এর সঙ্গে পারিবারিক সদস্যদের দক্ষতার শ্রমশক্তি যুক্ত হলে নিঃসন্দেহে বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীর অনুপ্রবেশের সুযোগ থাকবে না।

এমনকি এখন যে কৌশলে ক্ষুদ্র ঋণের পুঁজি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগ করার নামে গ্রামে গ্রামে প্রবেশ করেছে তা-ও বন্ধ হতে বাধ্য। কারণ ‘শ্রমশক্তির সমবায়’ এই পুঁজির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে সক্ষম হলে এর সঙ্গে যুক্ত হবে নিজেদের দক্ষতা শক্তি ও পারিবারিক সম্প্রীতির শক্তি। আমরা ভুলে যাই যিনি উৎপাদক তিনি নিজেও কিন্তু ভোক্তা, তাকে নিজের বাজার ছেড়ে অন্যের বাজারে কেন যেতে হবে সেই অর্থনৈতিক নৃতত্ত্ব আমাদের এখনই অনুধাবন করা উচিত। নতুবা নয়া বসতিকে দূরে রেখে গ্রাম শোষণের মহাজনী সংস্কৃতি থেকে আমরা বের হতে পারবো না। শেখ হাসিনা তাঁর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন মডেলে সেই আদর্শ চিন্তার সুযোগ আমাদের করে দিয়েছেন।

লেখক: পরিচালক, আমাদের গ্রাম  
 [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আসামি ধরতে গিয়ে ৩ পুলিশ আহত
আসামি ধরতে গিয়ে ৩ পুলিশ আহত
কৃষকের মুখে হাসি কপালে চিন্তার ভাঁজ
কৃষকের মুখে হাসি কপালে চিন্তার ভাঁজ
টিভিতে আজকের খেলা (৫ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৫ মে, ২০২৪)
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ