X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সামান্য ক্ষতি কিংবা আগুননামা!

আহসান কবির
২৬ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:৪২আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০১৭, ১৪:০২

আহসান কবির আগুনের কথা বন্ধুকে বলি দুহাতে আগুন তারও/কার মালা থেকে খসে পড়া ফুল রক্তের চেয়ে গাঢ়/ যার হাতখানি পুড়ে গেলো বধূ আঁচলে তাহারে ঢাকো/আজও ডানা ভাঙা একটি শালিক হৃদয়ের দাবি রাখো-
-সঞ্জীব চৌধুরীর কণ্ঠের গান, কামরুজ্জামান কামুর লেখা
হৃদয়ের দাবিতে পরে আসা যাবে। আগুন নিয়ে খেলা নাকি ভালো নয়! সুদূর অতীত থেকেই ছিল আগুন বিতর্ক। আবার আগুন নাকি সভ্যতার সমান বয়সী। সে যাই হোক ২০১৭ সালটা শুরু হয়েছিল আগুনের খবর দিয়ে। ঢাকার গুলশান (গুলশানের আবার এক ও দুই নম্বর আছে! দুই নম্বরে কী কী দুই নম্বরি হয় সেটা না ভেবে গুলশান এক নম্বরের ডিসিসি মার্কেটের আগুনের কথাই বলা যাক) এর ডিসিসি মার্কেট আগুন লেগে পুড়ে গিয়েছিল, ভেঙে পড়েছিল মার্কেটের একাংশ। এরপরই এদেশের মানুষ নতুন করে রবীন্দ্রপ্রেমী হয়ে ওঠে। তাদের মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই লাইন—‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্ট ব্যাটাই চোর!’
ধারাবাহিকভাবে তিনটি আগুনের ঘটনা ঘটার পর অনেকের মনে কেষ্ট কে সেই প্রশ্ন জেগেছিল! আগুন লেগেছিল কাওরান বাজারের ফল ও সবজি মার্কেটে, এরপর আগুন লাগে কড়াইল বস্তিতে। গল্প রটে যায় এই দুই জায়গায় উদ্দেশ্যমূলক আগুন লাগানো হয়েছিল একারণে যে সাধারণ দোকানের পরিবর্তে এখানে বহুতল মার্কেট হবে। যারা এখানে ব্যবসা করতো তাদের মনে ভয় ঢুকে যায়। বহুতল নতুন মার্কেট হলে তারা কি পুরনো হিসেবে দোকান বরাদ্দ পাবে? নাকি এটা নিয়েও বরাদ্দ বাণিজ্য হবে? গুলশান এক নম্বরের ডিসিসি মার্কেটে আগুন লাগার পর এই গল্প ভাইরাল আকারে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক বলতে বাধ্য হন- তদন্ত কমিটি হয়েছে। তারা কী রিপোর্ট দেন আসুন আমরা সেই রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করি।

তদন্ত কমিটি আর ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের ভেতর একটা মজার মিল আছে। শুরু হলে আর শেষ হতে চায় না। সুতরাং তদন্ত কমিটি নিয়ে না ভেবে আবারও আগুন নিয়েই ভাবি। আগুন লাগিয়েছে কোন সে কেষ্ট (ফাটা কেষ্ট বলেও একটা কথা প্রচলিত আছে। কেউ দয়া করে সেদিকে যাবেন না) সেটা না ভেবে আমরা একটু প্রমিথিউসের কাছে যাই! গ্রিক মিথ অনুসারে মানুষ ভালোবাসে এমন এক বিপ্লবী টাইটান দেবতার নাম প্রমিথিউস। মৌরি গাছের ডালে করে স্বর্গ থেকে আগুন এনে উনি মানুষকে বিলিয়েছিলেন। মানুষের খুব বেশি আগুন দরকার ছিল তখন। অন্ধকারে অনেক রোগ শোক জরা মানুষকে ঘিরে ধরেছিল। ব্যাপারটা টের পেয়ে যান দেবতাদের রাজা জিউস। তিনি প্রমিথিউস কে ককেশাস পাহাড়ের চূড়ায় বন্দি করে রাখেন। তাতেও মন শান্ত হয় না জিউসের। নতুন শাস্তি জারি হয়। প্রতিদিন এক ক্ষুধার্ত ঈগল এসে খেয়ে যেত প্রমিথিউসের হৃদয় (কারও কারও মতে যকৃত)! তবে রাতভর নতুন হৃদয় জন্ম নিত। কিন্তু পরদিন আবারও সেই ক্ষুধার্ত ঈগল প্রমিথিউসের হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে খেতো। (জানি না এই ঘটনা থেকেই জীবনানন্দ লিখেছিলেন কিনা- কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!) বহু বছর পরে হারকিউলিস প্রমিথিউসকে উদ্ধার করেন । সঞ্জীব চৌধুরীর গানে আছে- যার হাতখানি পুড়ে গেলো বধূ আঁচলে তাহারে ঢাকো। প্রমিথিউসকে আঁচলে ঢেকেছিল হারকিউলিস। আগুনে যার সবকিছু পোড়ে তাকে হারকিউলিসের মতো আঁচলে ঢাকবে কে?

আগুনের আঁচলে সভ্যতা অথবা মানুষের আঁচলে আগুন বহু আগে থেকেই ছিল। প্রমিথিউসের সময় থেকে কিংবা তারও পর থেকে অনেক মানুষ আগুন দেবতার পূজা করতো। এই অগ্নি উপাসক মানুষদের সঙ্গে আর্যদের সম্পর্ক ছিল, যে আর্যরা ভারতবর্ষ দখল করেছিল। একদা ইরান এবং এর আশে পাশের অঞ্চলের অগ্নি উপাসক মানুষের পালন করা এই ধর্মের নাম ছিল জরাথুস্ত্র। ছয় এবং সাত শতকে ওই অঞ্চলের মানুষেরা ইসলাম গ্রহণ করলে এদের একটা ছোট্ট অংশ ভারতে পালিয়ে আসে যারা আজও আছে। আগুন পূজার অনেকটা আছে সনাতন কিংবা হিন্দু ধর্মেও। ইন্দ্রর যমজ ভাই হচ্ছে অগ্নি যাকে দেবতা জ্ঞান করা হয়। আছে আগুনের ভিন্ন ভিন্ন নামও। অরণ্যকে যে আগুন পোড়ায় তার নাম দাবানল। আগুনকে সাক্ষী রেখে এবং সাতবার ঘুরে বিয়ের রীতি আছে। বিয়ের আগুনকে বলে যোজক। এই আগুন নাকি আজীবন পোড়ায়! গৃহস্থের বাড়িতে যজ্ঞের সময় যে আগুন জ্বালানো হয় তার নাম হোমাগ্নি। যে আগুন জ্বালিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করা হয় তার নাম বিধু। আর শবযাত্রার সময়ে যে আগুন জ্বালানো হয় তার শুরুটার নাম মুখাগ্নি। পুরো জিনিসটার নাম চিতা।

চিতাতেই সব শেষ। আগুনে পুড়ে যে সর্বস্ব হারায় আগুনটাকে তার চিতার মতোই মনে হয়। তবে গ্রিক মিথে আগুন দেবতা একজন পুরুষ, হিন্দু মিথে অগ্নি নিজেও পুরুষ। সভ্যতায় আগুনের এতো কদর বলে পুরুষ দেবতারাই এই যোগ্যতা তাদের দখলে রেখেছে। অন্যদিকে নারীরা সেখানে খারাপ। প্রমিথিউসের ওপর রাগ করে জিউস পাঠান এক বাক্স, যা খোলা ছিল বারণ। কৌতুহল বশতঃ জিউসের মেয়ে সেটা খুলেছিল এবং বাক্সের নাম হয়ে যায় প্যান্ডোরার বাক্স। সেই বাক্স থেকে বেরিয়ে আসে রোগ, শোক, দুঃখ, জরা, ব্যাধি, ক্ষুধা। তবে ঈশ্বর দয়ালু এবং আশার ধারক। এই বাক্সের একেবারে শেষ উপাদান নাকি আশা। এই আশাতেই নাকি বেঁচে থাকে মানুষ। আগুনের গল্প বা মিথে পুরুষই প্রধান, নারী সেখানে ইভের মতো—যার প্ররোচনায় অ্যাডাম বা আদমের স্বর্গ থেকে পতন!

আগুন যার সব কিছু কেড়ে নেয় তার কাছে পৃথিবীটা যে চিতার মতো সেটা আগেই বলা হয়েছে। তবে কবি হেলাল হাফিজ আরেকটা আগুনের সন্ধান দিয়েছেন যার নাম মানবানল অর্থাৎ মানুষের আগুন। সেই কবিতায় আছে—মানুষের চেয়ে বেশি কিছু নয় আগুনের সোনালি সন্ত্রাস! আগুনে পোড়ালে তাও কিছু রাখে/তাও কিছু থাকে/হোক না সে ধূসর বর্ণ ছাই/মানুষে পোড়ালে কিছুই রাখে না/কিছুই থাকে না/খা খা বিরান/আমার কিছু নাই!

কারো মন ভাঙা নাকি মানবানল। সেই অনলে পুড়ে যায় আরেকটা হৃদয়। বন বা বস্তির ওপর আক্রোশ থাকলে সেখানেও আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটে। ১৯৭১ এ পাকিস্তানি হানাদারদের সন্ত্রাসের অন্যতম উপাদান ছিল আগুন। তারা গণহত্যা চালানোর পর বেঁচে যাওয়া অসহায় মানুষরা যেন কোথাও আশ্রয় নিতে না পারে সেজন্য গ্রাম কিংবা শহর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতো।

পৃথিবীতে আগুন নিয়ে ছবি হয়েছে অনেক। আগুনের কিছু ভিন্নমাত্রার ব্যবহারও আছে। শহীদ স্মরণে যখন হাজারো মোমবাতি জ্বালিয়ে মানুষ শহীদ মিনার কিংবা শাহবাগে সমবেত হয় তখন সেই মোমের আলোকে মনে হয় বাঙালির চেতনার আগুন। আশারও নাকি আগুন থাকে!  এই আগুনের নাম ফানুস। মানুষ আশা করে ফানুস উড়িয়ে দেয়। জানি না সেই আশার আগুন বিধাতার কতোখানি কাছাকাছি যায়।মানুষের আনন্দের মাত্রাতেও থাকে আগুন যোগ। আতশবাজির সমারোহ বুঝিয়ে দেয় আনন্দের মাত্রা কতোখানি!

রবীন্দ্রনাথের ভিন্নমাত্রার একটা কবিতা আছে আগুন নিয়ে যার নাম সামান্য ক্ষতি। মাঘ মাসের শীতে স্বচ্ছ সলিলা বরুনার তীরে গিয়েছিলেন রাজা মহিষী করুনা। সইদের নিয়ে স্নান শেষে তার শীত লাগছিল। এরপর নদীর পাশের গরিব প্রজাদের ঘর জ্বালিয়ে তিনি আগুন পোহালেন। রাজা এই ঘটনা জানার পর মহিষীর উত্তর ছিল এতো সামান্য ক্ষতি! গরিব প্রজাদের কুটিরের দাম আর কতো? রাজা উচিত শাস্তি দিয়েছিলেন মহিষীকে। ভিখারির পোষাক পরিয়ে তাকে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যতোদিন মহিষী গরিবদের পুড়ে যাওয়া কুটির তৈরি করে দিতে না পারবেন ততোদিন তাকে ভিখারিই থাকতে হবে!

যে কেষ্টরা আগুন লাগিয়ে নিঃস্ব করে দেয় মানুষকে, চিতার আগুনকে যাদের কাছে সামান্য ক্ষতি মনে হয়, তাদেরকে যদি রাজার মহিষীর মতো শাস্তি দেওয়া যেত! যে রাজা এমন শাস্তি দিতে পারবেন তাকে খুব বেশি দরকার আমাদের! আমাদের হৃদয়ের দাবি সেটাই!

লেখক: রম্যলেখক

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ