X
শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪
২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সমাজতন্ত্রের দিন কি শেষ?

চিররঞ্জন সরকার
১০ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:৫৪আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০১৭, ১৮:৫৯

চিররঞ্জন সরকার এবার নভেম্বর বেশ ঘটা করে পালন করা হলো ‘অক্টোবর বিপ্লবে’র শততম বার্ষিকী! বাংলাদেশের ‘বহুধাবিভক্ত’ বাম দলগুলো নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে দিবসটি পালন করেছে।
বাংলাদেশে যখন রুশ বিপ্লবের একশ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান হচ্ছে, তখন সেই রুশ দেশের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মহাদম্ভে ঘোষণা করেছেন, কোনও অনুষ্ঠান নয়। খোদ রুশ দেশে অক্টোবর বিপ্লবের কোনও অনুষ্ঠান না হওয়া ইতিহাসের একটি গভীর তামাশা বটে। অবশ্য রুশ বিপ্লবকে অস্বীকৃতির অন্তরালে একটি গভীরতর বাস্তব লুকিয়ে আছে। পুতিনের রাশিয়া আজ বহু অর্থে বলশেভিক-উত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘কাউন্টারপয়েন্ট’, সাড়ম্বরে তা ধনতান্ত্রিক বিশ্বের ক্ষমতাদৌড়ে সামিল। পুতিন সরবে ঘোষণা করেছেন, ‘১৯১৭ সালের থেকে ১৯৮৯ সাল বহুগুণ গুরুতর, প্রথমটি তাদের দেশকে ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তিতে নিয়ে গিয়েছিল, আর দ্বিতীয়টি তা উদ্ধার করেছে!’
পুতিনের মতো রাশিয়ার তাবৎ মানুষের অনুভূতিও যদি এমনই হয়, বলশেভিক বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন তাহলে সত্যিই অর্থহীন হয়ে পড়ে। পুতিনের মন্তব্যটি তাই বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীই স্বীকার করেন যে, অক্টোবর বিপ্লব মানব ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি।

মার্কিন সাংবাদিক জন রিডের লেখা ‘Ten Days That Shook The World’ বা ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ অনেকেই হয়তো পড়ে থাকবেন। বইটি ছিল ১৯১৭ সালে সংঘটিত সোভিয়েত বিপ্লবের ওপর। সত্যিকার অর্থে সোভিয়েত বিপ্লব ছিল দুনিয়া কাঁপানো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরই তৎকালীন পূর্ব-ইউরোপীয় দেশগুলো সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অন্তর্ভুক্ত হয়। সোভিয়েত বিপ্লব দুনিয়ার দেশে দেশে সমাজ পরিবর্তনকামী মানুষের মধ্যে বিশাল কৌতূহল সৃষ্টি করেছিল। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাও সে তুঙ লিখেছিলেন, সোভিয়েত বিপ্লবের কামানের গর্জন চীনে মার্ক্সবাদ নিয়ে এসেছিল। ১৯৪৯-এর অক্টোবরে চীনা নেতা মাও বেইজিংয়ের তিয়েন আনমেন স্কয়ারে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ‘China has stood up.’ এরপর একে-একে উত্তর কোরিয়া, কিউবা, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসে কমিউনিস্ট পার্টিগুলো বিপ্লবী লড়াইয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়। এভাবে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ নতুন একসমাজ ব্যবস্থার অধীনে চলে আসে।

রুশ বিপ্লব। অক্টোবর বিপ্লব। পরবর্তীকালে পরিবর্তিত ক্যালেন্ডার মতে নভেম্বর বিপ্লব। পৃথিবীর ইতিহাসে বিপ্লব, বিদ্রোহ, ক্ষমতা দখল কম হয়নি। এ আসে, সে যায়। কিন্তু রুশ বিপ্লবের মেরুদণ্ডে যেন অন্য স্নায়ু প্রবাহিত। এ ক্ষমতা এমন এক দেশকে দেখতে চায়, দেখাতে চায়, যেখানে সব মানুষ পেট ভরে খেতে পাবে। সবাই মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে। প্রত্যেকে আবহাওয়া অনুযায়ী আরামদায়ক পোশাক পাবে। সব ছেলেমেয়ে স্কুলে যাবে। অর্থাৎ বেঁচে থাকার ন্যূনতম উপাদানগুলো, মানবিক ও মানসিক বিকাশের মৌলিক উপাদানগুলো নিশ্চিত হবে। লেনিন রুশ দেশে পৃথিবার ইতিহাসে একটা নতুন ভাবনার রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিলেন।

তখন রাশিয়াজুড়ে শুরু হয়েছিল একটা অনন্য জাগরণ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার, শিল্প, কৃষি, বিজ্ঞান, খেলাধূলা থেকে শুরু করে যে দিকেই তাকানো যায়–উন্নয়নের প্রায় অবিশ্বাস্য উদাহরণ। পৃথিবীর ইতিহাসে এর তুলনা নেই। এটা শুধু আমার দেশ নয়, এটা আমাদের দেশ। এ দেশ আমরা গড়ি, আমরাই চালাই—এই বোধ, এই সংঘবোধ এক জোয়ার আনে সর্বত্র। সারা বিশ্বের মানুষ তখন বিস্ময়ে তাকিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে। শিল্পোৎপাদনে বৃদ্ধির যে হার তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন দেখিয়েছে, সর্বকালে তার কাছাকাছি কোনও নজির নেই কোনও দেশে। শিক্ষায় তো ইউরোপ, আমেরিকা রীতিমতো শিক্ষাই নিয়েছে ওদের থেকে। ক্লাসরুমবন্দি, বিরক্তিকর লেখাপড়া ছেড়ে শিক্ষার প্রাঙ্গণ ছড়িয়ে পড়ল বাইরে। মাঠে, ঘাটে, পাহাড়ে, নদীতে, বাতিল ট্রেনের কামরায় চলল ইতিহাস বা ভূগোলের জীবন্ত পাঠ। বিজ্ঞান ছোটদের শুকনো বই ছেড়ে বেরিয়ে এলো মজাদার সব এক্সপেরিমেন্টে। ছোটদের কাছে খেলতে খেলতে পড়ার চেয়ে ভালো যে কিছু নেই, তা প্রথম শেখায় সোভিয়েত ইউনিয়ন।

এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা লাগে সোভিয়েতের মাটিতে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেটাই ব্যুমেরাং হয়ে নাৎসি বাহিনীর ওয়াটারলু হয়ে দাঁড়ায়। আর বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গোটা পৃথিবীতে আধিপত্য ভাগ হয়ে যায় আমেরিকা, রাশিয়ার মধ্যে।

এখানেও সোভিয়েত ইউনিয়নের আর এক নতুন রূপের দেখা মিলল। পূর্ব-ইউরোপের দেশে দেশে রুশ সৈন্য ঢুকে পড়লো। শুরু হলো বিপ্লব রফতানি। বিশ্ব রাজনীতিতে নিজ রাষ্ট্রের আধিপত্য বাড়াতে কোথাও অর্থনৈতিক, কোথাও সামরিক প্রভাব খাটাতে শুরু করলো তারা। এটা বাইরের দিক। আর ভেতরে? সেখানে শুরু হলো নিরঙ্কুশ পার্টি নিয়ন্ত্রণ। পার্টি নেতাদের ক্ষমতা চরম জায়গায় পৌঁছালো।

বহু মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, অর্থনীতিবিদ সেই সময় থেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেন। কিসের সমাজতন্ত্র? কিসের শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্ব? আসলে তো গোটা দেশটা নিয়ন্ত্রণ করছে একটা পার্টি। আসলে পার্টির মাথায় বিভিন্ন স্তরে বসে থাকা কিছু কিছু লোক। গণতন্ত্রের বহুদলীয় ব্যবস্থার মতো এখানে ক্ষমতাসীন দল বদলে ফেলারও অবকাশ নেই। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুঁজি বা অর্থনীতিকে,  তার সূত্রে গোটা রাষ্ট্রকেই, নিয়ন্ত্রণ করেন পুঁজিপতিরা—এটাই বলে মার্কসবাদ। সেই মার্কসবাদীদের দেশেও তো আসলে অর্থনীতি, রাজনীতি সব নিয়ন্ত্রণ করছে কিছু লোকেই। উল্টে কথা বলার স্বাধীনতা অতি সংকীর্ণ। রাষ্ট্রকে বা সরকারকে সমালোচনার অধিকারও নেই বললেই চলে। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দাগিরি সন্দেহবাতিকগ্রস্ত রোগে আক্রান্তদের মতো দুর্বিষহ হয়ে উঠলো।

পরিণতিতে এমন ‘মহান’ ব্যবস্থাও টিকলো না। ঠিক যেভাবে ঝোড়ো হাওয়ার মতো একদিন ক্ষমতা তুলে নিয়েছিল লেনিনের পার্টি, তা ভেঙে পড়লো তাসের ঘরের মতো।  ভেঙে পড়ার পর দেখা গেলো, গোটা দেশের আমজনতা ওই ব্যবস্থাটা সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল। দেখা গেলো, শুধু খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের সংস্থান হয়ে গেলেই মানুষের সব পাওয়া হয় না। মানুষ যন্ত্র নয়। তার মন আছে। মনের খোরাক, চিন্তার ঔদার্যকে গলা টিপে রেখে খুব বেশিদিন মানুষকে শাসন করা যায় না।

এক দিন ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’য় উত্তরণ ঘটে একটা দেশের মানুষ পৃথিবীকে বিস্মিত করে দিয়েছিল। গোটা দেশটা ভেবেছিল, ধনী-দরিদ্র বা ক্ষমতাসীন-ক্ষমতাহীন বৈষম্য ঘুচিয়ে নিজেরাই নিজেদের শাসন করবে। একসঙ্গে। সবাই মিলে। সেই আবেগেই না ঘটেছিল উন্নয়নের অত বড় উল্লম্ফন! সেই আবেগকেই ইন্ধন জুগিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিনবাদী পার্টি। আবার উল্টো দিকে একই সঙ্গে উদ্যোগ চলেছে, পার্টিই যেন শেষ কথা হয়ে থাকে তার জন্য। ফলে লোকে এক দিন বুঝলো, দেশ চালায় পার্টির কিছু লোকেই। আর এখানেই, এই লেনিনবাদী পার্টির হাতেই, মৃত্যু হয় একটা মহা উদ্যোগের।

যেখানে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অস্তিত্ব প্রায় অদৃশ্য, খোদ রুশ দেশের মানুষই সমাজতন্ত্র এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে ভয়ানক রুষ্ট, তখন আমাদের দেশের কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা কেন নভেম্বর বিপ্লব স্মরণ করছেন? আর রাশিয়ায় তো বটেই, কিউবা, চীন, ভিয়েতনাম—সব সফল বিপ্লব একইসঙ্গে তত্ত্বের ও বন্দুকের লড়াই। তত্ত্ব ও অস্ত্র নিয়ে লড়াই করে ক্ষমতায় আরোহনের সেই বাস্তবতা কি বর্তমান দুনিয়ায় কোনও কমিউনিস্ট পার্টির আছে?

সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব-ইউরোপের সমাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে—এটা বাস্তবতা। কিন্তু এই বিপ্লব থেকে এমনকি এই ব্যবস্থার পতন থেকেও শিক্ষা নেওয়ার আছে অনেক কিছু।পুঁজিবাদী বিশ্বে বাড়তে থাকা আর্থিক বৈষম্য, দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা অথবা বর্তমান দুনিয়ার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের চরিত্র যা মানুষের শ্রমকে ‘আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টা করছে—মার্কস পুঁজিবাদের যে সব সমস্যাকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক। শুধু যাদের কায়েমি স্বার্থ রয়েছে এই বৈষম্যপূর্ণ স্থিতাবস্থাকে বজায় রাখার, তারাই দেখতে চাইছে না পরিবেশ ধ্বংস ও বিশ্ব উষ্ণায়নসহ নয়া উদারবাদী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বহুমুখী সংকটকে। এই সংকট থেকে বেরোতে এবং ভবিষ্যতে এক স্থিতিশীল, জনমুখী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা নির্মাণ করার জন্য মার্কসবাদ ও সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ, মানুষের চিন্তন ও কল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে থাকবে। সেই নিরিখে, বলশেভিক বিপ্লব, যা ছিল সভ্যতার ইতিহাসে প্রথমবার একটি পুঁজিবাদের বিকল্প সমাজ নির্মাণের প্রয়াস, ভবিষ্যতেও মানুষকে অনুপ্রেরণা জোগাবে।

রুশ বিপ্লবের ফলেই সাম্য-স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দুনিয়ার ছোট-বড় নানা দেশে সমাজতন্ত্রের ভাবধারাকে শক্তিশালী করেছে, ঔপনিবেশিক সমাজগুলিকে প্রভাবিত করে সাম্রাজ্যবাদ-উত্তর স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোতে সেই আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটতে দেখেছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের প্রয়োজনীয়তা, সেই সাম্য প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের ভূমিকা, রাষ্ট্রের সেই ভূমিকার সম্ভাব্য ধরনধারণ—এই সব জিজ্ঞাসা কিন্তু বিপ্লবের উত্তরাধিকারও বটে।

লেখক: কলামিস্ট

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কাল যুবদলের সমাবেশ, থাকবেন মির্জা ফখরুল
কাল যুবদলের সমাবেশ, থাকবেন মির্জা ফখরুল
নয়া পল্টনে বিএনপির সমাবেশ চলছে
নয়া পল্টনে বিএনপির সমাবেশ চলছে
ইরাক ও সিরিয়ায় ১৭ কুর্দি যোদ্ধাকে হত্যার দাবি তুরস্কের
ইরাক ও সিরিয়ায় ১৭ কুর্দি যোদ্ধাকে হত্যার দাবি তুরস্কের
টসে হেরে বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে
টসে হেরে বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ