X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডাকসুর নির্বাচন দাবিতে অনশন!

রেজানুর রহমান
২৯ নভেম্বর ২০১৭, ১২:৪৯আপডেট : ২৯ নভেম্বর ২০১৭, ১২:৪৯

 

রেজানুর রহমান অভিনব ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের বাসভবনের সামনে স্মৃতি চিরন্তনের পাশে একটি বাইসাইকেলে প্ল্যাকার্ড বেঁধে অনশন করছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন ছাত্র। প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘অবিলম্বে ডাকসু নির্বাচন চাই’। অবাক হলাম তার প্রচারণার ধরন দেখে। ঢাকা শহরে আজকাল বিচিত্র স্টাইলে, নানা কায়দায় ব্যক্তি অথবা পণ্যের প্রচার চলছে। শুধু ঢাকা শহরই বা বলি কেন, ঢাকার বাইরেও তো কম হচ্ছে না। কুষ্টিয়ায় মাইকেল জ্যাকশনের মতো পোশাক পরে, তারই মতো নেচে গেয়ে চানাচুর ভাজা বিক্রি করেন এক তরুণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে সে এখন বলা যায় অনেকেরই আইডল। বিশেষ ভঙ্গি ও স্টাইলের প্রকাশ ঘটিয়ে বগুড়ার হিরো আলম নামে এক অখ্যাত তরুণ তো এখন ফেসবুকের কল্যাণে সত্যিকারের হিরো হয়ে উঠেছেন। ইতোমধ্যে একাধিক সিনেমায় সে নাকি অভিনয়ও করে ফেলেছে। সেদিন ধানমন্ডি লেকের ধারে এক বাদাম বিক্রেতাকে দেখলাম ‘ফটফট’ করে ইংরেজিতে কথা বলছে। যেন ইংরেজিতে কথা বলতে পারাটা বিশেষ যোগ্যতা। অথবা একজন বাদামবিক্রেতা অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলছেন।  এটা তো একটা ঘটনা। তাই তার মুখে ইংরেজি কথা শোনার জন্যই অনেকে তার সামনে ভিড় করছে। বাদাম তো কিনছেই। আবার অবাক হয়ে তার ইংরেজি কথা শুনছে। কয়েকদিন আগে একটি দৈনিক পত্রিকায় পড়লাম, ডিগ্রি পাস এক তরুণী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। প্রতিদিন ৯টা-৫টা অফিস করতে হতো। হঠাৎ সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ধানমন্ডি এলাকায় লেকের ধারে ঝালমুড়ি বিক্রির ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা শুরু করে দেন। যারাই তার কাছ থেকে ঝালমুড়ি নেয় তাদের হাতেই সে একটা কাগজ ধরিয়ে দেয়। তাতে লেখা থাকে—প্রতিদিন একটি করে ভালো কাজ করুন। 

আমার অফিসে যেই আসে, তাকেই মেয়েটির কথা বলি। সবাইকে মেয়েটির ব্যতিক্রমী কাজের কথা তুলে ধরি। দ্যাখো, মেয়েটি ঝালমুড়ি বিক্রি করে। এটি তার পেশা। কিন্তু ঝালমুড়ির সঙ্গে সে যে কাগজটি ধরিয়ে দেয়, সেটা কিন্তু প্রশংসা করার মতো। ‘প্রতিদিন একটি করে ভালো কাজ করুন’—এই যে সুন্দর এক সামাজিক মূল্যবোধ সে ছড়াচ্ছে সত্যি প্রশংসনীয়। আমার কথা শুনে এক বন্ধু বললেন, মেয়েটি ঝালমুড়ির ঠোঙার সঙ্গে প্রতি খদ্দরের হাতে এই যে কাগজটি ধরিয়ে দিচ্ছে ওটা তার প্রচারণার কৌশল। এই কাগজটির কারণেই আমরা তাকে বেশি করে মনে রাখছি।

বন্ধুর সঙ্গে তর্ক করতে পারতাম। বলতে পারতাম হতে পারে মেয়েটি তার ঝালমুড়ির প্রচারণার জন্য এই কাগজটি বিলি করছে। কিন্তু সে কাগজে যে কথাটি লিখেছে, সেটি কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘প্রতিদিন একটি করে ভালো কাজ করুন’ না লিখে সে তো ঝালমুড়ি নিয়েই অনেক বিশেষণ তুলে ধরতে পারতো। সেটা সে করেনি। দেশের ভবিষ্যৎ কল্যাণে সে একটি ভালো কথা লিখেছে। প্রতিদিন একটি করে ভালো কাজ মানে ৩৬৫ দিনে ৩৬৫টি ভালো কাজ। ১৬ কোটি মানুষের দেশে বছরে কী পরিমাণ ভালো কাজ হবে, কল্পনা করুন তো একবার! 

বলছিলাম ব্যক্তি অথবা পণ্যের প্রচার-প্রচারণার কৌশলের কথা। কুষ্টিয়ার মাইকেল জ্যাকশন, বগুড়ার হিরো আলম অথবা ধানমন্ডির সেই বাদাম বিক্রেতা—সবাই কিন্তু নিজেদের অথবা নিজেদের পণ্যকে সবার কাছে পরিচিত করার লক্ষ্যে অভিনব এই প্রচারণা চালিয়েছেন অথবা চালাচ্ছেন প্রতিদিন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রের উদ্দেশ্য কী? সে কি তার প্রচার চায়, নাকি তার পণ্যের? দু’টি বিষয়ই অস্পষ্ট। এই তরুণ কোনও পণ্যের প্রচার চাচ্ছেন না। তিনি ‘ডাকসু নির্বাচন’ চান। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, তিনি কি কোনও ছাত্র সংগঠনের নেতা? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনও ছাত্র সংগঠনের সঙ্গেই তার সম্পৃক্ততা নেই। এই তরুণ ছাত্রের নাম ওয়ালিদ আশরাফ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে সন্ধ্যাকালীন একটি কোর্সে তিনি পড়াশোনা করেন। মাথায় হ্যাট, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, ময়লা টি শার্ট পরনে। একটি সাইকেল সঙ্গে কাঁথা-বালিশ আর একটি ব্যাগ নিয়ে অনশনে নেমেছেন। তাকে ঘিরে কৌতূহলী মানুষের অনেক ভিড়। কেউ তার উদ্যোগের প্রশংসা করছেন,  কেউ তাকে ‘পাগল’ বলে হাসি তামাশাও করছেন। তবে এটা সত্য ওয়ালিদের এই উদ্যোগের ফলে হঠাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ-ডাকসুর বিষয়টি কিছুটা হলেও আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

ডাকসুকে বলা হয় দেশের মিনি পার্লামেন্ট। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ডাকসুর যুগান্তকারী ভূমিকা সবার জানা। অথচ অবাক করার মতো ঘটনা, একটানা ২৭ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে না। ফলে ডাকসু ভুলতে বসা একটি নামে পরিণত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই ডাকসু সম্পর্কে কিছুই জানে না। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরে প্রায় ২০ জন ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মধ্যে ১৭ জনই ডাকসু সম্পর্কে কিছুই জানে না। ৩ জনের একজন ডাকসু সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা দিতে পারলেন। বাকি দু’জন নামটি সম্পর্কে জানেন। কিন্তু ডাকসুর ভূমিকা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। 

এই লেখাটি যখন লিখছি তখন হঠাৎ নিজেকে প্রশ্ন করলাম—আচ্ছা,  এই যে ২৭ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে না, তাতে কার কী ক্ষতি হয়েছে? সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য প্রতিবাদী অনেক মুখ আমার সামনে হাজির। সমস্বরে সবাই বলে উঠলো—আপনি কী বলছেন এসব? দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে ছাত্র সমাজের। অতীতে ডাকসু নির্বাচন সচল থাকার ছাত্র নেতৃত্ব গড়ে ওঠার পথ সহজ ছিল। বর্তমান সময়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন, তাদের অনেকে ডাকসুর মাধ্যমেই নেতৃত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো—ডাকসু সচল থাকলেই দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী সংসদও সচল হয়ে ওঠে। ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা জীবন তখন কিছুটা হলেও গতি পায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো ডাকসুর মতো দেশের প্রতিটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী সংসদ সচল থাকলে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠার একটা সম্ভাবনাও তৈরি হয়। 

আচ্ছা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠার প্রসঙ্গটি না হয় বাদই দিলাম। ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা জীবন আনন্দময় ও মেধাদীপ্ত করে তোলার জন্যও তো ডাকসুর মতো প্রতিটি ছাত্র সংসদ নির্বাচন জরুরি। ডাকসুর কথাই ধরা যাক, কবিতার ভাষায় বলতেই হয়, ‘সেই যে আমার নানান রঙের দিনগুলো’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সময়ের ছাত্র-ছাত্রীরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন। যেমন ডাকসু সচল থাকলে শুধু লেখাপড়ার ক্ষেত্রেই নয় ক্রীড়া, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ রাজনৈতিক চর্চার ক্ষেত্রেও ছাত্র-ছাত্রীরা নানা সুবিধার অধিকারী হয়ে ওঠে। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল দেশের সাংস্কৃতিক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। আজ যারা দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব পর্যায়ে রয়েছেন, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের অনকেইে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী। ডাকসু সচল ছিল বলেই তারা সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পেয়েছেন। শুধু কি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র, ক্রীড়াঙ্গনেও মেধাবী খেলোয়াড় তৈরির কারখানা হয়ে উঠেছিল ডাকসু। অথচ বর্তমান সময়ে দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি তেমন একটা চোখে পড়ে না। ক্রীড়াঙ্গনেও তেমন আলো ফেলতে পারছে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর একটাই কারণ ডাকসু সচল না থাকা। 

ডাকসুর প্রয়োজনীয়তার কথা সবাই বলেন, সবাই মানেনও। দেশের প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ স্বয়ং একাধিকবার ডাকসু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। তবু ডাকসু নির্বাচনের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনও আগ্রহ ও উৎসাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। প্রায় তিন দশক ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ ডাকসুর নির্বাচন হচ্ছে না। এটা কি ভাবা যায়? একজন ওয়ালিদ আশরাফ ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে অনশন করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এ গোলাম রব্বানী একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ডাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের একটি গণতান্ত্রিক দাবি। যে কেউ এই দাবি জানাতে পারেন। তবে অনশন যেকোনও আন্দোলনের শেষ ধাপ। কেউ যদি কোনও কিছুকে যুক্তিযুক্ত মনে করেন, তাহলে প্রথমে প্রশাসনের কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তখন কোনও সমাধানে না এলে পরে তার মতো কর্মসূচি দিতে পারেন। 

তার মানে ঘটনাটা কী দাঁড়ালো? ডাকসু নির্বাচনের দাবি যুক্তিযুক্ত নয়? এই শিক্ষার্থী না হয় অনশন করে ভুল করেছেন। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে তা শুধরে দেওয়া। সত্যি কি ভবিষ্যতে কোনও দিন ডাকসু নির্বাচন হবে?

লেখক: সাংবাদিক, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক

 

/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
৩ মে ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ডেকেছে ইসলামী আন্দোলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ইসলামী ব্যাংকের নোয়াখালী জোনের কর্মকর্তা সম্মেলন
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
ওলামা দলের আংশিক কমিটি দিয়েছে বিএনপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ