X
শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪
২৭ বৈশাখ ১৪৩১

একটু সুশাসন পেলে ভালো হয়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২০ জানুয়ারি ২০১৬, ১৩:১২আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০১৬, ১১:৪৪

 সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বাংলাদেশের সমাজে গোষ্ঠীগত দৌরাত্ম্য নিয়মিত ব্যক্তি স্বাধীনতাকে পিষে দেয়। কী রাজধানীতে, কী জেলায়, উপজেলায়, ইউনিয়নে মানুষকে ভয়কাতর করে সাধারণ নাগরিক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার ঘটনা আকছার ঘটছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তা, সিটি করপোরেশনের পরিদর্শক রাস্তায় মার খাবেন, কিন্তু পুলিশ প্রধান ভিকটিমকেই দোষী সাব্যস্ত করবেন, অপরাধী হিসেবে বিচারের আগেই রায় দিয়ে দিবেন। কিংবা আসাদগেট নিউ কলোনিতে ৫০ বছর ধরে বাস করা মানুষকে হঠাৎ একদিন বলপূর্বক তুলে দিবেন কোনও এক শক্তিশালী আইনের মানুষ। উন্নয়নের নামে আমরা এরকম দৌরাত্ম্য মেনে নিই, কিন্তু ভুলে যাই যে, সমাজের সবাই উন্নয়নের স্তুতি গাইতে থাকলে এর অলি-গলি দিয়ে গুন্ডারা জয়ী হয়।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ঘটেছে এবং এ সরকারের সময়ে আরও বেশি অবকাঠামোগত অগ্রগতি ঘটেছে। স্বাধীনতার পর শূন্য হাতে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। এক কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন, সাত কোটি মানুষের খাদ্য সংস্থান, বিশাল সংখ্যক মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা জাতির সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। রাস্তাঘাট, স্থাপনা পুননির্মাণ এবং সংস্কারও কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। অথচ রাজকোষ ছিল আক্ষরিক অর্থেই শূন্য। সে অবস্থা থেকে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আজ বিশ্বের যে ৫-৬টি দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। এ সাফল্য আশা জাগানিয়া। কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে মানুষ সুশাসনের ছোঁয়াটাও চায়, নয়তো সেই উন্নয়ন টেকসই রূপ নেয় না। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জনজীবনের শৃঙ্খলা, শোভনতা, নৈতিকতা সবকিছুতে কালিমা লাগছে শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের আগ্রাসী বাণিজ্যিক হাত আর শাসক দলের কোনও কোনও স্তরে সবকিছুর মালিক বনে  যাওয়ার সংস্কৃতি লালনে।
স্বাধীনতার পর গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথযাত্রা বিঘ্নিত হয়েছে অসাংবিধানিক শাসনের দখলে। দেশে আজ ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং দুর্নীতির যে বিষবৃক্ষ বেড়ে উঠছে তা সামরিক শাসকদেরই অবদান। এ বিপদ ঠেকানোর জন্য নির্বাচিত হয়ে এসেছেন তাদের কাছে প্রত্যাশা সুশাসন। কিন্তু স্বৈরাচার পতন হলেও দেশে, শাসক দলের কর্মীদের দখলের দৌরাত্ম্য আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরতায় সাধারণ নাগরিকদের সাধারণ স্বাধীনতাও আজ উবে যাওয়ার উপক্রম।

ক্ষমতার রাজনীতির এমন সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে যে, কর্মী-সমর্থকদের একটা অংশ ক্ষমতায় এসেই এই সিদ্ধান্তে স্থিত হয় যে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকতে হবে—তাই ভাবনার জগতে বাজতে থাকে একটাই ধারণা—আগের ক্ষমতাসীন দলের কায়দায় স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, এ-গলি ও-গলি, জল-জঙ্গল, রাস্তাঘাট, বাজার-হাট, বাড়িঘর সব দখল করে নাও। কেউ সামান্য সমালোচনা করলেই চালাও হাত। ফলে কেন্দ্রে যারা অবস্থান করেন তারা অনেক ভাল কাজ করলেও দল আর সরকার বন্ধুহীন হয়ে যায়।

স্বার্থ নিয়ে বিরোধ, ব্যক্তিগত অহমিকা, গোষ্ঠীস্বার্থের দ্বন্দ্ব এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, কখনও তা দেশময় আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা জাগিয়ে দেয়। সরকার আসবে, সরকার যাবে, কিন্তু থেকে যাবে সুশাসনের ‘দাগ’। ধমক দিয়ে, দাপট দেখিয়ে জনমন জয় করা যায় না, এ কথাটা তৃণমূল পর্যায়ে যত বেশি বুঝবে, কেন্দ্রে সরকার ততটা আস্থার সঙ্গে কাজ করবে।

বাংলাদেশ এখন বিশ্বব্যাংকের হিসেবে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। খুব সাধারণ মানুষেরা চায় আয় বাড়বে, কাজের সুযোগ তৈরি হবে, জিনিসপত্রের দাম কমবে, পণ্য এবং পরিসেবা সরবরাহের সুষ্ঠু ব্যবস্থা হবে, সরকারি কাজকর্ম দক্ষভাবে সম্পন্ন হবে, দুর্নীতি থাকবে না, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল থাকবে ইত্যাদি।

সরকার যখন উন্নয়নের দাবি করে তখন মানুষ মিলিয়ে নেয় নিজের সঙ্গে। তাই যে মানুষ বিনা অপরাধে রাস্তায় নির্যাতিত হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বা সরকারি দলের কর্মীর হাতে, যে মানুষের সম্পদ লুট হয়ে যায়, যার আর্তি কেউ শোনার মতো কেউ থাকে না, তারা এই উন্নয়নকে হৃদয়ে নেয় না।

আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, কিন্তু ঠিক পরিষ্কার নয় আগের চেয়ে কাজের সুযোগ বাড়ল কিনা? যারা টাকাপয়সা খরচ করে লেখাপড়া শিখছেন বা ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন, তাদের কাছে কিন্তু সেরকম কোনও সুখবর নেই। বিনিয়োগের চিত্র সুবিধার নয়, তাই কর্মসংস্থানের অবস্থাও তেমনি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ করে দিয়েছে সরকার, কিন্তু দু’একটি খাত বাদে বেসরকারি খাতে অনেকদিন ধরেই মাইনেপত্র বাড়ে না। অর্থনীতির গতিভঙ্গ হলে মানুষ এমনিতেই বুঝে, কথা দিয়ে বোঝাতে হয় না।

শহরাঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলেও হচ্ছে। পল্লী অঞ্চলে সামাজিক নিরাপত্তার নানা কর্মকাণ্ডও আছে। এমন নানা রকম ভর্তুকির প্রকল্প চালিয়ে দারিদ্র্য পুনর্বণ্টন করা যায়, সত্যিকারের সমৃদ্ধি আনা যায় না। এই সত্যটি স্পর্শকাতর (সেন্সিবল) মানুষকে ভাবায়। তাই মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণের মেয়াদ দেড় বছর বাড়ে, খরচ বাড়ে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা, কিন্তু জনগণ জানতে পারে না কেন বাড়ে মেয়াদ আর খরচ। স্বচ্ছতার এই অভাবে মানুষ উন্নয়নের ভেতর বড় দুর্নীতির ছায়া দেখতে পায়। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম তলানিতে এসে ঠেকেছে, কিন্তু জনগণ যখন দেখে তাকে কিনতে হচ্ছে সর্বোচ্চ দামে, তখন তার মনে উন্নয়ন আশা জাগায় না।    

বাংলাদেশের খুব দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। সামাজিক অর্থনৈতিক পরিসরে নতুনত্ব আসছে, পুরনো সমাজ কাঠামো ভেঙে যাচ্ছে, মানুষের চিন্তা-ভাবনা বদলাচ্ছে। গ্রাম আর শহরের মানুষের মানসিকতার পার্থক্যও কমে যাচ্ছে,  বিশেষত তরুণদের ক্ষেত্রে। তাই কিছু নির্দিষ্ট এলাকা নয়, রাজধানী বা বড় শহর নয়, গোটা দেশ এখন উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে, তার সঙ্গে দেখে নাগরিক হিসেবে তাকে কতটা মূল্যায়ন করা হচ্ছে।

রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারি নজর আছে তা বুঝতে পারা যায়। কিন্তু তবুও দেখা যায় ভোটদাতাদের রাগ বা বিরাগ ক্ষমতাসীন সরকার বা দলের বিরুদ্ধেই যায়। এর কারণ দুর্নীতি আর স্তরে স্তরে অপশাসনের ধারণা। উন্নয়নের পাশাপাশি লিমন, রাব্বি, নিউ কলোনির মতো ঘটনা মানুষের মনে ধারণা তৈরি করে দেয় যে, ক্ষমতাসীনরা দুর্নীতি অনিয়ম আর অনাচারকে সঙ্গে নিয়ে চলছে।   

উন্নয়ন ছাড়া যেমন সুশাসন নিশ্চিত করা যায় না, তেমনি সুশাসন ছাড়া উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করা যায় না। দুটিই পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। উন্নয়ন কষ্টসাধ্য হলেও অসম্ভব ব্যাপার নয়। কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন এয়ার অ্যারাবিয়ার ১৯১ যাত্রী ও ৭ ক্রু
অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন এয়ার অ্যারাবিয়ার ১৯১ যাত্রী ও ৭ ক্রু
সিল্কি চুলের জন্য ডিম ব্যবহারের ৭ উপায়
সিল্কি চুলের জন্য ডিম ব্যবহারের ৭ উপায়
স্থানীয় সরকার না ‘এমপি সরকার’?
স্থানীয় সরকার না ‘এমপি সরকার’?
চার প্রেক্ষাগৃহে ‌‘পটু’
এ সপ্তাহের ছবিচার প্রেক্ষাগৃহে ‌‘পটু’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ