X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চলমান গণতান্ত্রিক ধারায় বিপদের শঙ্কা

আনিস আলমগীর
২৬ জানুয়ারি ২০১৬, ১৩:১৪আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০১৬, ১৩:১৬

Anis Alamgirসংসদীয় গণতন্ত্রের মজবুত ভিত্তি গড়তে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলের সঠিক বিকাশ। আবার বিকাশমান এ রাজনৈতিক ধারার জন্য প্রয়োজন একটি ভালো মধ্যবিত্ত সমাজ। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে যে মধ্যবিত্ত সমাজটা গড়ে উঠেছিলো তার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিলো বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ। আর এ কারণেই এই দলের ভিত্তি এতোটা মজবুদ। ২১ বছর ক্ষমতায় ছিলো না, তবুও আওয়ামী লীগ ফতুর হয়ে যায়নি। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের অসংখ্য নেতা এই সময়ের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। অথচ দলে সার্বিকভাবে কখনও নেতৃত্বশূন্যতা সৃষ্টি হয়নি। দলের মধ্য থেকে উঠে আসা দলনেতাই দলের সেসব শূন্যস্থান পূরণ করে সুন্দরভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আবার জন্মের পর দীর্ঘ ২৩ বছরের সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নেতা-কর্মীদের বহু দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়েছে, বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। এভাবে বহু ত্যাগী নেতাকর্মীরও সমাবেশ হয়েছে আওয়ামী লীগের মাঝে। তাই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাক বা ক্ষমতার বাইরে থাক আওয়ামী লীগ কোনও কারণে কোনও সময়ে শেষ হয়ে যাবে- এ কথাটা বলা মুশকিল।
বর্তমানে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে আছে আওয়ামী লীগ। পরপর দুই দফায় নির্বাচনে জয়ী হয়ে তারা দীর্ঘ ৭ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। দেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন শেখ হাসিনা। এরইমধ্যে দেশ নিম্ন মধ্যআয়ের দেশের স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে। আশা করা যায় আগামী ৬ বছরের মধ্যেই মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত হবে। তবে ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলো আওয়ামী লীগ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান হতে রহিত করার অজুহাতে বিএনপি পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু সেই আন্দোলনের ভাষা মোটেও গণতান্ত্রিক ছিলো না। সেই আন্দোলনের রূপ ছিলো ধ্বংসাত্মক। যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে, রেল লাইন উপড়ে ফেলে, যত্রতত্র বোমা মেরে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করাই ছিল তাদের আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য।

আমাদের দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, সমাজের মধ্যবিত্ত অংশ রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেই কেবল সেই আন্দোলন সফল হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন পূর্ববর্তি বিএনপির আন্দোলনে মধ্যবিত্ত সমাজ নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করেনি। জোটের শরীক দল জামায়াতে ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি ঢাকাকে সন্ত্রাসের নগরী তৈরি করে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছিলো। এতে তারা আংশিকভাবে সফলও হয়েছিলো। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণি আন্দোলনে না আসায় সরকারের প্রশাসনযন্ত্র নিরঙ্কুশভাবে সরকারকে সমর্থন দিয়েছিলো। তাই সরকারের পতন ঘটানো কোনওভাবেই সম্ভব হয়নি। অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টা সব সময় সফল হয় না। নিয়মতান্ত্রিক পথ পরিহার করে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একটা উপযুক্ত শিক্ষা পেয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিলো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। তবে নির্বাচনটা করা সম্ভব হলেও নির্বাচনকে ঘিরে রয়েছে নানা বিতর্ক।

বিএনপি-জোট আদতে নির্বাচনটা বানচাল করে দিতে চেয়েছিলো। তাই তারা সারাদেশে ১৫০টি ভোটকেন্দ্র জ্বালিয়ে দিয়েছিলো, প্রিজাইডিং অফিসার হত্যা করেছিলো, নিরাপত্তাকর্মী হত্যা করেছিলো, ভোটার হত্যা করেছিলো। দেশজুড়ে বোমাবাজি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিলো বিএনপি জোট। যে কারণে ভোট স্বতস্ফূর্ত হয়নি এবং ভোটার উপস্থিতিও ছিলো কম। বিএনপি-জামাত জোট যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলো তাতে সামরিক হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল না করে ক্ষমতা বদলের পদ্ধতিটা টিকিয়ে রাখার বিষয়ে ছিলো আন্তরিক। অথচ যতটা অস্থিরতার মুখে সামরিক বাহিনী দেশের ক্ষমতা দখল করে, ততটা অস্থিরতা সৃষ্টি করতে বিএনপি-জামাত জোট শতাংশে সফল হয়েছিলো। সেদিন সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করলে বিএনপি-জামাত জোট-এর শতাংশ সমর্থনও পেত তারা।  বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ২০১৪ সালে শাসনতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়ে একটা ঐতিহাসিক ধারা সৃষ্টি করেছে।

২য় দফায় নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ আছে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। তাই বলা চলে, বিএনপির দাবি মতো মধ্যবর্তী নির্বাচন দেওয়া না দেওয়া একান্তই আওয়ামী লীগের এখতিয়ার। এতে কোনও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যতই কলঙ্ক ছড়ানো হোক না কেন, নির্বাচন বানচালের দায় বিএনপিকেই নিতে হবে। এজন্য আওয়ামী লীগের কোনও দোষ নেই। ভোটারের কম উপস্থিতির জন্যও আওয়ামী লগি দায়ী না। আসলে ভোটার উপস্থিতির সংখ্যাও নির্বাচনের গুরুত্ব বিচারের প্রকৃত মাপকাঠি না। অল্পসংখ্যক লোকও যদি জনসাধারণের আশা আকাঙ্ক্ষা এবং উদ্দেশ্যকে যথাযথভাবে ব্যক্ত করতে পারে তবে তার সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনও অসঙ্গতি নেই।

সংসদীয় গণতন্ত্রই রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর বিকাশ ও কর্মকাণ্ড কোনওটাই সংসদীয় গণতন্ত্রের মজবুত ভিত্তি গঠনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে না। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি- দুটি দলই দুটি সামরিক শাসকের অভিলাস পূরণের জন্য গঠিত দুইটি দল। জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হয়ে সামরিক বাহিনী নিয়ে খুব খেলেছেন, খেলায় খেলায় করুণ পরিণতিতে তার সমাপ্তি ঘটেছে। ক্ষমতায় বসে বিএনপি নামক যে দলটি তিনি গঠন করেছিলেন এখন তার প্রধান হচ্ছেন তার বিধবা স্ত্রী, বেগম খালেদা জিয়া। আচরণের দিক থেকে তিনিও অনেকটা সামরিক কর্মকর্তাদের মতোই। আর তার নেতৃত্বে বিএনপি মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে। গত দুই দশক ধরে তারাই পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। দলটি জামাতের সঙ্গে জোটবদ্ধ।

জামায়াতের সব নেতৃস্থানীয় নেতাই যুদ্ধাপরাধের দায়ে বর্তমানে বিচারের সম্মুখীন। ইতিমধ্যে অনেকের ফাঁসি হয়েছে, অনেকে ফাঁসির অপেক্ষায় আছে। দলটা খুবই কঠিন সময় অতিক্রম করছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান জারি করে ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকে বিধি নিষেধ প্রত্যাহার করে জামায়াতে ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। অথচ জামায়াতের চলমান কঠিন সময়ে কোনও কাজে আসেনি বিএনপি। বরং জামাতকে সঙ্গে নিয়ে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে গিয়ে বিএনপি যে সন্ত্রাসী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো তাতে বিএনপি নিজেই বিধ্বস্থ হয়েছে। আর জামাতের অবস্থাকে আরও করুণ করে তুলেছে।

ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামাতকে স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছে। এ দলটি জামায়াতে ইসলামী নামে আর হয়ত টিকে থাকতে পারবে না। তবে নতুন প্রজন্মের নেতা কর্মীদেরকে নিয়ে নতুন নামে নতুন আঙ্গিকে তারা আত্মপ্রকাশ করতে পারে। অন্যদিকে বিএনপিও বর্তমানে নতুনভাবে সংগঠিত হবার চেষ্টা করছে। পৌরসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। ভবিষ্যতে  হয়ত অন্য নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চললে হয়তোবা আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলটা ভালো ফল প্রত্যাশা করতে পারে।

জাতীয় পার্টি হচ্ছে আরেকজন সামরিক শাসকের দল। জেনারেল এরশাদ এ দলের প্রতিষ্ঠাতা। ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে এ দলটা অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। যদি সাহস করে নির্বাচনে থাকতে পারতো তবে দলটার ভবিষ্যৎ হয়তোবা ভালোই হতো। কিন্তু নির্বাচন হবে, কি হবে না, সরকার টিকবে, কি টিকবে না, এসব ভয়ভীতিতে এরশাদ নির্বাচন থেকে সরে পড়েছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী রওশন এরশাদ তার থেকে দৃঢ় মনোবলের পরিচয় দিয়ে একটা অংশ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। তবে একথা না বললেই না, এ দেশ সৃষ্টিতেও এরশাদের নূন্যতম কোনও ভূমিকা ছিলো না। আর ভবিষ্যতে কোনও দূর্যোগেও তার ভূমিকা থাকবে বলে প্রত্যাশা করাটা কেবল বাহুল্যমাত্র।

এতো কথার শেষেও বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কি হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েই যাচ্ছে। বিএনপি গণতান্ত্রিক মেজাজ নিয়ে রাজনীতি করতে অভ্যস্ত নয়। জাতীয় পার্টি বিলীন প্রায়। জামায়াতের বিলুপ্তিও কিছু সময়ের ব্যাপার। তাই বলা চলে, নতুন গণতান্ত্রিক দলের বিকাশ না হলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা হয়তোবা সংকটের মধ্যেই পড়বে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected] 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দেশের জন্য কাজ করতে আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
দেশের জন্য কাজ করতে আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
নির্মোহ মূল্যায়নের খোঁজে জাসদ
নির্মোহ মূল্যায়নের খোঁজে জাসদ
সাফজয়ী ভাইয়ের সঙ্গে লড়াই, নেই কোনও ছাড়
সাফজয়ী ভাইয়ের সঙ্গে লড়াই, নেই কোনও ছাড়
বিয়ে না করানোয় মাকে হত্যা
বিয়ে না করানোয় মাকে হত্যা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ