X
শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪
২৭ বৈশাখ ১৪৩১

কেন প্রধান বিচারপতিকে বিতর্কিত করার প্রচেষ্টা!

গোলাম মোর্তোজা
০৯ মার্চ ২০১৬, ১১:১৬আপডেট : ০৯ মার্চ ২০১৬, ১১:২৪

গোলাম মোর্তোজা মীর কাশেম আলী জামায়াতের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। সে প্রভাবশালী আর্থিক ক্ষমতার দিক দিয়ে। জামায়াতের যত অর্থ-সম্পদ তার অধিকাংশই মীর কাশেমের নিয়ন্ত্রণে। অর্থনৈতিকভাবে প্রবল ক্ষমতাবান মীর কাশেম আলীর আজকের অবস্থান দেখে, একাত্তরের মীর কাশেম আলীর দানবীয় কর্মকাণ্ড বোঝা মুশকিল। যদিও স্বাধীনতার পরের পুরো সময়কাল তার দানবীয় কর্মকাণ্ড অব্যাহতই ছিল।
একাত্তরে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের চট্টগ্রাম শহর শাখার সভাপতি। সেই সময়ের তরুণ মীর কাশেম আলী হত্যা-নির্যাতনের নেতৃত্ব দিয়েছে। শিবিরের হত্যা -রগকাটা তাণ্ডবও মীর কাশেম আলীর নির্দেশনাতেই হয়েছে। একাত্তরে চট্টগ্রামের ডালিম হোটেল ছিল তার নির্যাতন কেন্দ্র। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন এবং হত্যা করা হতো। এসবই ঘটত মীর কাশেম আলীর নির্দেশে।
আর্থিক দিক দিয়ে প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান, মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের রাজপরিবারের সঙ্গে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক, বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ, দেশের অনেককে ম্যানেজ করার চেষ্টা... প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমের দুর্বলতা, দুজন মন্ত্রীর অত্যন্ত আপত্তিকর বক্তব্য... প্রভৃতি কারণে মীর কাশেম আলীর রায় নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। রায় ঘোষণার সকালের নাটকীয়তা উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়।
মীর কাশেম আলীর রায়কে কেন্দ্র করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে কিছু কথা।

১. মীর কাশেম আলীর নেতৃত্বে, নির্দেশনায়, পরিচালনায় অপরাধ, গণহত্যার সংখ্যা অগণিত। এত বছর পরে এসে সব অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। তা করার চেষ্টাও হয়নি। কয়েকশ’র মধ্য থেকে অভিযোগ আনা হয়েছিল ১৪টি। প্রত্যাশা ছিল ১৪টি অভিযোগই প্রমাণ হবে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে ১০টি অভিযোগ প্রমাণ হয়। ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ফাঁসির আদেশ দেন। অন্য ৮টি প্রমাণিত অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড দেওয়া হয়। যেহেতু জনমানুষের প্রত্যাশা ছিল মৃত্যুদণ্ড। দু’টি অভিযোগে তা হওয়ায়, মানুষ রায় মেনে নেয়।

২. আশঙ্কা তৈরি হয় আপিলের শুনানিকালে মাননীয় প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের প্রেক্ষিতে। প্রধান বিচারপতি প্রসিকিউশন টিমের দুর্বলতা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। প্রসিকিউশন টিমকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত বলে মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই প্রসিকিউশন টিমের দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। বিচারের দাবিতে আন্দোলনরত সব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান প্রসিকিউশন টিমের দুর্বলতা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তখন এই বক্তব্য সরকারের পক্ষ থেকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যেমন মীর কাশেম আলী বিদেশে লবিস্ট নিয়োগের পেছনে ২৫ লাখ ডলার ব্যয় করেছেন, এই তথ্য জানা সত্ত্বেও সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার দৃশ্যমান কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। প্রসিকিউশন টিমের কোনও কোনও আইনজীবীর বিরুদ্ধেও বেশ কিছু অভিযোগ আলোচনায় এসেছে। দীর্ঘদিন পর একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে। তাও অভিযোগ আসার কয়েক বছর পর ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে। 

অর্থাৎ প্রধান বিচারপতিই প্রথম প্রসিকিউশন টিমের দুর্বলতা নিয়ে কথা বললেন, বিষয়টি মোটেই তেমন নয়।

৩. প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের পর বড় রকমের আশঙ্কা তৈরি হয়, মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা নিয়ে। রায়ের আগে কার্যতালিকায় থাকা না থাকা নিয়ে আশঙ্কার পর তা আরও বেড়ে যায়। যদিও অল্প সময়ের মধ্যে আপিলের রায় ঘোষণা এবং অন্তত একটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে।

৪.  এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে প্রধান বিচারপতি প্রসিকিউশনের সমালোচনা করায় বিচার প্রক্রিয়া দেশে -বিদেশে বিতর্কের মুখে পড়েছে। অদ্ভূতভাবে এই প্রসঙ্গটি তারাই তুলছেন, যারা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আন্দোলনের সঙ্গে শুরু থেকে সম্পৃক্ত। 
মীর কাশেম আলীরা জানে যে তারা অপরাধী। তাই তারা কৌশল নিয়েছে বিচার প্রক্রিয়াটিকে বিতর্কিত করার। দেশে -বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। আরও নানা উপায় অবলম্বন করে বলেছে এই বিচার 'স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিক' মানের নয়।

প্রধান বিচারপতিকে দায়ি করে বলা হচ্ছে, প্রসিকিউশন টিমের সমালোচনা করে তিনি জামায়াতের উদ্দেশ্য অর্থাৎ বিচার প্রক্রিয়া বিতর্কিত করার কাজে সহায়তা করেছেন।  এই অভিযোগটি বিস্ময়কর।
প্রধান বিচারপতি সমালোচনা করেছেন মামলা প্রমাণে, তথ্য প্রমাণ উপস্থাপণে দুর্বলতা, ভুল-অসত্য বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন যা অপরাধীদের পক্ষে যায়, প্রসিকিউশনের এসব কর্মকাণ্ডের। প্রধান বিচারপতির সমালোচনা মামলা যাতে আরও ভালোভাবে প্রমাণ করা যায় সেই উদ্দেশে। বিচার প্রক্রিয়া বিতর্কিত করার কোনও উদ্দেশে নয়। 

জামায়াতের সমালোচনা আর প্রধান বিচারপতির সমালোচনা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষিত এবং উদ্দেশে।

৫.  প্রধান বিচারপতিকে বিতর্কিত করার একটি প্রক্রিয়া একজন সদ্য অবসরে যাওয়া বিচারপতি অবসরে যাওয়ার আগে থেকেই শুরু করেছেন। এখন সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আরও অনেককে যোগ দিতে দেখা যাচ্ছে।

এই প্রক্রিয়ায় দু 'জন মন্ত্রীকেও সম্পৃক্ত হতে দেখা গেল।  যার মধ্যে সৎ কোনও উদ্দেশ্য আছে, এমনটা ভাবার কারণ নেই।

এই প্রধান বিচারপতি কাদের মোল্লার যুগান্তকারী মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন। সাকা চৌধুরী, মীর কাশেম আলীর রায় তিনি দিয়েছেন। আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন।  যে সব রায়ে সাধারণ জনমানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে। প্রধান বিচারপতি তথা সেই প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করে, কে কার উদ্দেশ্য সাধন করছে, তা গভীরভাবে বিচার -বিশ্লেষণের দাবি রাখে। 

৬. আর একটি কথা আবারও বলা দরকার মনে করছি, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শেখ হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তটির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত আন্তরিক এবং দৃঢ়। শত প্রতিকুলতার মাঝেও তিনি অবিচল আছেন। এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই বলছি,  প্রসিকিউশন টিমের দুর্বলতা দূর না করে, ইসলামী ব্যাংকসহ জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে থাকা ১২৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে পৃষ্টপোষকতা দিয়ে, প্রধান বিচারপতি-প্রতিষ্ঠানের সমালোচনার নামে বিতর্কিত করার প্রচেষ্টা কোনও সমর্থনযোগ্য কাজ হতে পারে না। এটা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের, বিচার প্রত্যাশী সবারই উপলব্ধিতে আসা প্রয়োজন। 

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শেষের দিকে সোহেলের ভুলে আবাহনীর ড্র
শেষের দিকে সোহেলের ভুলে আবাহনীর ড্র
মা দিবসে কী উপহার দেবেন মাকে?
মা দিবসে কী উপহার দেবেন মাকে?
বিএনপি ফের নৈরাজ্য করলে ডাবল শিক্ষা পেয়ে যাবে: ওবায়দুল কাদের
বিএনপি ফের নৈরাজ্য করলে ডাবল শিক্ষা পেয়ে যাবে: ওবায়দুল কাদের
কৃষি খাতে উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ বরাদ্দের দাবি
কৃষি খাতে উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ বরাদ্দের দাবি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ