X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

‘যুদ্ধে মারা যাবো, একথা একবারও মাথায় আসেনি’

দুলাল আবদুল্লাহ, রাজশাহী
০৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৯:০৭আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ২০:৩০

মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন শেখ ভুলু ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সেই ভাষণ আলোড়িত করেছিল তাকে। তখন তিনি ছিলেন আর্মড ফোর্সেস ব্যাটেলিয়নের নায়েক। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ সকালে রাজশাহী কারাগারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আক্রমণ করলে জেলখানার গেট থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেন। সেই থেকে শুরু। তারপর নয় মাস ধরে মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরে বীরত্ব দেখিয়ে গেছেন আলাউদ্দিন শেখ ভুলু। মৃত্যুর ভয়ে শঙ্কিত হননি কখনও। মাতৃভূমির জন্য নিজেকে উৎসর্গের ব্রত নিয়েই করে গেছেন যুদ্ধ। রণাঙ্গনের সেই দিনগুলোর কথা তিনি বলেছেন বাংলা ট্রিবিউনকে।

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রেরণা পেলেন কীভাবে, জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন শেখ ভুলু বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আমাকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। ওই দিন আমাদের ভাষণটি শুনতে দেওয়া হয়নি। আমরা ভাষণটি শুনেছিলাম ৮ মার্চ। পুলিশ লাইনে তখন তৈরি হয় বিভক্তি। পাঞ্জাবি-বিহারিদের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব তৈরি হয়। ওরা পুলিশ লাইন থেকে শুরু করে প্রধান প্রধান জায়গা দখল করে নেয়। আমাদের বাঙালি সৈনিকদের দায়িত্ব দেওয়া হয় কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে। এটা আমাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। তবে বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণই ছিল আমার প্রেরণা।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় আলাউদ্দিন শেখ ভুলু ছিলেন আর্মড ফোর্সেস ব্যাটালিয়নের নায়েক। রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা আক্রমণের পর ২৮ মার্চ সকালে রাজশাহী আক্রমণ করে পাক বাহিনী। ওই সময়ই মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন আলাউদ্দিন শেখ।

ওই দিনের ঘটনা বলতে গিয়ে আলাউদ্দিন শেখ বলেন, ‘ওই দিন (২৮ মার্চ) আমি জেলখানার দায়িত্বে ছিলাম। জেলখানার গেট থেকে পাক আর্মিদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিলাম। পরে পাক আর্মিরা সকাল ৯টার দিকে গুলি করতে করতে জেলখানায় ঢুকে পড়ে। আমাদের ওপর বেয়নেট চার্জ করে ওরা। ওখান থেকে আমাদের ২৫ জনকে ডাকবাংলোয় (বর্তমানে পুলিশ কমিশনারের অফিস) নিয়ে গিয়ে একটি ঘরে আটকে রাখে। বিকালে পুলিশ লাইনে আক্রমণ করে ১৯ জনকে মেরে ফেলে। পরের দিন সকালে ওই লাশ তুলতে গিয়ে পালিয়ে যাই। পরে বাঙালি পুলিশ ও সাধারণ জনতা একসঙ্গে পুলিশ লাইন আক্রমণ করে অস্ত্রাগার দখল করে নেয়। এরপর থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত রাজশাহী মুক্ত ছিল। ১৪ এপ্রিল আবার রাজশাহী দখলে নেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।’

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন আলাউদ্দিন শেখের বাবা। তাতে ভেঙে পড়েননি তিনি। ভারতের ক্যাম্পে চলে যান। পরে ফিরে এসে স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি। আলাউদ্দিন শেখ বলেন, ‘আমার বাবা পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগারের দায়িত্বে ছিলেন। ২৪ এপ্রিল আমার বাবাকে অস্ত্রাগার লুটের দায়ে নির্যাতন করে জীবন্ত কবরে পুঁতে দেয়। এর মধ্যে আমি মেজর রশিদের সঙ্গে ভারতের লালগোলা ক্যাম্পে অবস্থান নিই। ওইখানে ১৩ দিন ছিলাম। ওখান থেকে ফিরে কাজীপাড়া ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নিই। কাজীপাড়া ক্যাম্পে স্থানীয় বাংলাদেশি যুবকদের নিয়ে এসে প্রশিক্ষণ দিতাম। মুক্তিবাহিনী গঠিত হওয়ার পর আমরা সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। রাজশাহীর বাঘা, দুর্গাপুর, চারঘাট, ঈশ্বরদী, পুঠিয়ার বিভিন্ন এলাকায় আমরা অপারেশন চালিয়েছে। আমি ছিলাম ১৬ বেঙ্গলের বি কোম্পানিতে।’

মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ কোনো একটি ঘটনার কথা জানতে চাইলে আলাউদ্দিন বলেন, ‘তখন আমরা ঈশ্বরদীতে অপারেশন চালাতে গেছি। পাকশী ব্রিজ তখনও ধ্বংস হয়নি। পাক আর্মিরা ভেড়ামারার দিক থেকে নদী পথে ড্রামে করে ঈশ্বরদীতে আসছে। আমরা রূপপুর হাইস্কুলের পাশে অবস্থান নিয়েছি। পাকশী ব্রিজের ঠিক গোড়ায় ওদের সঙ্গে একবার যুদ্ধ হয় আমাদের। যুদ্ধে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হই। ওই সময় প্রাণে বাঁচার জন্য প্রাচীর দিয়ে ঘেরা একটি বাড়িতে আশ্রয় নিই। ওই বাসায় ক্লাস সিক্স ও ক্লাস এইটে পড়া দুই মেয়ে ছাড়া আর কেউ ছিল না।’

আলাউদ্দিন বলতে থাকেন, ‘আমি ওই বাসায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আর্মিরা গেট ধাক্কানো শুরু করে। বড় মেয়েটা আমাকে রুমে নিয়ে আলনার পিছনে রেখে মাথা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়। ছোট মেয়েটা গেট খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের একজন বড় মেয়েটাকে জোরে চড় মারে। উর্দুতে জিজ্ঞাসা করে, আমি বাসায় ঢুকেছি কি না। মেয়েটা সাহসের সঙ্গে জবাব দেয়, বাসায় তারা দুই বোন ছাড়া আর কেউ নাই। কাউকে লাফিয়ে পড়তে দেখেছে কি না জানতে চাইলে মেয়েটা বুদ্ধি করে বলে, একজন লাফিয়ে ওই দিকে চলে গেছে। ওই মেয়ের বুদ্ধি ও সাহসিকতা আমার জীবন রক্ষা করেছিল। এটা আমি কখনও ভুলতে পারি না।’

মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ অসামান্য ছিল। আলাউদ্দিন শেখ নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই এটা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন যুদ্ধে। যুদ্ধের সময় তারা যেভাবে সহযোগিতা করেছেন তার কোনও তুলনা হয় না। তারা নিজেরা না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়েছেন, বাড়িতে ঘুমাতে দিয়েছেন, রাত জেগে পাহারা দিয়েছেন। অস্ত্র, গোলাবারুদ মাথায় করে বইয়ে নিয়ে গেছেন, তথ্য সংগ্রহ করে এনে দিয়েছেন। তারা এভাবে সাহায্য না করলে আমাদের কাজ অনেক কঠিন হয়ে যেত।’

ঈশ্বরদিতে যুদ্ধের ওই দিন হয়তো মারাও যেতে পারতেন আলাউদ্দিন শেখ ভুলু। সম্মুখ সমরের যেকোনও দিনই চলে যেতে পারত প্রাণ। কিন্তু মৃত্যুর ভয় গ্রাস করতে পারেনি তাকে। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধে মারা যাব, এ কথা একবারও মাথায় আসেনি। তখন লক্ষ্য ছিল একটাই- পাকিস্তানিদের, বিহারিদের পরাজিত করে দেশকে স্বাধীন করা। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার মানসিকতা নিয়েই যুদ্ধ করেছি আমরা। নিজেদের জীবন নিয়ে কখনও ভাবিনি।’

 আরও পড়ুন-
ভিক্ষা করে দিন চলে মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়ার

‘যুদ্ধ হয়েছিল একবার, তবু নিত্য দেখি নতুন মুক্তিযোদ্ধারা তালিকাভুক্ত হন’

 

/টিআর/

সম্পর্কিত
নানা আয়োজনে রাজধানীবাসীর বিজয় উদযাপন
বিজয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা
জাবিতে আলোকচিত্র প্রদর্শনী
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা