‘দিনে দেখা যায় ধোঁয়া, রাতে শোনা যায় চিৎকার ও গুলির শব্দ’ বাংলা ট্রিবিউনের এই একটি খবরের মাধ্যমে বদলে যায় রোহিঙ্গা ইস্যু। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের চিত্র তুলে ধরে আমার লেখা প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর সাড়া ফেলে। বাংলা ট্রিবিউন ওয়েবসাইটে খবরটি দেখেই মূলত দেশের জাতীয় পত্রিকাগুলো থেকে শুরু করে টেলিভিশন, অনলাইন ও রেডিওসহ বিভিন্ন মিডিয়া এমনকি আন্তর্জাতিক মিডিয়াও সংবাদ সংগ্রহের জন্য হামলে পড়ে সীমান্তে। ফলে রোহিঙ্গা এখন একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু।
গত বছরের ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে সহিংসতার ঘটনার প্রায় এক মাস অতিবাহিত হওয়ার পর যখন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ শুরু করে, তখনও এখানকার কোনও মিডিয়া এই সংবাদ কাভার করেনি। বিষয়টি সরাসরি বাংলা ট্রিবিউনের হেড অব নিউজ হারুন উর রশীদের কাছে তুলে ধরি। তার পরামর্শ ছিল, খুব কৌশল অবলম্বন করে নিউজগুলো লেখার জন্য সীমান্ত এলাকায় সরেজমিন যেতে হবে। প্রয়োজনে যাতায়াতের সব খরচ বাংলা ট্রিবিউন বহন করবে। এরপর একাই দ্রুত সীমান্তে যাওয়ার চেষ্টা করি।
কিন্তু প্রতিটি সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কড়া সতর্ক পাহারা ছিল। তারা মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তে কোনও সংবাদকর্মীকে যেতে দেননি। বিশেষ করে মুসলিমদের ওপর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ঘটনা বাংলাদেশে প্রকাশিত হলে জাতিগত সংঘাতের বিষয়টি মাথায় রেখে স্থানীয় প্রশাসনও কড়া নজরদারি রাখছিল। তারা চেয়েছিলেন রামু ট্র্যাজেডির মতো ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
একইভাবে আরাকান রাজ্যেও কোনও স্থানীয় কিংবা প্রতিবেশী অন্য দেশের সংবাদকর্মীসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাই সেখানে মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনের খবরগুলো তুলে আনা ছিল দুরূহ কাজ। সব মিলিয়ে কোনও সাংবাদিক তো দূরের কথা, স্থানীয়রা পর্যন্ত সীমান্তের কাছাকাছি যেতে পারছিল না। সীমান্তে যাওয়া আমার জন্যও ছিল কঠিন। তবে হাল ছাড়িনি। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে যাওয়ার চেষ্টা করি।
অবশেষে ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের স্থানীয় এক ইউপি সদস্যের (নাম গোপন রাখা হলো) সহযোগিতায় উলুবনিয়া সীমান্তে পৌঁছাতে সক্ষম হই। সেখানে গিয়েই সীমান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলি। এই অভিজ্ঞতা থেকে ১৭ নভেম্বর দিনে ‘দেখা যায় ধোঁয়া, রাতে শোনা যায় চিৎকার ও গুলির শব্দ’ এই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন পাঠাই বাংলা ট্রিবিউনের ইমেইলে। সংবাদটি পোর্টালে আপ হওয়ার পর সাড়া পড়ে যায়। ফলে রোহিঙ্গাবিষয়ক আরও অ্যাসাইনমেন্ট এলো। প্রতিদিন নিয়মিত মোবাইল ফোন পেয়ে প্রতিবেদন লিখে নির্ঘুম রাত কেটেছে আমার। একই সঙ্গে ঢাকা ট্রিবিউন থেকেও অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হচ্ছিল।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত আমার প্রতিবেদনগুলো কপি করে দেশের অনেক মিডিয়া হুবহু প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও আমার একাধিক প্রতিবেদন দেখেছি। এগুলো ছিল উৎসাহব্যঞ্জক।
রোহিঙ্গা নিয়ে এক্সক্লুসিভসহ প্রায় শতাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় বাংলা ট্রিবিউনে। এর মধ্যে গত বছরের নভেম্বরে ‘রাতে সরব নাফ, অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গা’ এবং ডিসেম্বরে ‘গড়ে উঠছে রোহিঙ্গাদের নতুন বসতি’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন দু’টির সুবাদে পরপর দু’বার সেরা প্রতিবেদক হয়েছি। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছি স্মারক ও আর্থিক প্রণোদনা। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় যাতায়াতের খরচও বহন করেছে বাংলা ট্রিবিউন। এজন্য সম্পাদক জুলফিকার রাসেলের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমার প্রত্যাশা— সঠিক সময়ে সঠিক সংবাদ প্রকাশে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকুক বাংলা ট্রিবিউন।