লন্ডনের গ্রেনফেল টাওয়ার ভবনে বৃষ্টি প্রতিরোধী যে প্রলেপ (ক্ল্যাডিং) ব্যবহার করা হয়েছিল তা এক মার্কিন কোম্পানির তৈরি। তবে যুক্তরাষ্ট্র ভবনে ওই বস্তুর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে আগেই। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইন্ডিপেনডেন্টের এক প্রতিবেদনে এ কথা জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৩ জুন) মধ্যরাতে গ্রেনফেল টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ১৭ জন নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। আগুনের ভয়াবহতা দেখে ভবনটির নির্মাণের ধরন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। খোঁজা হচ্ছে ভবনটির নির্মাণজনিত ত্রুটি। খতিয়ে দেখা হচ্কেছে কেন আগুন এতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। ইন্ডিপেনডেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের মে মাসে ভবনটির সংস্কার করার সময় এর বাইরে অ্যালুমিনিয়াম প্যানেল ব্যবহার করা হয়। অগ্নি নিরাপত্তাজনিত কারণে ৪০ ফুটের বেশি উঁচু ভবনে ওই প্রলেপ ব্যবহার করা যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ তলায় আগুণের সূত্রপাত হয়। তারা নীল আগুনের আভা দেখতে পান যা গ্যাস বিস্ফোরণ থেকে হয়ে থাকতে পারে। ১৯৭৩ সালে নির্মিত এই ভবনটিকে গত বছরই সংস্কার করা হয়েছিল। সেসময়ই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ আর আধুনিকায়নের জন্য বৃষ্টি প্রতিরোধী এক প্রলেপ ব্যবহার করা হয়েছিল ভবনে। সে কারণে তৃতীয়/চতুর্থ তলার আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হচ্ছে দেয়ালে থাকা বৃষ্টিপ্রতিরোধী প্রলেপের (ক্ল্যাডিং) কারণেই এমনটা হয়েছে। গ্রেনফেলে যে প্যানেল ব্যবহারি করা হয়েছিল তা মার্কিন কোম্পানি রেইনোবন্ড-এর তৈরি বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ রেইনোবন্ড কোম্পানি তিন ধরনের প্যানেল তৈরি করে থাকে। এর মধ্যে একটি দাহ্য প্লাস্টিক কোর আর দুটি আগুন প্রতিরোধী কোর। ধারণা করা হচ্ছে, গ্রেনফেলের ভবনে অপেক্ষাকৃত সস্তা ও অনেক বেশি দাহ্য পলিথিলিন কোর ব্যবহার করেছেন ঠিকাদাররা।
মার্কিন কোম্পানি রেইনোবন্ডের এক সেলসম্যান নিজেই দ্য টাইমসকে বলেন, গ্রেনফেল টাওয়ারে যে ধরনের প্যানেল ব্যবহার করা হয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্রের উঁচু ভবনে ব্যবহার নিষিদ্ধ। এর কারণ, ‘এতে আগুন ও ধোঁয়া ছড়ায়’। তিনি জানান, পলিথিলিন কোর (পিই ভার্সন) সাধারণত ছোটখাটো বাণিজ্যিক ভবন এবং পেট্রোল স্টেশনগুলোতে ব্যবহার করা হয়। উঁচু টাওয়ার কিংবা হাসপাতালের মতো বড় বড় ভবনে এ কোর ব্যবহার করা হয় না। ওই সেলসম্যান আরও বলেন, ‘এফআর হলো অগ্নি প্রতিরোধক প্রলেপ, আর পিই কেবলই প্লাস্টিক।’এ ব্যাপারে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট-এর পক্ষ থেকে রেইনোবন্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও এখন পর্যন্ত সাড়া পাওয়া যায়নি।
কোনও ভবনে প্রতি বর্গমিটারে অগ্নি প্রতিরোধী প্যানেল ব্যবহারে খরচ পড়ে ২৪ পাউন্ড। দাহ্য কোরের চেয়ে এক্ষেত্রে ২ পাউন্ড বেশি খরচ হয়। গ্রেনফেল টাওয়ারের ২০০০ মিটারের অগ্নি প্রতিরোধী প্রলেপ দিতে নির্মাতাদের দাহ্য কোরের তুলনায় ৫ হাজার পাউন্ড বেশি খরচ হতো। অগ্নি-নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ গ্রাহাম ফিল্ডহাউস বলেন, ‘ক্ল্যাডিংয়ের পেছনের বস্তুগুলো অদাহ্য হওয়ার কথা। আমি জানি না তারা কোনও বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নিয়েছে কিনা।’ তিনিও মনে করেন বৃষ্টি প্রতিরোধক এই ক্ল্যাডিংয়ের কারণেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।
২০১৬ সালে ভবনটির সংস্কার কাজ করা রাইডন কন্সট্রাকশন অবশ্য দাবি করেছে তারা সবরকম অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। এক বিবৃতিতে তারা জানায়, ‘আমরা গ্রেনফেল টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের কথা শুনে খুবই মর্মাহত। হতাহত আর তাদের পরিবারের পাশে রয়েছি। রাইডন সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালের গ্রীষ্মে। সেসময় সকল প্রকার অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।’ তারা আরও জানায়, ‘আমরা এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও জরুরি সার্ভিসের সঙ্গে একযোগে কাজ করবো। এদিকে গ্রেনফেল অ্যাকশন গ্রুপ অনেকদিন ধরেই দাবি করে আসছিলো যে ভবনটি নিরাপদ নয়। আগুন লাগার পর তারা আক্ষেপের সঙ্গে জানায়, ‘আমরা বারবার সতর্ক করে দেওয়ার পরও কেউ শোনেননি। আমরা সবসময়ই বলে এসেছি যেকোন সময় এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’
গ্রেনফেল টাওয়ারে জিংকের রেইন স্ক্রিন ক্ল্যাডিং ব্যবহার করা হয়েছিলো। ক্ল্যাডিং সাধারণত কাঠ, প্লাস্টিক কিংবা মেটাল দিয়ে তৈরি করা হয়। এটি পানি বা বাষ্প বের হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। এতে করে বৃষ্টির পানি দেয়ালে প্রবেশ করতে পারে না। এছাড়া নিচের প্রলেপে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেরও ব্যবস্থা রয়েছে। অগ্নি-নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ গ্রাহাম ফিল্ডহাউস বলেন, ‘ক্ল্যাডিংয়ের পেছনের বস্তুগুলো অদাহ্য হওয়ার কথা। আমি জানি না তারা কোনও বিশেষজ্ঞর পরামর্শ নিয়েছে কিনা।’ তিনিও মনে করেন বৃষ্টি প্রতিরোধক এই ক্ল্যাডিংয়ের কারণেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।
ইন্ডিপেনডেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যজুড়ে কয়েক হাজার ঘরবাড়িতে জরুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তা নাহলে ভবনের বাইরে ব্যবহৃত প্রলেপের কারণে এসব ভবনও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে আছে।
/এফইউ/বিএ/