ভারতের বৃহত্তম করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মানহানির মামলার হুমকির মুখে ইকনোমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি (ইপিডব্লিউ) সম্পাদক প্রাণঞ্জয় গুহ ঠাকুরতাকে পদত্যাগে বাধ্য এবং আদানি পাওয়ার লিমিটেডের সমালোচনা করে লিখিত প্রবন্ধটি সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে সংবাদমাধ্যমটির পরিচালনাকারী ট্রাস্টি বোর্ড।
ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যার ‘ভারতের করপোরেট থাবার প্রথম শিকার শীর্ষস্থানীয় সম্পাদক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে প্রাণঞ্জয়কে। সমালোচনামূলক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করায় সংবাদমাধ্যমটির বিরুদ্ধে কয়েক কোটি রুপির মানহানির মামলা দায়েরের হুমকি দিয়ে আইনি নোটিশ পাঠায় আদানি গোষ্ঠী। এরপর সংবাদমাধ্যমটির পরিচালনাকারী ট্রাস্টি বোর্ডের পরিচালকরা প্রাণঞ্জয়কে পদত্যাগের নির্দেশ দেন। এমনকি সরিয়ে নেওয়া হয় ওই প্রতিবেদনগুলো।
দু’টি প্রবন্ধের একটির শিরোনাম ছিল ‘আদানি গ্রুপ কি ১ হাজার কোটি রুপি কর ফাঁকি দিয়েছে?’ অপরটি ছিল ‘আদানি গ্রুপকে ৫০০ কোটি রুপির সুবিধা দিয়েছে মোদি সরকার’। প্রবন্ধ দুটি ইপিডব্লিউয়ের পাশাপাশি দ্য ওয়্যার-এ প্রকাশ করা হয়েছিল।
জুন মাসে আদানি পাওয়ার লিমিটেড আইনজীবীদের মাধ্যমে ইপিডব্লিউ, প্রাণঞ্জয়সহ চার লেখক এবং সমীক্ষা ট্রাস্টকে একটি চিঠি পাঠায়। সমীক্ষা ট্রাস্টই ইপিডব্লিউ পরিচালনা করে থাকে। এই চিঠিতে শিগগিরই বিনাশর্তে দু’টি প্রবন্ধ মুছে ফেলতে বা প্রত্যাহার করতে বলা হয়। চিঠিতে আদানি গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এই দু’টি প্রবন্ধ তাদের সেবা গ্রহীতাদের জন্য মানহানিকর ও ক্ষতিকর।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, যদি প্রবন্ধ দু’টি প্রত্যাহার বা মুছে ফেলা না হয় তাহলে আদানি গ্রুপ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
এরপর সমীক্ষা ট্রাস্ট বোর্ডের পরিচালকরা দিল্লিতে বৈঠকে বসেন এবং সম্পাদকীয় বিভাগকে প্রবন্ধ দু’টি প্রত্যাহার করতে নির্দেশ দেন। বৈঠকের পর পদত্যাগ করেন প্রাণঞ্জয়। পদত্যাগের কারণ সম্পর্কে তিনি জানান, দিল্লিতে পরিবারকে আরও বেশি সময় দেওয়ার জন্যই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এই বিষয়ে সমীক্ষা ট্রাস্টের চেয়ারপারসন দীপক নায়ারের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। বোর্ডের সদস্য ইতিহাসবিদ রমিলা থাপার, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাজিব বার্গাভা ও সমাজবিদ দিপংকর গুপ্তও এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। আদানি গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে দ্য ওয়্যারকেও প্রবন্ধ দু’টি প্রত্যাহারের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
১৯৪৯ সালে ইকনোমিক উইকলি নামে যাত্রা শুরু ১৯৬৬ সালে ইপিডব্লিউ নাম নেয় সংবাদমাধ্যমটি। রাজনৈতিক ভাষ্যের জন্য ভারতের অন্যতম সংবাদমাধ্যম হিসেবে মনে করা হয় এটিকে। প্রাণঞ্জয় ভারতের শীর্ষ একজন বাণিজ্য সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। ২০১৬ সালের জানুয়ারি তিনি ইপিডব্লিউয়ের সম্পাদকের দায়িত্ব নেন।
১৮ জুন প্রাণঞ্জয়ের পদত্যাগের খবর প্রকাশের পরই সমালোচনা শুরু হয়েছে। ক্ষুদে ব্লগ সাইট টুইটারে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই দাবি করছেন, আদানি এই চিঠিটি স্ট্র্যাটেজিক ল’স্যুইটস অ্যাগেইনস্ট পাবলিক পার্টিসিপেশন বা স্ল্যাপস-এর একটি উদাহরণ। মিডিয়া বিশ্লেষক ও আইনজীবীরা স্ল্যাপস বলতে করপোরেশন, ডেভেলপার বা সরকারি কর্মকর্তারা সমালোচনা বন্ধ করতে, ফাঁসকারীকে শাস্তি দিতে বা বাণিজ্যিক বিরোধ এড়াতে যে মামলা করা হয় সেটা বুঝিয়ে থাকেন।
এই ঘটনার সমালোচনাকারীরা বলছেন, আদানি গোষ্ঠী একজন আইনজীবী দিয়ে চিঠি পাঠানোর পরই প্রবন্ধ দু’টি প্রত্যাহার করে ফেলা হয়। অথচ চিঠিতে ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমার কথা বলা হলেও বাস্তবে এই মেয়াদ পার হওয়ার পরও কোনও মামলা দায়ের করেনি করপোরেট প্রতিষ্ঠানটি।
তাদের দাবি, বড় বড় করপোরেশনগুলো সম্পাদক, সম্পত্তির মালিক, সাংবাদিক ও লেখকদের ভয় দেখাতেই এ ধরনের চিঠির আশ্রয় নেয়। তাদের অপরাধগুলো আলোয় যাতে না আসে সেজন্যই এ পন্থা অবলম্বন করে করপোরেশনগুলো।
দ্য ইকনোমিস্ট পত্রিকার মুম্বাই প্রতিনিধি স্ট্যানলি পিজনাল লিখেছেন, প্রভাবশালীর স্বার্থে আঘাত করায় চাকরি হারালেন ভারতের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম একজন।
ভারতের ন্যাশনাল মিডিয়া প্যানেলিস্ট রাগিনি নায়েক প্রাণঞ্জয়ের পদত্যাগের ঘটনাটিকে লজ্জাজনক আখ্যায়িত করেছেন। তিনি লিখেছেন, করপোরেট চাপে সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতা হেরে যাচ্ছে।
সমালোচনা করেছেন ইপিডব্লিউ-এর সাবেক সম্পাদক সি. রাম্মানোহার রেড্ডি। তিনি দাবি করেছেন, ইপিডব্লিউ-র পরিচালনায় সংকট রয়েছে। সূত্র: দ্য হিন্দু, দ্য ওয়্যার, দ্য স্ক্রল।
/এএ/