X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
আল জাজিরার বিশেষ প্রতিবেদন

যে পদ্ধতিতে আরব বিশ্বে গুপ্তহত্যা চালায় মোসাদ

বিদেশ ডেস্ক
২৪ এপ্রিল ২০১৮, ১৬:০৩আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০১৮, ১৮:০৪
image

মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে ফিলিস্তিনি শিক্ষাবিদ ফাদি আল বাতসের হত্যাকাণ্ডের পর সন্দেহের তীর এখন  ইসরায়েলের দিকে। আবারও আলোচনায় বিশ্বব্যাপী বিতর্কিত সে দেশের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। এমন অবস্থায় কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা তাদের এক বিশেষ প্রতিবেদনে তুলে এনেছে আরব বিশ্বে মোসাদের গুপ্তহত্যার বিস্তারিত প্রক্রিয়া। প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোসাদ প্রথমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ইসরায়েলের বৃহত্তম গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এবং ইসরায়েলি রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমন্বয়ে হত্যার টার্গেট নির্ধারণ করে। যাকে হত্যার পরিকল্পনা নেওয়া হয়, দ্বিতীয় ধাপে এসে তার সম্পর্কে বিস্তারিত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের পর তা মূল্যায়ন করে মোসাদ। মূল্যায়নকৃত প্রতিবেদন ইসরায়েলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধানদের নিয়ে গঠিত ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস কমিটির প্রধানের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই কমিটিই সুপারিশ হাজির করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করা যায় কিনা। আল জাজিজার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ ২/১ জনকে সঙ্গে নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন। গুপ্তহত্যা পরিচালনায় গঠিত মোসাদের বিশেষ ইউনিট ক্যাসেরিয়া সেই নির্দেশ বাস্তবায়ন করে।
যে পদ্ধতিতে আরব বিশ্বে গুপ্তহত্যা চালায় মোসাদ

গাজায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়াশোনা শেষ করে আল বাতস মালয়েশিয়ায় তার পিএইচডি সম্পন্ন করছিলেন। ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস তাকে নিজেদের সদস্য দাবি করে হত্যাকাণ্ডে মোসাদকে দায়ী করেছে। একই অভিযোগ তুলেছেন বাতসের বাবাও। তার এক বন্ধুও বলছেন, ফিলিস্তিনিদের কাছে হামাস সদস্য হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। পাওয়ার সিস্টেম ও এনার্জি সেভিংয়ের ওপর বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকাশকারী বিশেষজ্ঞ আল বাতসকে রকেট প্রস্তুতকারী আখ্যা দেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আভিগদোর লাইবারম্যান। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাও এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মোসাদের সম্পর্ক খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছে। এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে ওই সংবাদমাধ্যম দেখিয়েছে মোসাদ কীভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করে।

গত শনিবার কুয়ালালামপুরের বাসা থেকে ফজরের নামাজ পড়তে বের হওয়ার পর দুই মোটরসাইকেল আরোহীর ছোড়া গুলিতে নিহত হন আল বাতস। ইসরায়েলের অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও ইসরায়েলের গোয়েন্দা তৎপরতার অন্যতম বিশেষজ্ঞ রনেন বার্গম্যান আল জাজিরার কাছে দাবি করেছেন, আল বাতসের হত্যাকাণ্ড মোসাদের অভিযানের যাবতীয় চিহ্ন বহন করছে। বার্গম্যান টেলিফোনে আল জাজিরাকে বলেন, ঘটনা হলো হত্যাকারীরা মোটরসাইকেল ব্যবহার করে তাদের লক্ষ্যবস্তকে হত্যা করেছে, এরকম ব্যবহার আগেও মোসাদের অনেক অভিযানে হয়েছে। তার মতে, হত্যার পর সাধারণের মধ্যে মিশে যাওয়া, ইসরায়েল থেকে বহু দূরে পেশাদার হত্যাকাণ্ড ঘটানো মোসাদের জড়িত থাকারই ইঙ্গিত দেয়। আল জাজিজার বিশ্লেষণ অনুযায়ী কাউকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে গুপ্তহত্যার বিষয়টি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়।

যে পদ্ধতিতে আরব বিশ্বে গুপ্তহত্যা চালায় মোসাদ

লক্ষ্য নির্ধারণ

আল জাজিরার খবর অনুযায়ী, গুপ্তহত্যা চালানোর জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করতে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা মোসাদের অভ্যন্তরে সাধারণত কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালানো হয়। ইসরায়েলের বৃহত্তর গোয়েন্দা কাঠামো ও রাজনৈতিক নেতৃত্বও এর সঙ্গে যুক্ত থাকে। কোনও কোনও সময় মোসাদ ছাড়াও ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ ও সামরিক বাহিনীও লক্ষ্য নির্ধারণ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, আল বাতসকে হয়তো লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে হামাসকে অনুসরণকারী ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ও গোয়েন্দা সংগঠনের মাধ্যমে। এছাড়াও বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ইসরায়েলের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা অপারেশনের মধ্য দিয়েও তাকে লক্ষ্য হিসেবে নির্বাচন করা হয়ে থাকতে পারে। সূত্রের বরাত দিয়ে আল জাজিরা বলছে, গাজা থেকে হামাসের সঙ্গে তুরস্কের ইস্তানবুল এবং লেবাননের বৈরুতে হওয়া যোগাযোগ নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখে ইসরায়েলের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক।

গুপ্তহত্যার প্রক্রিয়া

লক্ষ্য হিসেবে আল বাতসে নির্বাচনের পর মোসাদ হত্যার জন্য টার্গেটকৃত ব্যক্তি সংক্রান্ত যাবতীয় গোয়েন্দা তথ্য মূল্যায়ন করে। কাউকে হত্যা করা হবে কিনা, হত্যা করলে লাভ কি হবে আর এটা করার সবচেয়ে ভালো উপায় কী এসব দিক খতিয়ে দেখা হয় সেই মূল্যায়নে। মোসাদের বিশেষজ্ঞ ইউনিট তার লক্ষ্য সম্পর্কে তৈরি করা ফাইলের কাজ শেষ করে ফেলে ফলাফল নিয়ে ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস কমিটির প্রধানের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ইসরায়েলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধানদের নিয়ে এই কমিটি গঠিত। হিব্রু ভাষায় এর নাম ভারাস (Varash)।

ভারাস শুধু অভিযান নিয়ে আলোচনা করে। এরমধ্যে কোনও পরামর্শ থাকলে দেয় বা অন্য কোনও কিছু যোগ করে। তবে অভিযানের অনুমতি দেওয়ার আইনগত ক্ষমতা নেই এই কমিটির। একমাত্র ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীরই এই ক্ষমতা রয়েছে। বার্গম্যান আল জাজিরাকে বলেন, সাধারণত রাজনৈতিক কারণে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ওই কমিটিকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুমোদন দেন না। প্রায়শই প্রধানমন্ত্রী এক বা দুজন মন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন। প্রায়ই এক্ষেত্রে তার সঙ্গে থাকেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী।

যে পদ্ধতিতে আরব বিশ্বে গুপ্তহত্যা চালায় মোসাদ

অভিযান অনুমোদন পেয়ে গেলে এর দায়িত্ব আবারও মোসাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয় হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য। পরিকল্পনা সফল করতে কখনও কখনও সপ্তাহ,  মাস, এমনকি বছরও লেগে যেতে পারে। এই সময় নির্ভর করে এর লক্ষ্যের ওপরে।

ক্যাসেরিয়া ইউনিট

মোসাদের অভ্যন্তরীণ একটি ইউনিট ক্যাসেরিয়া। প্রধানত আরব বিশ্বে গুপ্ত অভিযান পরিচালনার স্বার্থে ৭০-এর দশকে গঠিত এই  ইউনিট বিশ্বের যেকোনও প্রান্তে গোয়েন্দা মোতায়েন ও পরিচালনা করে থাকে। ক্যাসেরিয়া তার আরব রাষ্ট্র ও বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে বিস্তৃত গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিদ্যমান ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য লক্ষ্য সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। এসব লক্ষ্যের ওপর নজরদারিও করে থাকে তারা।

সবচেয়ে বেশি অস্ত্রসজ্জিত ইউনিটে পেশাদার হত্যাকারী নিয়োগ করা হয়। এসব পেশাদাররা গুপ্তহত্যা ও আত্মঘাতী অভিযানে বিশেষজ্ঞ। সাধারণত ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন শাখা থেকে কিডোনের সদস্যদের নির্বাচন করা হয়। সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে আল জাজিরা জানিয়েছে, কুয়ালালামপুরে যারা আল বাতসে হত্যা করেছে তাদের কিডোনের সদস্য বলে মনে হয়েছে।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর স্পেশাল একটিভিটি সেন্টার (এসএসি)-এর সমমান সম্পন্ন ক্যাসেরিয়া। তবে ক্ষেত্রবিশেষে সিআইএ’র চেয়েও মোসাদ ভয়াবহ। বেশিরভাগ সিআইএ-র গুপ্তহত্যা পরিচালিত হয় প্রেসিডেন্টের অনুমোদনক্রমে, ড্রোন হামলার মাধ্যমে।  মোসাদের ক্ষেত্রে এসব হত্যাকাণ্ডের বৈধতা অর্জন অনেক বেশি সহজ;  আল জাজিরাকে বলেছেন সংশ্লিষ্ট একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা। সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে হত্যার ইসরায়েলি নীতি সম্পর্কে তিনি বলেন,  ‘এটা তাদের জাতীয় নীতিগত প্রক্রিয়ার অংশ। ’

যে পদ্ধতিতে আরব বিশ্বে গুপ্তহত্যা চালায় মোসাদ

মোসাদের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সাড়া জাগানো একটি বই রচনা করেছিলেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক বার্গম্যান।  তার লেখা রাইজ এন্ড কিল ফার্স্ট বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে অধিকৃত এলাকায় ফিলিস্তিনি জাতিমুক্তি আন্দোলন দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েল ৫ শতাধিক গুপ্তহত্যার অভিযান চালিয়ে এক হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। আর দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময়ে ইসরায়েল এক হাজারের বেশি অভিযান চালিয়েছে। তার মধ্যে ১৬৮টি সফল হয়েছে। তখন থেকে ইসরায়েল আরও অন্তত আটশ’ অভিযান চালায়, যার লক্ষ্য ছিল গাজা উপত্যকার ভেতর বাইরে হামাসের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্বকে হত্যা।

আল জাজিরা বলছে, কয়েকটি আরব ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের সঙ্গে মোসাদ ঐতিহাসিক ও আনুষ্ঠানিক সংযোগ রক্ষা করে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জর্ডান ও মরক্কোর গোয়েন্দা সংস্থা। অতি সম্প্রতি এই অঞ্চলের সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোর বদল ও সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কাছ থেকে হুমকি বাড়তে থাকায় মোসাদ তাদের সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ করেছে।

/জেজে/বিএ/চেক-এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
সাফের আগে চাইনিজ তাইপের বিপক্ষে সাবিনাদের ম্যাচ
সাফের আগে চাইনিজ তাইপের বিপক্ষে সাবিনাদের ম্যাচ
কানের ধ্রুপদি বিভাগে শ্যাম বেনেগালের ‘মন্থন’
কানের ধ্রুপদি বিভাগে শ্যাম বেনেগালের ‘মন্থন’
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ